নদ-নদীর পানি বাড়তে থাকায় উত্তরের কুড়িগ্রাম ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ফেনী জেলার বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। কুড়িগ্রামে তিনটি পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় পস্নাবিত হয়েছে সাতটি উপজেলার দেড় শতাধিক চর ও দ্বীপচর। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন অন্তত ৬০ হাজার মানুষ। ফেনীর মুহুরি, কহুয়া ও সিলোনীয়া নদীর পানি বিপৎসীমার নিচে প্রবাহিত হলেও ফুলগাজী ও পরশুরামে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। সিলোনিয়া নদীর বাঁধ ভেঙে পানি প্রবেশ করে নতুন নতুন এলাকা পস্নাবিত হয়েছে। বন্যায় দুই উপজেলার অন্তত চার হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে আছে। তলিয়ে গেছে ফসলি জমিসহ রাস্তাঘাট ও ঘরবাড়ি।
এদিকে যমুনা নদীর পানি সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে বিপৎসীমা অতিক্রম ১২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে চরাঞ্চলের নিম্নভূমি তলিয়ে গেছে। গাইবান্ধায় ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বিপৎসীমার ৬২ সেন্টিমিটার ও ঘাঘট নদীর পানি ১১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় নদী তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল পস্নাবিত হয়ে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন হাজারও মানুষ। রাঙামাটির বাঘাইছড়িতে বন্যার পানিতে ডুবে দুই শিক্ষার্থীর মৃতু্যর খবর পাওয়া গেছে। অন্যদিকে সিলেটে বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত আছে। তবে পানিবন্দি মানুষের ভোগান্তি বেড়েছে। সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর পানি ছয়টি পয়েন্টে বৃহস্পতিবারও বিপৎসীমার ওপর দিয়ে
প্রবাহিত হয়েছে। সিলেটের পাশাপাশি ভোগান্তি বেড়েছে সুনামগঞ্জের বন্যার্তদেরও।
বৃহস্পতিবার বিকালে পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, কুড়িগ্রামে ব্রহ্মপূত্রের পানি নুনখাওয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ৬৪ সেন্টিমিটার, চিলমারী পয়েন্টে ৬৯ সেন্টিমিটার ও হাতিয়া পয়েন্টে ৭৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তিস্তা নদীর কাউনিয়া পয়েন্টে, দুধকুমার নদীর পাটেশ্বরী পয়েন্টে এবং ধরলা নদীর শিমুলবাড়ী ও ধরলা ব্রিজ পয়েন্টে বন্যার পানি সামান্য হ্রাস পেয়ে বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো. নবেজ উদ্দিন সরকার জানিয়েছেন, জেলার ১০৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্যার পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। এর মধ্যে পাঠদান বন্ধ রয়েছে ৫০টি বিদ্যালয়ে। চলতি মৌসুমে নদী ভাঙনের শিকার হওয়ায় দুটি বিদ্যালয় অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এক হাজার ৪০০ হেক্টর জমির পাটসহ নিমজ্জিত হয়েছে প্রায় আড়াই হাজার হেক্টর জমির ফসল। বন্যায় সড়ক নিমজ্জিত হওয়ায় অনেক এলাকায় গ্রামীণ সড়ক ভেঙে গেছে। এতে যাতায়াতের ভোগান্তিতে পড়েছে চর এলাকার মানুষ। সংযোগ সড়ক ডুবে যাওয়ায় চিলমারী-রৌমারী ফেরি চলাচল বন্ধ রয়েছে।
অনেকেই নিজ বাড়িতে মাচা করে বা আঙিনায় নৌকা নিয়ে বসবাস করছে। কেউ কেউ গবাদি পশু নিয়ে চলে গেছে উঁচু স্থানে। বন্যাকবলিত এলাকায় বিশুদ্ধ পানি, শুকনো খাবার ও গো-খাদ্যের সংকট তীব্র হয়ে উঠছে।
কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রাকিবুল হাসান জানান, জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত ব্রহ্মপুত্রসহ অন্যান্য নদ-নদীর পানি আগামী ৪৮ ঘণ্টা আরও বৃদ্ধি অব্যাহত থাকতে পারে। ব্রহ্মপুত্রের পানি তিনটি পয়েন্টে বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অন্যান্য নদ-নদীর পানি বিপৎসীমার নিচে রয়েছে।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আব্দুল হাই সরকার জানান, এখন পর্যন্ত বানভাসিদের জন্য ৯ উপজেলায় ১৭৩ মেট্রিক টন চাল ও ১০ লাখ টাকা বিতরণের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। মজুত আছে ৬০০ মেট্রিক টন চাল ও ৩০ লাখ টাকা। যা পর্যায়ক্রমে বিতরণ করা হবে।
উজানের ঢলে গাইবান্ধায় ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, করতোয়া, ঘাঘটসহ সব নদ-নদীর পানি দ্রম্নত বৃদ্ধি পাচ্ছে। বৃহস্পতিবার বিকালে গাইবান্ধা পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় ৭০ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি ফুলছড়ি পয়েন্টে বিপৎসীমার ৭২ সেন্টিমিটার, ঘাঘট নদীর পানি ৯ সে.মি. বৃদ্ধি পেয়ে নতুন ব্রিজ এলাকায় বিপৎসীমার ২০ সে. মি. ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে তিস্তা ও করতোয়া নদীর পানি এখনো বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে নদীর তীরবর্তী এলাকার নিম্নাঞ্চল পস্নাবিত হয়ে হাজারও মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
পানি বৃদ্ধির কারণে গাইবান্ধা সদর, সুন্দরগঞ্জ, ফুলছড়ি ও সাঘাটা উপজেলার নদীবেষ্টিত চরাঞ্চলে বেশ কিছু এলাকা পস্নাবিত হচ্ছে। বিপৎসীমার ওপরে থাকায় ব্রহ্মপুত্র নদবেষ্টিত সদর উপজেলার মোলস্নারচর, কামারজানি, ঘাগোয়া, ফুলছড়ির ফজলুপুর, এরেন্ডাবাড়ি এলাকায় পস্নাবিত হতে শুরু করেছে। পানি বৃদ্ধির ফলে নিচু এলাকার ঘরবাড়িগুলোতে পানি উঠে পস্নাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। এসব এলাকার পানিবন্দি মানুষ গৃহপালিত পশু-পাখি নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ছেন। অন্যদিকে তিস্তার পানি আবারও বাড়তে থাকায় সুন্দরগঞ্জের হরিপুর, কাপাসিয়া, তারাপুরের এলাকা পস্নাবিত হতে শুরু করেছে।
গাইবান্ধা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী হাফিজুল হক বলেন, 'ভারী বর্ষণ ও উজনের ঢলে গাইবান্ধায় সব নদ-নদীর পানি বাড়ছে। তবে ব্রহ্মপুত্র ও ঘাঘট নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সব ধরনের ঝুঁকি মোকাবিলায় পানি উন্নয়ন বোর্ড প্রস্তুত রয়েছে।'
যমুনা নদীর পানি সিরাজগঞ্জ হার্ড পয়েন্টে বিপৎসীমা অতিক্রম করে ১২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তীরবর্তী অঞ্চলে শুরু হয়েছে তীব্র ভাঙন। চলতি মৌসুমে খুব বড় না হলেও মাঝারি আকারের বন্যার আশঙ্কা করছে সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)।
বৃহস্পতিবার দুপুরে সিরাজগঞ্জ হার্ড পয়েন্টে যমুনা নদীর পানি সমতল রেকর্ড করা হয়েছে ১৩ দশমিক ০২ মিটার। সকাল ৬টা থেকে ১২টা পর্যন্ত মাত্র ৬ ঘণ্টায় ১১ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ১২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে (বিপৎসীমা ১২ দশমিক ৯০ মিটার)। এই পয়েন্টে গত ৩০ ঘণ্টায় পানি বেড়েছে ৫৮ সেন্টিমিটার।
অন্যদিকে, কাজিপুর মেঘাই পয়েন্টে দুপুর ১২টায় পানি সমতল রেকর্ড করা হয়েছে ১৪ দশমিক ৭৪ মিটার। ৬ ঘণ্টায় এ পয়েন্টে ১৪ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপৎসীমার ৬ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে (বিপৎসীমা ১৪ দশমিক ৮০ মিটার)। সর্বশেষ ৩০ ঘণ্টায় এ পয়েন্টে পানি বেড়েছে ৬৪ সেন্টিমিটার।
পাউবো জানায়, যমুনার পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জেলার কাজিপুর উপজেলার খাসরাজবাড়ী, সদর উপজেলার কাওয়াকোলা ও শাহজাদপুর উপজেলার জালালপুর এবং কৈজুরীতে তীরবর্তী অঞ্চলগুলোতে তীব্র ভাঙন শুরু হয়েছে। গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে এসব অঞ্চলের দেড় শতাধিক বাড়িঘর ও স্থাপনা নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে বলে স্থানীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে।
সিরাজগঞ্জ পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাহবুবুর রহমান জানান, যমুনার পানি দ্রম্নতগতিতে বাড়ছে। ইতোমধ্যে বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে। আরও তিন থেকে চার দিন পানি বাড়বে। বড় ধরনের বন্যা না হলেও মাঝারি বন্যা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। জেলার ভাঙন কবলিত এলাকাগুলো বালিভর্তি ব্যাগ জিওটিউব ও জিওব্যাগ ডাম্পিং করে ভাঙন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হচ্ছে।
যমুনায় পানি বাড়ায় সারিয়াকান্দি উপজেলার চালুয়াবাড়ী, কাজলা, কর্নিবাড়ি, চন্দনবাইশা এবং বোহাইল ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল পস্নাবিত হয়েছে। ফলে এসব এলাকার কৃষকরা তাদের অপরিপক্ব পাট কেটে নিচ্ছেন।
বৃহস্পতিবার পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী হুমায়ুন কবির জানান, পানি বাড়ার কারণে উপজেলার চরগুলোর নিম্নাঞ্চল পস্নাবিত হয়েছে। কর্নিবাড়ি, কামালপুর, হাটশেরপুর, ফুলবাড়ি, চালুয়াবাড়ির চরাঞ্চলের নিচু জায়গা ইতোমধ্যে তলিয়ে গেছে।
তিনি আরও জানান, দীর্ঘ ৪৫ কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে এখনো কোনো ঝুঁকি দেখছি না। ছয়টি পয়েন্টে নদী ভাঙলেও সবচেয়ে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে ইছামারা অংশে। কারণ নদী থেকে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের দূরত্ব মাত্র ৩০০ মিটার। গত বছর সেখানে এক হাজার ৭০০ মিটার ভেঙে ছিল। সেখানে কাজ করা হয়েছে। যমুনার ভাঙনের যে গতি তাতে তীব্র ভাঙন শুরু হলে বাঁধ পর্যন্ত ঠেকে যেতে বেশি সময় লাগবে না।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. তৌহিদুর রহমান বলেন, 'প্রশাসনের সজাগ দৃষ্টি রয়েছে বন্যা পরিস্থিতির ওপর। বন্যার্তদের মধ্যে শুকনা খাবার বিতরণ করা হচ্ছে।'
এছাড়া যমুনা নদীর পানি জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জের বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ৬৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বন্যায় উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়নের অন্তত ১০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। উপজেলার কয়েকশ' পরিবার বন্যা আশ্রয় কেন্দ্রে ও বিভিন্ন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আশ্রয় নিয়েছে। দেওয়ানগঞ্জ উপজেলা পরিষদ চত্বরে বন্যায় হাঁটু পানি হওয়ায় চরম দুর্ভোগে রয়েছেন বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তা, কর্মচারী ও সেবা প্রত্যাশিরা।
