যুক্তরাজ্যের সাধারণ নির্বাচন হ

লেবার পার্টির ভূমিধস জয়

ক্ষমা চেয়ে বিদায় নিলেন ঋষি সুনাক অভিনন্দন জানিয়ে শেখ হাসিনার চিঠি

প্রকাশ | ০৬ জুলাই ২০২৪, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
যুক্তরাজ্যের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয় পেয়ে লন্ডনের ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে হাত নেড়ে সমর্থকদের অভিবাদনের জবাব দিচ্ছেন স্যার কিয়ের স্টারমার ও তার স্ত্রী ভিক্টোরিয়া -ইন্টারনেট
বুথফেরত জরিপই সত্য হলো। জয়টাও প্রত্যাশিত ছিল। যুক্তরাজ্যের নির্বাচনে ভূমিধস জয় পেয়েছে লেবার পার্টি। নিরঙ্কুশ জয় পাওয়ায় দলের নেতা কিয়ের স্টারমারকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দিয়েছেন ব্রিটেনের রাষ্ট্রপ্রধান রাজা দ্বিতীয় চার্লস। স্টারমার শুক্রবার বাকিংহাম প্রাসাদে রাজার সঙ্গে দেখা করতে গেলে তিনি তাকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দেন। বাংলাদেশ সময় রাত ১০টা পর্যন্ত লেবার পার্টি ৪১১টি আসনে জয় পেয়েছে। কনজারভেটিভ পার্টি পেয়েছে ১১৯টি আসন। আর লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি ৭১টি, এসএনপি ৯টি, এসএফ ৭টি আসন পেয়েছে। যুক্তরাজ্যে টানা ১৪ বছর পর ক্ষমতা থেকে সরে গেল কনজারভেটিভ পার্টি। বিদায় নিতে হবে প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাককে। তিনি পরাজয় মেনে নিয়েছেন। স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার সকাল ৭টা থেকে ব্যালটের মাধ্যমে ভোট গ্রহণ শুরু হয়। চলে রাত ১০টা পর্যন্ত। এবারের নির্বাচনে ছোট বড় মিলিয়ে অন্তত ৯৮টি রাজনৈতিক দল অংশ নেয়। ৩৫টি রাজনৈতিক দল মাত্র একজন করে প্রার্থী দেয়। রেকর্ড ভেঙে এবার ৪ হাজার ৫১৫ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। একেকটি আসনে গড়ে ৭ জন করে প্রার্থী। ৩১৭টি আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী ৪৫৯ জন। যুক্তরাজ্যে এবারের সাধারণ নির্বাচনে বিভিন্ন দলের মনোনয়নে প্রার্থী হন বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক। এর বাইরে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন কেউ কেউ। সব মিলিয়ে অন্তত ৩৪ জন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। নিজের আসনে জয়ের পর কিয়ের স্টারমার বলেছেন, 'পরিবর্তনের সূচনা হলো এখান থেকেই... এটা আমাদের জন্য দেওয়ার সময়।' প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক ইতোমধ্যেই পরাজয় মেনে নিয়ে স্টারমারকে টেলিফোন করে অভিনন্দন জানিয়েছেন। এদিকে, যুক্তরাজ্যে জাতীয় নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয় পাওয়া লেবার পার্টির নেতা কিয়ের স্টারমারকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দিয়েছেন ব্রিটেনের রাষ্ট্রপ্রধান রাজা দ্বিতীয় চার্লস। কিয়ের স্টারমার শুক্রবার বাকিংহাম প্রাসাদে রাজার সঙ্গে দেখা করতে গেলে তিনি তাকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দেন। বাকিংহাম প্রাসাদের প্রকাশ করা একটি ছবিতে দেখা গেছে, রাজা চার্লস স্টারমারের সঙ্গে করমর্দন করছেন। এর আগে তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে কনজারভেটিভ পার্টির নেতা ঋষি সুনাকের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেন। আর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার প্রথম ভাষণে স্টারমার বলেছেন, জনগণ সুচিন্তিতভাবে পরিবর্তন এবং জনগণের সেবামূলক রাজনীতির জন্য ভোট দিয়েছেন। তবে এই পরিবর্তনের জন্য সময় লাগতে পারে জানিয়ে তিনি বলেন, কোনো দেশকে পরিবর্তন করা সুইচ টেপার মতো বিষয় নয়। এর