নতুন শিক্ষাক্রমে স্কুলে স্কুলে শিক্ষার্থী মূল্যায়ন শুরু
প্রকাশ | ০৪ জুলাই ২০২৪, ০০:০০
যাযাদি রিপোর্ট
নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী, নতুন নিয়মে হচ্ছে মাধ্যমিকে ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন কাজ। বুধবার থেকে সারাদেশেই মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে শুরু হয়েছে ষান্মাসিক মূল্যায়ন বা প্রচলিত অর্থে অর্ধ-বার্ষিক পরীক্ষা।
কেন্দ্রীয়ভাবে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) তৈরি করা শিক্ষার্থী নির্দেশিকা বা প্রশ্নের ভিত্তিতে হচ্ছে এ মূল্যায়ন কার্যক্রম। বিষয় ও শ্রেণিভেদে চার থেকে সর্বোচ্চ পাঁচ ঘণ্টায় হচ্ছে এ মূল্যায়ন। যেমন, অষ্টম ও নবম শ্রেণির জন্য পাঁচ ঘণ্টা এবং ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির জন্য চার ঘণ্টায় হচ্ছে মূল্যায়ন। সময়সূচি অনুযায়ী নির্ধারিত দিনে একটি বিষয়ের মূল্যায়ন হবে। মূল্যায়ন হবে সপ্তাহের প্রতিদিন। তবে গ্যাপ দিয়ে এ মূল্যায়নের সময়সূচি নির্ধারণ করা হয়েছে। ফলে সব মিলিয়ে মাসব্যাপী চলবে মূল্যায়ন কার্যক্রম।
এবার হাতে-কলমে কাজ এবং কার্যক্রমভিত্তিক লিখিত অংশের ভিত্তিতে হচ্ছে মূল্যায়ন। প্রশ্নের ধরন একেবারে ভিন্ন। যেমন, বাংলা বিষয়ের মূল্যায়নে হয়তো একটি অনুষ্ঠান কীভাবে আয়োজন করতে হবে, তাতে শিক্ষার্থীরা কীভাবে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করবে ইত্যাদি জানতে চাওয়া হতে পারে। শিক্ষার্থীদের জোড়ায় আলোচনা করে এর ভিত্তিতে নিজ নিজ উত্তরপত্রে লিখতে হচ্ছে। আছে দলগত কাজও। ওই অনুষ্ঠান আয়োজন ঘিরে ব্যানার, আমন্ত্রণ, পোস্টার ইত্যাদির নমুনা তৈরির বিষয়ও আছে।
নতুন নিয়ম হওয়ায় এবার এনসিটিবি থেকে মূল্যায়নে শিক্ষার্থী নির্দেশিকা বা প্রশ্ন তৈরি করে তা পরীক্ষার আগের দিন প্রতিষ্ঠানপ্রধানের কাছে অনলাইনে পাঠানো হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানপ্রধানরা প্রশ্নপত্র ডাউনলোডের পর ফটোকপি করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সরবরাহের ব্যবস্থা করছেন। এ ব্যবস্থায় পরীক্ষার নির্ধারিত সময়ের আগে কোথাও কোথাও নির্দেশিকা বের হওয়ার আশঙ্কা আছে।
এই মূল্যায়নে প্রশ্ন বা শিক্ষার্থী নির্দেশিকা একেবারে ভিন্ন। এতে একেকজন শিক্ষার্থীর অভিজ্ঞতা একেকরকম হবে। মুখস্থ করে লেখার সুযোগ নেই। উত্তরপত্র দেখেই ধারণা করা যাবে, এটি শিক্ষার্থী নিজে থেকে লিখেছে, নাকি অন্য কোনো উপায়ে লিখেছে।
এ প্রসঙ্গে সিদ্ধেশ্বরী গার্লস
স্কুলের প্রধান শিক্ষক মোলস্না মোহাম্মদ শাহাবুদ্ধিন বলেন, এই মূল্যায়নে প্রশ্ন বা শিক্ষার্থী নির্দেশিকা একেবারে ভিন্ন। এতে একেকজন শিক্ষার্থীর অভিজ্ঞতা একেক রকম হবে। মুখস্ত করে লেখার সুযোগ নেই। উত্তরপত্র দেখেই ধারণা করা যাবে, এটি শিক্ষার্থী নিজে থেকে লিখেছে, নাকি অন্য কোনো উপায়ে লিখেছে।
এনসিটিবির ভাষ্য, নতুন হওয়ায় শিক্ষকরা এখনো এ কাঠামোর প্রশ্নপত্রে অভ্যস্ত নন। তাই এখন কেন্দ্রীয়ভাবে প্রশ্ন তৈরি করে দেওয়া হচ্ছে। পরে বিদ্যালয়গুলো নিজেরাই কাঠামো অনুযায়ী প্রশ্নপত্র তৈরি করবে। এবারের এই সামষ্টিক মূল্যায়ন পর্যালোচনা করে প্রতিষ্ঠানভিত্তিক ধারাবাহিক ও সামষ্টিক মূল্যায়ন চূড়ান্ত হবে।