বন্যার পানির প্রবল স্রোতে চিকাজানি ইউনিয়নের খোলাবাড়ি থেকে দেওয়ানগঞ্জ মন্ডল বাজার রাস্তা ও হাতিভাঙা ইউনিয়নের মহারানী রাস্তা ভেঙে উপজেলা সদরের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে। বন্যায় পস্নাবিত হওয়ায় উপজেলার ১৫টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠদান বন্ধ রয়েছে।
এদিকে, বৃষ্টি না হওয়ায় সুনামগঞ্জের তাহিরপুরে কমতে শুরু করেছে নদ-নদী ও হাওড়ের পানি। পাহাড়ি নদী যাদুকাটা দিয়ে ঢলের পানি না নামায় কিছুটা স্বস্তি ফিরছে বন্যা আক্রান্তদের মধ্যে। আশ্রয়কেন্দ্রে ওঠা অনেকেই বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন। তবে সড়কগুলোতে এখনো যোগাযোগ স্বাভাবিক হয়নি
তাহিরপুর সদর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান জুনাব আলী বলেন, 'পানি কিছুটা কমেছে, তবে ভারী বৃষ্টি হলে আবারও বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে।'
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন হাওলাদার জানান, মেঘালয়সহ সুনামগঞ্জে বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় নদ-নদীর পানি কিছুটা কমেছে। বৃষ্টির পূর্বাভাস আছে তবে পাহাড়ি ঢল না নামলে বন্যা হওয়ার তেমন আশংকা নেই।
জামালপুরের ইসলামপুরে যমুনা নদীর পানি বাহাদুরাবাদ ঘাট পয়েন্টে ৬১ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ৫৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে উপজেলার ৮টি ইউনিয়নের কুলকান্দি, বেলগাছা, চিনাডুলী, সাপধরী, নোয়ারপাড়া, ইসলামপুর সদর, পার্থশী ও পলবান্ধাসহ ৪০টি গ্রামের নিম্নাঞ্চলে পস্নাবিত হয়ে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। হুমকিতে রয়েছে নোয়ারপাড়া ইউনিয়নের হাড়গিলা বাঁধসহ কয়েকটি গ্রামের বাড়িঘর, ফসলি জমি, রাস্তাঘাট ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
নেত্রকোনার বারহাট্টা উপজেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। উপজেলার আসমা, চিরাম, রায়পুর ও সিংধা ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চলের শত শত বাড়িঘরে ঢুকে পড়েছে বানের পানি। ছোট ছোট অসংখ্য রাস্তা তলিয়ে গেছে। ডুবু ডুবু করছে উপজেলার অন্যান্য চার ইউনিয়নের সহস্রাধিক বাড়িঘর, পুকুর ও রাস্তাঘাট। পুকুর ডুবে ভেসে গেছে লাখ লাখ টাকার মাছ। উপজেলার প্রায় ২০ হাজার মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় আছেন।
এদিকে মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। উপজেলার পাহাড়ি এলাকায় টিলা ধস দেখা দেওয়ায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে সতর্কতা জারি করা হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন লাখো মানুষের পাশাপাশি গবাদি পশুও।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. খোরশেদ আলম বলেন, 'জেলার ৯৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পানি ঢুকেছে। আর আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে চালু আছে ৬৪টি। সেগুলোতে পানি প্রবেশ করেনি।'
পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) উপসহকারী প্রকৌশলী জসিম উদ্দিন জানান, জুড়ী নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এভাবে অবিরত বৃষ্টির হলে পানি আরো বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
জেলা প্রশাসক উর্মি বিনতে সালাম জানান, বৃষ্টি অব্যাহত থাকায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। বাঁধ উপচে নদ-নদীর পানি লোকালয়ে ঢুকছে। নতুন নতুন এলাকা পস্নাবিত হচ্ছে। এখন পর্যন্ত পানিবন্দি অবস্থায় আছেন তিন লাখ তিন হাজার ৩২৭ জন।
