জোড়াতালি দিয়েই গ্যাস সরবরাহ

তিতাসের ৭০% পাইপলাইনের মেয়াদ শেষ ৩০ বছর আগে বিভিন্ন সংস্থার নির্মাণ প্রকল্পের কারণে এসব লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সংস্কার প্রকল্পে বাধা অপর্যাপ্ত বাজেট ও নগরায়ণ

প্রকাশ | ০৪ জুলাই ২০২৪, ০০:০০

রেজা মাহমুদ
জোড়াতালি দিয়ে চলছে দেশের সর্ববৃহৎ প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির সরবরাহ কার্যক্রম। সংস্থাটির তথ্যমতে, তাদের ৭০ শতাংশ সরবরাহ লাইনের মেয়াদ শেষ হয়েছে আরও ৩০ বছর আগে। বাজেট সংকটসহ নানা জটিলতা এসব লাইন পুনঃস্থাপন করতে পারছেন না তারা। যদিও বিভিন্ন সময় পাইপলাইনের লিকেজ মেরামত করা হচ্ছে; কিন্তু তা পর্যাপ্ত নয়। তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ বলছে, কিছু লাইনের অবস্থা এতটাই খারাপ যে, গ্যাসের চাপ বাড়লেই খালি চোখের পাইপলাইনের লিকেজ টের পাওয়া যায়। বিশেষ করে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ এবং গাজীপুরের মতো ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় বিভিন্ন লাইনে উপরস্থলের লিকেজের কারণে বুদবুদ তৈরি হয়, যা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। তিতাস বলছে, এসব লিকেজ বেশিরভাগই তৈরি হয়েছে বিভিন্ন নির্মাণ প্রকল্পের কর্তৃপক্ষের অবহেলার কারণে তাদের অসতর্কতায় পাইপলাইনগুলো আরও ক্ষতিগ্রস্ত ও দুর্বল হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে বিভিন্ন সেবা সংস্থার নির্মাণ কার্যক্রম যেমন- বিদু্যৎ, পানি, ইন্টারনেট এবং রাজধানীতে বড় বড় নির্মাণ প্রকল্প পুরনো লাইনের ক্ষতি বাড়িয়ে সেগুলোকে আরও বিপজ্জনক করে তুলছে। এর ফলে কমানো যাচ্ছে না সিস্টেম লসের হার। জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলেন, আন্তর্জাতিকভাবে গ্যাস বিতরণে ২ শতাংশের বেশি সিস্টেম লস অগ্রহণযোগ্য। তবে পেট্রোবাংলার হিসাবে তিতাস গ্যাসের সিস্টেম লসের হার ১০ শতাংশ। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, প্রকৃত সিস্টেম লস ১৪ শতাংশের বেশি হবে। অন্যদিকে তিতাস গ্যাসের দাবি, পুরনো এবং ত্রম্নটিপূর্ণ গ্যাসলাইন এই সিস্টেম লসের অন্তত ৪-৫ শতাংশের জন্য দায়ী। মেয়াদোত্তীর্ণ পাইপলাইন : তিতাস গ্যাসের তথ্যানুযায়ী দেশের প্রথম গ্যাস বিতরণ কোম্পানি হিসেবে ১৯৬৪ থেকে ১৯৬৮ সালের মধ্যে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, নরসিংদী এবং ময়মনসিংহে সঞ্চালন ও সরবরাহ লাইন নেটওয়ার্ক নির্মাণ করা হয়। এসব পাইপলাইনের মেয়াদ ধরা হয় ২৫-৩০ বছর। সেই হিসাবে আরও ৩০ বছর আগে শেষ হয়েছে মেয়াদ। যদিও তিতাস কর্তৃপক্ষ বেশ কয়েকবার মেয়াদ শেষ হওয়া পাইপলাইন সংস্কারে উদ্যোগ নিয়েছে; কিন্তু নগরায়ণ বিশেষ করে ঢাকা ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকা ঘনবসতিপূর্ণ থাকায় নতুন করে সরবরাহ লাইন স্থাপন করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। ফলে তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে মেয়াদ উত্তীর্ণ লাইনের মাধ্যমে গ্যাস বিতরণ করে আসছে তিতাস গ্যাস। তিতাস গ্যাসের তথ্যানুযায়ী, ২০২৩ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত প্রায় ১৩ হাজার ৩৯১ কিলোমিটার পাইপলাইনের মাধ্যমে ২৮ লাখ ৭৮ হাজার ৭৫৭ গ্রাহককে গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। এর মধ্যে ২৮ লাখ ৫৩ হাজার ৫৩টি আবাসিক সংযোগ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে, তিতাস গ্যাস ঢাকায় ১ হাজার ৬৮২ কিলোমিটার পাইপলাইন জরিপ করেছে এবং ৪৫৯টি লিকসহ ৯ হাজার ৯২৬টি গ্যাস উৎস (মিথেন) চিহ্নিত করেছে, যা তারা পরবর্তীতে মেরামত করেছে। গ্যাসলাইন লিক, আগুনসহ ঘটছে বিস্ফোরণ ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ এবং গাজীপুর শিল্প এলাকায় অগ্নিকান্ড ও বিস্ফোরণের তদন্তকারী ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের একাধিক প্রতিবেদনে প্রায়ই গ্যাসলাইন লিকেজকে দায়ী করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের দাবি মেয়াদোত্তীর্ণ গ্যাসলাইন, অননুমোদিত ট্যাপিংয়ের কারণে এসব দুর্ঘটনার জন্য দায়ী। তবে তিতাস গ্যাস ২০২২ সালে ১ হাজার ৬২২টি পাইপলাইন লিক চিহ্নিত করে মেরামত করে। এর পরেও ২০২৩ সালে তিতাসের জরুরি নিয়ন্ত্রণ কক্ষে ৬ হাজার ৮৬২টি অভিযোগ পাওয়া গেছে, যার মধ্যে ৪ হাজার ৮৯১টি পাইপলাইন লিকেজ এবং ৩১১টি অগ্নিকান্ডের ঘটনা রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে বাড্ডা, রামপুরা, বনশ্রী, বেইলি রোড, মতিঝিল, আরামবাগ, হাজারীবাগ, মহাখালী, পূর্ব রাজাবাজার এবং ক্রিসেন্ট রোডের মতো এলাকার বাসিন্দারা প্রায়ই তীব্র গ্যাসের গন্ধ শনাক্ত করে, যা আতঙ্কের সৃষ্টি করে। মেরামতে বাজেট অপর্যাপ্ত গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেডের (জিটিসিএল) সাবেক পরিচালক খন্দকার আবদুস সালেক বলেন, তিতাস গ্যাসের ডিস্ট্রিবিউশন বেশ কিছু লাইনের অবস্থা এমন যে সেগুলো আর মেরামত করা সম্ভব হয় না, প্রয়োজন বদলানো। এছাড়াও বিতরণ লাইনের জন্য ডিজিটাল ম্যাপিংয়ের অভাব রয়েছে। তাই বিভিন্ন সেবা সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের বড় নির্মাণ প্রকল্পের খননের সময় তারা সতর্কতা অবলম্বন করতে পারে না। এদিকে কেন নতুন পাইপলাইন নির্মাণ করা হচ্ছে না- এর জবাবে তিতাস গ্যাসের এমডি হারুনুর রশীদ বলেন, এই বিশাল সরবরাহ নেটওয়ার্ক পুনরায় স্থাপনের জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন, যা তাদের বাজেটে নেই। তবে এ সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চলছে বলেও জানান তিনি।