সর্বশেষ অর্থবছরে কমছে দেশের রপ্তানি আয়ের পরিমাণ। যদিও এসময়ে নগদ প্রণোদনাসহ বিভিন্ন সুবিধা দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রণোদনা বাবদ সরকারের গড় ব্যয় প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা। এমন পরিস্থিতিতে নতুন অর্থবছরের শুরুতেই সবধরনের প্রণোদনা আরেক দফা কমানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। যা এখাতে চ্যালেঞ্জ আরও বাড়িয়ে তুলবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
এদিকে জ্বালানি সংকটে রীতিমত ধুঁকছে দেশের রপ্তানি খাতসহ সবধরনের শিল্প। উৎপাদন সচল রাখতে বাড়তি দামে বিকল্প জ্বালানির সন্ধান করতে হচ্ছে উদ্যোক্তাদের। খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রণোদনা হ্রাস ও জ্বালানির বাড়তি দামের কারণে এখাতে নতুন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে নতুন বিনিয়োগের ঘাটতি। যা নতুন কর্মসংস্থানসহ প্রভাব ফেলতে পারে সামগ্রিক অর্থনীতিতেও।
তবে ভিন্ন মতও রয়েছে অনেকের। তারা বলছেন, ২০২৬ সালে এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন অর্থাৎ স্বল্পউন্নত দেশের কাতারে যাবে বাংলাদেশ। তখন বিদ্যমান সুবিধা ও প্রণোদনা থাকবে না। সে ক্ষেত্রে পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে ধীরে ধীরে এসব সুবিধা হ্রাস করা হচ্ছে। যা দীর্ঘ মেয়াদে এখাতকে আরও স্বনির্ভর ও প্রতিযোগিতামূলক করে তুলবে। এরই অংশ হিসেবে চলতি বছরে দ্বিতীয়বারের মতো প্রণোদনা হ্রাসের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
এর আগে গত ৩০ জুন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রজ্ঞাপনে প্রণোদনা হ্রাসের সিদ্ধান্ত জানানো হয়। যা চলতি মাসের ১ তারিখ থেকেই কার্যকর হয়েছে। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, আর্থিক পরিমাণের দিক থেকে সর্বাধিক প্রণোদনা পাওয়া তৈরি পোশাক খাতের (আরএমজি) জন্য বিশেষ প্রণোদনার হার ০.৫০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ০.৩০ শতাংশ করা হয়েছে। তবে চামড়া রপ্তানিতে প্রণোদনা ০.৬০ শতাংশ করা হয়েছে। যা আগে শূন্য ছিল। একমাত্র এই একটি পণ্যে প্রণোদনা বাড়ানো হয়েছে। এর বাইরে নতুন বাজারে রপ্তানিতে প্রণোদনা ১ শতাংশ পয়েন্ট কমিয়ে ২ শতাংশ করা হয়েছে। পাট ও পাটপণ্য, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, হিমায়িত মাছ, কৃষিপণ্যসহ অন্যান্য খাতের জন্য এই হার প্রযোজ্য হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী ৩০ জুন পর্যন্ত সর্বোচ্চ প্রণোদনাপ্রাপ্ত খাত ছিল কৃষিপণ্যে, এসব পণ্য রপ্তানিতে ১৫ শতাংশ হারে প্রণোদনা দেওয়া হতো। এবং গত ফেব্রম্নয়ারির আগে এসব পণ্যে নগদ প্রণোদনার হার ছিল ২০ শতাংশ। অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত প্রজ্ঞাপনে ৪৩টি রপ্তানি পণ্যে নগদ প্রণোদনার আওতায় রাখা হয়েছে যার মধ্যে ৬৫ শতাংশই দেওয়া হয় দেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক ও টেক্সটাইল খাতকে।
এদিকে বিদায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের রপ্তানি আয় তার আগের অর্থবছরের তুলনায় ০.৪৯ শতাংশ কমেছে। ৪ জুলাই বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিদায়ী অর্থবছরে বাংলাদেশ পণ্য রপ্তানি করে ৫ হাজার ৫২৮ কোটি ৮১ লাখ ডলার আয় করেছে যা গত বছরের তুলনায় ০.৪৯ শতাংশ কম। ২০২২-২৩ অর্থবছরে রপ্তানি আয় হয়েছিল ৫ হাজার ৫৫৫ কোটি ৮৭ লাখ ডলার। এ ছাড়া ২০২১-২২ অর্থবছরের তুলনায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ছিল ৬.৬৭ শতাংশ।