জন্য সময় প্রয়োজন হবে। তবে পরিবর্তনের জন্য কাজ শুরু করা হবে। ইটের ওপর ইট তুলে দেশের অবকাঠামো পুনর্গঠনের প্রতিশ্রম্নতি দিয়েছেন স্টারমার। নতুন নতুন বিদ্যালয় ও ঘর নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে তিনি বলেন, 'আমার মতো খেটে খাওয়া পরিবারগুলো যাতে জীবন চালাতে পারে সেই ব্যবস্থা করতে হবে।' অভিনন্দন জানিয়ে শেখ হাসিনার চিঠি :এদিকে, ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ায় লেবার পার্টি নেতা কিয়ের স্টারমারকে অভিনন্দন জানিয়ে চিঠি পাঠিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শুক্রবার নবনির্বাচিত ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীকে ওই চিঠি পৌঁছে দেওয়ার কথা জানিয়েছে লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশন। চিঠিতে কিয়ের স্টারমারকে অভিনন্দন জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেছেন, 'আপনার যোগ্য নেতৃত্বে লেবার সরকারের সঙ্গে আমাদের দুই কমনওয়েলথ দেশের পারস্পরিক স্বার্থের আলোকে দীর্ঘ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, জলবায়ু এবং কৌশলগত অংশীদারত্বকে আরও শক্তিশালী করার প্রতীক্ষায় আছে আমার সরকার।' এদিকে, ভোটে 'পরিবর্তনের' ডাক দিয়ে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া লেবার পার্টির নেতা কিয়ের স্টারমারকে অভিনন্দন জানিয়ে একসঙ্গে কাজ করার বার্তা পাঠাচ্ছেন বিশ্ব নেতারা। কিয়ের স্টারমারের নেতৃত্বে লেবার পার্টির 'ঐতিহাসিক বিজয়ের' কথা তুলে চিঠিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, 'এই দ্ব্যর্থহীন ম্যান্ডেট আপনাদের দেশকে অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির নতুন উচ্চতায় নিতে এবং বিশ্বব্যাপী শান্তির প্রসারে আপনার নেতৃত্বের প্রতি ব্রিটিশ জনগণের বিশ্বাস ও আস্থার বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ করছে।' একইসঙ্গে একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে লেবার পার্টি এবং এ দলের প্রবাদপ্রতিম নেতা স্যার হ্যারল্ড উইলসন, টমাস উইলিয়ামস এবং লর্ড পিটার শোরের সঙ্গে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগের বন্ধুত্বের কথাও স্মরণ করেন শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগ সভাপতি, বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, সেই সম্পর্কের সূত্র ধরে গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সামগ্রিক ও প্রগতিশীল আকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতে দুই দেশের সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। অংশীদারত্বের পাশাপাশি দুই দেশের কল্যাণে বাংলাদেশ-বংশোদ্ভূত ব্রিটিশদের কাজে লাগানোর ইচ্ছার কথা তুলে ধরে চিঠিতে তিনি বলেন, 'সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, আমাদের দুই দেশের সর্বজনীন কল্যাণের জন্য সাত লাখের বেশি প্রাণবন্ত ও উদ্যোগী ব্রিটিশ-বাংলাদেশির অমূল্য অবদানকে কাজে লাগানো অব্যাহত রাখতে চাই।' ক্ষমা চেয়ে বিদায় নিলেন ঋষি সুনাক এদিকে, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেছেন রাজা তৃতীয় চার্লস। অন্যদিকে কনজারভেটিভ পার্টির প্রধানের পদ থেকেও সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন সদ্য সাবেক এই ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী। রাজা চার্লসের দপ্তর বাকিংহাম প্যালেস সুনাকের পদত্যাগপত্র গ্রহণের বিষয়টি নিশ্চিত করে এক বিবৃতিতে জানায়, শুক্রবার সকালে প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক রাজার শ্রোতা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। এ সময় তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পদত্যাগপত্র জমা দেন। মহামান্য রাজা তা সানন্দে গ্রহণ করেছেন। অন্যদিকে নিজের কার্যালয় ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটের বাইরে শুক্রবার সকালে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিজের পদত্যাগের কথা নিশ্চিত করে সুনাক বলেন, 'জনগণের প্রতি আমার প্রথম কথা, আমি দুঃখিত। সর্বোচ্চ চেষ্টা দিয়ে আমি আমার কাজ করেছি। কিন্তু আপনারা স্পষ্টভাবে যুক্তরাজ্যে সরকারের পরিবর্তন চেয়েছেন। আপনাদের এই রায়ের পর আর কোনো কথা হয় না।' কনজারভেটিভ পার্টির ঐতিহাসিক পরাজয়ের দায়ভার মাথায় নিয়ে সুনাক বলেন, 'আমি আপনাদের (ভোটারদের) ক্ষোভ, অসন্তোষের কথা শুনতে পেয়েছি। আমি এই পরাজয়ের দায়ভার গ্রহণ করছি।' পরাজয় মেনে নিয়ে জয়ী লেবার পার্টির নেতা কিয়ের স্টারমারকে অভিনন্দন জানিয়ে সুনাক বলেন, 'প্রধানমন্ত্রীর পদে তার সাফল্য আমাদের সবার সাফল্য বলে বিবেচিত হবে। আমি তার ও তার পরিবারের কল্যাণ কামনা করছি। নির্বাচনী প্রচারণায় আমাদের যা-ই মতবিরোধ হোক না কেন, তিনি একজন শালীন ও জনগণবান্ধব ব্যক্তি। আমি তাকে সম্মান করি।' নিজের অর্জনের কথা উলেস্নখ করে সুনাক বলেন, 'আমরা ইংল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লক্ষ্য অনুযায়ী মূল্যস্ফীতি ২ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে এনেছি। আন্তর্জাতিক পরিসরে যুক্তরাজ্যের সুনাম বাড়িয়েছি। এসব অর্জনের জন্য আমি গর্বিত। ২০ মাস আগের তুলনায় এই দেশ অনেক বেশি নিরাপদ ও শক্তিশালী।' এশীয় বংশোদ্ভূত যুক্তরাজ্যের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে সুনাক বলেন, 'যুক্তরাজ্য সম্পর্কে একটি বিস্ময়কর জিনিস হলো, আমার দাদি-দাদা সামান্য সহায়-সম্পত্তি নিয়ে এখানে আসার মাত্র দুই প্রজন্মের মধ্যে আমাদের (অভিবাসীর পরিচয়) গৌণ হয়ে পড়ে। আমি প্রধানমন্ত্রী হলাম। আমার দুই কিশোরী মেয়ে ডাউনিং স্ট্রিটে (হোলি উৎসবে) দীপাবলি জ্বালাল।' সমর্থন ও ত্যাগ স্বীকার করায় পরিবারকে ধন্যবাদ দিয়ে বক্তৃতা শেষ করেন সুনাক। এরপর স্ত্রী অক্ষতা মূর্তির হাত ধরে ডাউনিং স্ট্রিটে অপেক্ষায় থাকা একটি গাড়ির দিকে এগিয়ে যান ভারতীয় বংশোদ্ভূত যুক্তরাজ্যের প্রথম এই প্রধানমন্ত্রী। সুনাকের পূর্বসূরি লিস ট্রাসকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণের মাত্র ৪৫ দিনের মাথায় পদত্যাগ করতে হয়। এই পরিস্থিতিতে ২০২২ সালের অক্টোবরে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কনজারভেটিভ পার্টির নেতা হন ঋষি সুনাক। এরপর তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। রেকর্ডসংখ্যক মন্ত্রী পরাজিত এদিকে, যুক্তরাজ্যের সাধারণ নির্বাচনে রেকর্ডসংখ্যক মন্ত্রী পরাজিত হয়েছেন। নির্বাচনে ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টির ভরাডুবি হয়েছে। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে বিরোধী লেবার পার্টি। বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকের মন্ত্রিসভার অন্তত নয়জন সদস্য হেরেছেন। আগের রেকর্ডটি হয়েছিল ১৯৯৭ সালে। সে নির্বাচনে ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টির সরকারের সাতজন মন্ত্রী পরাজিত হয়েছিলেন। এবারের নির্বাচনে পরাজিত মন্ত্রীদের মধ্যে আছেন- প্রতিরক্ষামন্ত্রী গ্র্যান্ট শ্যাপস, কমন্স নেতা পেনি মর্ডান্ট, বিচারমন্ত্রী অ্যালেক্স চক, শিক্ষামন্ত্রী গিলিয়ান কিগান, সংস্কৃতিমন্ত্রী লুসি ফ্রেজার, বিজ্ঞানমন্ত্রী মিশেল ডোনেলান, প্রবীণবিষয়ক মন্ত্রী জনি মার্সার, ওয়েলসবিষয়ক মন্ত্রী ডেভিড টিসি ডেভিস, পরিবহণমন্ত্রী মার্ক হারপার।