মৌসুমি বায়ু সক্রিয় হওয়ায় সারাদেশে সপ্তাহ ধরে ভারী বৃষ্টিপাত হচ্ছে এবং বর্ষার দুই মাস আষাঢ়-শ্রাবণে দেশজুড়ে থেমে থেমে মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টি হতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনে বৃষ্টির বাড়াবাড়ি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন মানুষ। এর প্রভাব পড়েছে জীবন ও প্রকৃতিতে। মৌসুমি বায়ু সক্রিয় হওয়ায় এবং সাগরে সৃষ্ট লঘুচাপের প্রভাবে টানা বর্ষণে পাহাড় ধসের শঙ্কা দেখা দিয়েছে। অন্যদিকে 'লা নিনা' বর্ষার শুরুতেই সক্রিয় হওয়ায় এবার বৃষ্টি রেকর্ড ভাঙতে পারে।
সম্প্রতি ভারতে পুনে শহরে একটি আবহাওয়া বিষয়ক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে দক্ষিণ এশিয়ার আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা অংশ নেন। সম্মেলনে আবহাওয়াবিদরা বলেন, এবার বর্ষায় বাংলাদেশে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বৃষ্টি হতে পারে। এ ছাড়া বাংলাদেশের উজানে ভারতের রাজ্যগুলোতেও বৃষ্টি বেশি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে বর্ষায় বাংলাদেশে বন্যা পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কা ও বৃষ্টির রেকর্ড ভাঙার কথা বলা হয়। সাউথ এশিয়ান ক্লাইমেট আউটলুক ফোরামের ২৮তম এ অধিবেশন বর্ষা মৌসুমে আবহাওয়া পরিস্থিতি কী দাঁড়াতে পারে, তা নিয়ে একটি বিবৃতি প্রচার করা হয়। সেখানে এসব তথ্য ওঠে এসেছে।
আবহাওয়া বিশেষজ্ঞ ড. শমিরণ
দেওয়ান বলেন, তাপপ্রবাহ বৃদ্ধির জন্য এল নিনো নামে আবহাওয়ার এক বিশেষ অবস্থা দায়ী। এর উল্টো অবস্থা হলো লা নিনা। এটি তৈরির সময় বাতাসে জলীয় বাষ্প বেড়ে গিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে বৃষ্টি বেড়ে যায়। বর্ষার শুরুই লা নিনা সক্রিয় হয়ে ওঠে। এতে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার বেশিরভাগ দেশে এবার বর্ষা শক্তিশালী হয়ে উঠছে। বাংলাদেশের তাপপ্রবাহের এলাকাগুলোতে এবার বৃষ্টিও বেশি হবে। বাংলাদেশের উজানে ভারতের পূর্বাঞ্চলের আসাম, মেঘালয়, পশ্চিমবঙ্গসহ কয়েকটি রাজ্যেও বৃষ্টি রেকর্ড ভাঙতে পারে বলে জানান আবহাওয়াবিদরা। ওই বৃষ্টির পানি বাংলাদেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়বে। ফলে দেশের উত্তরাঞ্চলসহ মধ্যাঞ্চলে প্রতি বছর যে বন্যা হয়, তা এবার আরও ব্যাপক রূপ নিতে পারে। এদিকে বাংলাদেশ সরকারের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র থেকে জুলাই মাসে মাঝারি মানের একাধিক বন্যার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
চলতি বছরের আগস্ট মাসে বৃষ্টির প্রভাবে দেশে বন্যার আশঙ্কা রয়েছে জানিয়ে সংশ্লিষ্ট সবাইকে আগাম প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বৃষ্টির কারণে জুন আর জুলাই মাসে কোনো প্রকল্প না নেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