দেখা গেছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য সরকারের বেঁধে দেওয়া ৬ হাজার ২০০ কোটি ডলারের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের আয় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৬৬১ কোটি ডলার কম।
শিল্প উদ্যোক্তা ও রপ্তানিকারকরা বলছেন, এলডিসি উত্তরণ হতে পারে ২০২৬ সালের দিকে, কিন্তু এখনই রপ্তানিমুখী খাতে প্রণোদনা হ্রাস বৈদেশিক মুদ্রায় আয় আরও চ্যালেঞ্জিং করে তুলবে। তাদের দাবি, রপ্তানি আয় কমেছে, প্রবৃদ্ধিও নেই। ডলারের দাম বৃদ্ধিতে আয় বাড়লেও বেড়েছে কাঁচামাল আমদানি ব্যয়। অন্যদিকে বেড়েছে ব্যাংক ঋণে সুদের হার। এর মধ্যে জ্বালানির উচ্চমূল্য ও প্রাপ্তিতে অনিশ্চয়তা এখাতে ব্যয় কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। বাধ্য হয়ে কমাতে হচ্ছে উৎপাদনের মাত্রা। এসবের মধ্যে এমন সিদ্ধান্ত এখাত আরও দুর্বল করেত পারে। শুধু তাই নয়, পরিস্থিতি এমন থাকলে কমতে পারে নতুন বিনিয়োগ।
সংশ্লিষ্টদের মতে নতুন অর্থবছরে রপ্তানিমুখী শিল্প খাতে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে চাহিদা অনুযায়ী জ্বালানি প্রাপ্তি। সর্বশেষ ৫ মাসে শিল্পে জ্বালানি বিশেষ করে গ্যাসের সরবরাহ তলানিতে ঠেকেছে। বর্তমানে অঞ্চলভেদে চাহিদার মাত্র ২০-৩০ শতাংশ গ্যাসের সরবরাহ পাচ্ছে শিল্পগুলো। ফলে এখাতে সক্ষমতার শতভাগ উৎপাদন করা যাচ্ছে না। নতুন অর্থবছরে এই সমস্যা কতটুকু সমাধান হবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই উদ্যোক্তাদের কাছে।
এদিকে এ সংকট মোকাবিলায় জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ বেশকিছু প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এর মধ্যে আমদানিকৃত গ্যাস খালাস ও পরিবহণ সক্ষমতা বৃদ্ধি, জ্বালানি তেল পরিশোধন সক্ষমতা বৃদ্ধি, গ্যাস পরিবহণে পাইপলাইন নির্মাণ ও নিজস্ব গ্যাস উত্তোলনে নতুন কূপ খনন রয়েছে। কিন্তু এসব প্রকল্পের বেশির ভাগেরই সুবিধা পেতে অপেক্ষা করতে হবে ২০২৬ থেকে ২০৩০ সাল পর্যন্ত। ফলে নতুন অর্থবছরে শিল্পে চাহিদা অনুযায়ী জ্বালানিপ্রাপ্তি অনিশ্চিত থাকতে পারে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম যায়যায়দিনকে বলেন, এই মুহূর্তে অর্থনীতি যেভাবে যাচ্ছে তাতে প্রণোদনা কমানো হলে স্থানীয় স্পিনিং মিলসহ ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্প তীব্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এমনিতেই জ্বালানি না থাকায় আমাদের উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে। বাধ্য হয়ে কারখানা বন্ধ রাখতে হচ্ছে, কর্মীরা বেকার হয়ে পড়ছে। এ অবস্থায় প্রণোদনা বন্ধ করলে রপ্তানি আয় আরও কমে আসবে।
তিনি জানান, ০.৩০ শতাংশ নগদ প্রণোদনার জন্য আবেদন করতেই প্রণোদনার তুলনায় বেশি খরচ পড়ে যায়। এ ছাড়া ব্যাংকের সুদের হার আগের থেকে বেড়েছে, জ্বালানির নিশ্চয়তাও নেই। সরকারের উচিত এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া।
বিজিএমইএর পরিচালক এবং ক্লাসিক ফ্যাশন কনসেপট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শহীদুলস্নাহ আজিমের মতে, বিকল্প সুযোগ-সুবিধা না দিয়ে এভাবে প্রণোদনা হ্রাস করা হলে রপ্তানিমুখী শিল্প টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। যদি প্রণোদনা কমিয়ে আনা হয় তাহলে এর বিপরীতে পোশাক শিল্পের জন্য বিভিন্ন ধরনের নীতিগত সুবিধা বাড়াতে হবে। যা ইন্ডিয়া, চায়না, ভিয়েতনাম দিয়ে থাকে। বাংলাদেশেও সেগুলো চালু করতে হবে।