এদিকে, সিলেটে বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত আছে। তবে পানিবন্দি মানুষের ভোগান্তি বেড়েছে। জেলার ওপর দিয়ে বয়ে চলা সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর ছয়টি পয়েন্টে বৃহস্পতিবারও বিপৎসীমার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছিল।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, বন্যায় সিলেটের ১৩টি উপজেলার বিভিন্ন এলাকা পস্নাবিত হয়েছে; বিশেষ করে ভারত সীমান্তবর্তী উপজেলাগুলোয় দেশটির সঙ্গে যুক্ত নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। এর মধ্যে সিলেটের জকিগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, কানাইঘাট, জৈন্তাপুর ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় ভারত থেকে নেমে আসা ঢলের পানি প্রথমেই আঘাত হানে। সীমান্তবর্তী উপজেলাগুলোর মধ্যে জকিগঞ্জ উপজেলায় কুশিয়ারা নদীর পানি বাঁধ উপচে ও বিভিন্ন স্থানে ভেঙে গিয়ে কয়েকটি গ্রাম পস্নাবিত হয়েছে।
এদিকে আজ শুক্রবার পর্যন্ত সিলেট বিভাগে মাঝারি ধরনের ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টির পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতির আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
অন্যদিকে, রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলায় বন্যার পানিতে পড়ে দুই শিক্ষার্থীর মৃতু্যর খবর পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে মধ্যে একজনের মরদেহ বাঘাইছড়ি গ্রাম সংলগ্ন নারিকেল বাগান এলাকা থেকে বৃহস্পতিবার ভোর সাড়ে ৫টায় উদ্ধার করা হয়। অন্যজনের মরদেহ বুধবার বিকালে বাঘাইছড়ি উপজেলার বঙ্গলতলী ইউনিয়নের বালুখালী গ্রাম থেকে উদ্ধার হয়।
মৃতরা হলো- পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের মিল্টন চাকমার ছেলে বাঘাইছড়ি উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র কৃতিত্ব চাকমা (১৩) এবং বালুখালী গ্রামের মহিমী কুমার ও জোৎস্না আলো চাকমার মেয়ে বিটি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সোহামনি চাকমা (১১)।
পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মিঠেল চাকমা বলেন, 'মঙ্গলবার বিকালে বাঘাইছড়ি গ্রাম সংলগ্ন নারিকেল বাগান এলাকায় রাস্তার ওপর সহপাঠীদের সঙ্গে খেলা করছিল কৃতিত্ব চাকমা। এ সময় বন্যার পানির স্রোতে নিখোঁজ হয় সে।'
এর আগে বুধবার বিকালে বাঘাইছড়ি উপজেলার বঙ্গলতলী ইউনিয়নের বালুখালী গ্রামে সোহামনি চাকমা বন্যার পানিতে ডুবে যায়।
বঙ্গলতলী ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত নারী আসনের সদস্য শেফালী চাকমা বলেন, 'বাড়ির পাশে বিলে খেলতে গিয়ে বন্যার পানিতে ডুবে যাওয়া বেশ কিছু সময় পর মৃত অবস্থায় ভেসে ওঠে সোহামনির লাশ।'
বাঘাইছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শিরীন আক্তার বলেন, 'হঠাৎ বন্যার কারণে বাবা-মায়েরা ঘর গোছানোর কাজে নিজেদের ব্যস্ত রাখতে গিয়ে পরিবারের বাচ্চাদের খেয়াল রাখতে না পারার কারণেই হয়তো এমন ঘটনা ঘটছে। আমরা স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে বন্যার সময় শিশুদের ব্যাপারে সচেতন থাকার আহ্বান জানাচ্ছি।'
# প্রতিবেদন তৈরিতে কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, সারিয়াকান্দি (বগুড়া), তাহিরপুর (সুনামগঞ্জ), ইসলামপুর (জামালপুর), বকশীগঞ্জ (জামালপুর), জুড়ী (মৌলভীবাজার) ও বারহাট্টা (নেত্রকোনা) প্রতিনিধির পাঠানো তথ্য নেওয়া হয়েছে।