অন্যদিকে, উত্তর বঙ্গোপসাগর এবং তৎসংলগ্ন উপকূলীয় এলাকায় মৌসুমি বায়ু প্রবল অবস্থায় থাকায়, মেঘমালা তৈরি অব্যাহত থাকায় দেশের চার সমুদ্রবন্দরে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্কতা সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছ। একইসঙ্গে ১৯ অঞ্চলে তীব্র ঝড়-বৃষ্টির পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। ফেনীতে ভারী বৃষ্টিপাত ও ভারতের উজানের পানিতে মুহুরী নদীর পানি বিপৎসীমার ১৩০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের চারটি স্থান ভেঙে জেলার ফুলগাজী ও পরশুরাম উপজেলার ১০টি গ্রাম পস্নাবিত হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রাশেদ চৌধুরী বলেন, এ বছর লা নিনা সক্রিয় হওয়ায় অতিবৃষ্টিতে পাহাড় ধস ও বন্যা হতে পারে। ১৯৯৮ সালে লা নিনার প্রভাবে বড় বন্যা হয়।
আবহাওয়া অফিসের সূত্রে জানা যায়, ২০২২ সালে বাংলাদেশে চার দশকেরও বেশি সময়ের মধ্যে সবচেয়ে কম বৃষ্টি হয়। ২০২৩ সালের অক্টোবরে গত ২২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাতের রেকর্ড হয়। ৬ অক্টোবর কিশোরগঞ্জের নিকলিতে এই বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়।
আবহাওয়াবিদ মো. বজলুর রশিদ জানান, নিকলিতে বৃষ্টিপাত হয় ৪৭৬ মিলিমিটার। এর আগে, ২০০১ সালে সন্দ্বীপে ২৪ ঘণ্টায় ৫৯০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছিল। ২০২১ সালের কার্তিকের বৃষ্টি যেন আষাঢ়-শ্রাবণের বৃষ্টিকেও হার মানায়। ২০২০ সালের অসময়ের বৃষ্টি ১০০ বছরের রেকর্ড ভেঙেছিল। রংপুরে মাত্র ১৪ ঘণ্টায় ৪৩৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়। ২০১৭ সালের শুরুতে অতিবৃষ্টিতে উজান থেকে নেমে আসা আগাম ঢলে হাওড়ের ধান তলিয়ে যায়। ওই বছর ব্রহ্মপুত্র নদের উজানে ১০০ বছরের রেকর্ড ভেঙে বেশি বৃষ্টি হয়। ওই পানি উজানের এলাকা বাংলাদেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চল দিয়ে বঙ্গোপসাগরে যাওয়ার সময় দেশের প্রায় ৮০ লাখ মানুষের ক্ষতি করে। এতে আগাম বন্যায় আঘাত হানে শস্যভান্ডারখ্যাত দেশের হাওড়াঞ্চলে। অসময়ের বন্যায় হাওড়ের ফসলহানি হয়।
২০১৮ সালের অক্টোবরেও ব্যাপক বৃষ্টি হয়। ওই বছর পাহাড়ে ৪০০ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টিপাত হয়। ২০১৯ সালের ফেব্রম্নয়ারি মাসের বৃষ্টি আগের ৫২ বছরের রেকর্ড ভেঙে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে।
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আবহাওয়ার বৈরী আচরণে বৃষ্টিপাতের ধরন পাল্টে গেছে। এতে দেখা যায়, প্রতি বছর বৃষ্টিপাত টেকনাফে ৩৬ শতাংশ, কক্সবাজারে ২২ এবং পটুয়াখালী ও বরগুনায় ১৫ ও ১০ শতাংশ হারে বাড়ছে। অন্যদিকে ভোলা ও খুলনা-বাগেরহাট এবং সাতক্ষীরায় বৃষ্টিপাত ২০ শতাংশ করে কমে যাচ্ছে। গবেষণায় আরও দেখা যায়, গত ৩০ বছরে দেশের চট্টগ্রাম বিভাগে বৃষ্টিপাত অব্যাহতভাবে বাড়ছে। বিশেষ করে সেখানে বর্ষাকালে বৃষ্টিপাত স্বাভাবিকের চেয়ে ১০ শতাংশ বাড়ছে। অতিবৃষ্টির কারণে পার্বত্য এলাকায় পাহাড় ধস হচ্ছে। অন্যদিকে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বৃষ্টিপাত কমে যাওয়ায় লবণাক্ততা বাড়ছে। এতে ফসল উৎপাদন বিপর্যস্ত হচ্ছে। জলবায়ুর প্রভাবে বৃষ্টিপাতের ধরন পাল্টে যাওয়ায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হচ্ছেন কৃষক। হেমন্তের বৃষ্টি অস্বাভাবিক এবং কৃষির জন্য ক্ষতিকর।
জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ড. সামিউল আলম বলেন, জলবায়ুর প্রভাবে বৃষ্টিপাতের ধরন পাল্টে যাওয়ায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হচ্ছেন দেশের কৃষক। সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, হবিগঞ্জসহ হাওড়াঞ্চলের মানুষ বছরের পর বছর ধরে দেখে আসছেন, এপ্রিলের শেষ কিংবা মে মাসের শুরুতে আগাম বন্যা ও পাহাড়ি ঢল নামে।
বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা ও জাতিসংঘের আন্তঃসরকার জলবায়ু পরিবর্তন-সংক্রান্ত প্যানেল (আইপিসিসি) বলছে, শিল্পোন্নত দেশগুলোর বিপুল কার্বন নিঃসরণের ফলে বৈরী হয়ে উঠছে আবহাওয়া। বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের নির্মমতার শিকার বাংলাদেশ। জলবায়ুর প্রভাবে দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাড়ছে। সেই সঙ্গে দিনের পর দিন বাড়ছে আবহাওয়ার খামখেয়ালি আচরণ। অসময়ে বৃষ্টির মাত্রা বেড়ে যাওয়ার মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের স্পষ্ট ইঙ্গিত আছে বলে বলছেন বিজ্ঞানীরা।
বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার তথ্যে, প্রতি বছর এক হাজার মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে। বৃষ্টিপাত বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় বাংলাদেশ, ভারত ও চীনের ১৩ কোটি ৭০ লাখেরও বেশি মানুষ ঝুঁকিতে পড়েছে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত ওই গবেষণায় এসব তথ্য উঠে আসে।
বেলজিয়ামের ইউনিভার্সিটি ক্যাথলিক দ্য লোভেনের তথ্য অনুসারে, ১৯৫০ সাল থেকে এ পর্যন্ত প্রবল বৃষ্টিপাত ও বন্যায় ২২ লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন দক্ষিণ এশিয়ার।
অতিবৃষ্টির কারণে চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, কক্সবাজার ও সিলেটে পাহাড়ধসের আশঙ্কা রয়েছে। এ ছাড়াও দেশের বিভিন্ন পাহাড়ি এলাকায় পাহাড় ধসের সতর্কতা দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। রাঙামাটি সদরে ৫ হাজার পরিবারের মানুষ পাহাড় ধসের ঝুঁকিতে বসবাস করছেন বলে জানিয়েছে জেলা প্রশাসন। সোমবার দুপুরে রুমা-বান্দরবান সড়কের দলিয়ানপাড়া এবং খুমীপাড়ায় মাটি ধসে সড়কের ওপর জমে থাকায় এ সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
সম্প্রতি কক্সবাজার, খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটিতে পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটেছে। এতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে সড়ক, রেললাইন ও বাড়িঘরের। ২০১৭ সালের ১৩ জুন রাঙামাটিতে পাহাড়ধসে ৫ সেনা সদস্যসহ ১২০ জনের প্রাণহানির পরবর্তী ২০১৮ সালের জুনে জেলার নানিয়ারচর উপজেলায় পাহাড়ধসে ২ শিশুসহ ১১ জন এবং ২০১৯ সালের জুনে জেলার কাপ্তাইয়ে তিনজনের প্রাণহানি ঘটে। গত ১৫ বছরে চট্টগ্রাম মহানগর এবং আশপাশের এলাকায় পাহাড় ধসে ২৪৮ জনের মৃতু্য হয়েছে। এসব দুর্ঘটনায় প্রাণহানির পাশাপাশি আহতও হয়েছেন অনেকে।
বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা ও জাতিসংঘের আন্তঃসরকার জলবায়ু পরিবর্তন-সংক্রান্ত প্যানেল (আইপিসিসি) বলছে, শিল্পোন্নত দেশগুলোর বিপুল কার্বন নিঃসরণের ফলে বৈরী হয়ে উঠছে আবহাওয়া। বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের নির্মমতার শিকার বাংলাদেশ। জলবায়ুর প্রভাবে পার্বত্য জেলাগুলোতে শুষ্ক মৌসুমে তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। ফলে অধিক তাপে সেখানকার মাটির বুনন আলগা হয়ে যাচ্ছে। আবার বর্ষায় বৃষ্টি বৃদ্ধি পেয়ে সেখানে পাহাড়ধস বাড়ছে। এছাড়া অপরিকল্পিত উন্নয়নও পাহাড়ধসকে ত্বরান্বিত করছে।