এদিকে, নতুন শিক্ষাক্রমে একজন শিক্ষার্থীর মূল্যায়ন পদ্ধতি চূড়ান্ত করা হয়েছে, যেখানে গ্রেড পয়েন্টের বদলে পারদর্শিতা অনুযায়ী সাতটি স্কেল বা সূচকে মূল্যায়ন ফল প্রকাশ করা হবে।
নতুন কাঠামো অনুযায়ী, মূল্যায়নের ক্ষেত্রে লিখিত অংশের 'ওয়েটেজ' হবে ৬৫ শতাংশ এবং কার্যক্রমভিত্তিক অংশের 'ওয়েটেজ' হবে ৩৫ শতাংশ।
শিক্ষার্থীদের শিখনকালীন মূল্যায়ন ও পাবলিক পরীক্ষার মূল্যায়নের ফলাফল আলাদাভাবে ফলাফল পত্রে (রিপোর্ট কার্ড) লেখা থাকবে।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান (রুটিন দায়িত্ব) অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান নতুন মূল্যায়ন কাঠামোর বিষয়ে বলেন, 'একটি বিষয়ের মূল্যায়নের সময় থাকবে সর্বোচ্চ ৫ ঘণ্টা। আমরা এটিকে একটি স্কুল দিবস বলছি, কেননা মানুষ শুনলে এটাকে অনেক সময় মনে করছে। কিন্তু প্রতিদিন বাচ্চারা ৬ ঘণ্টা স্কুলে থাকে।'
তিনি জানান, যে সাতটি স্কেলে ফলাফল মূল্যায়ন করা হবে, সেগুলোর নাম হবে অনন্য, অর্জনমুখী, অগ্রগামী, সক্রিয়, অনুসন্ধানী, বিকাশমান ও প্রারম্ভিক।
গত ফেব্রম্নয়ারি মাসে মূল্যায়ন পদ্ধতির খসড়া তৈরি করে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। লিখিত পরীক্ষা না রাখার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হলেও অভিভাবকদের চাপের মুখে শিক্ষা মন্ত্রণালয় মূল্যায়ন পদ্ধতি ও পাঠ্যক্রমের জন্য একটি সমন্বয় কমিটি (এনসিসি) গঠন করে দেয়।
গত সোমবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে এনসিসিসি'র সভায় এনসিটিবি'র মূল্যায়ন কৌশলের খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়। শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরীও সভায় ছিলেন।
অধ্যাপক মশিউজ্জামান জানান, তাদের মূল্যায়ন কৌশলের খসড়ায় কিছু পরিবর্তন এনে সেটি চূড়ান্ত করা হয়েছে।
মূল্যায়নের ক্ষেত্রে 'প্রারম্ভিক' সবচেয়ে নিচের স্তরের নাম। তার আগের স্তর হচ্ছে বিকাশমান। একজন শিক্ষার্থী যখন 'বিকাশমান' পাবে, তখন তার ২ নম্বর ঘর ভরাট করা থাকবে। কেউ 'অনুসন্ধানী' পর্যন্ত গেলে ৩ নম্বর ঘর, এভাবে যে সবচেয়ে ভালো করবে সে পাবে 'অনন্য'।
মশিউজ্জামান বলেন, 'যে যত পাবে, তার ততটা ঘর পূরণ করা থাকবে। এখন যদি বলি, আমার বাচ্চা অর্জনমুখী পেয়েছে, তখন অনেকেই এটি বুঝতে পারবে না। এই কনফিউশন দূর করার জন্য কিছু ইংরেজি বর্ণমালা দিয়ে মূল্যায়নকে বোঝানো হবে। সর্বোচ্চ স্কেল 'অনন্য' বলতে বোঝানো হবে শিক্ষার্থী সব বিষয়ে পারদর্শিতার চূড়ান্ত স্তর অর্জন করেছে। প্রারম্ভিক স্তর বলতে পারদর্শিতার সবচেয়ে নিচের স্তরকে বোঝানো হবে।'
এখানে যেহেতু নম্বরের পার্থক্য নেই, তাই আগের মতো আর গ্রেড পয়েন্ট থাকছে না বলে জানান এনসিটিবির রুটিন দায়িত্বে থাকা চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, 'স্টেটমেন্টের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করা হবে। স্কুলে কেউ যদি 'অনন্য' পেল, কিন্তু সামষ্টিকে সে 'অগ্রসরমান' পেল, তখন বোঝা যাবে, সে স্কুলে প্রভাব খাটিয়ে এটা করেছে। তখনই এটা চ্যালেঞ্জ করা হবে।'
অধ্যাপক মশিউজ্জামান বলেন, শর্তসাপেক্ষে দুটি বিষয়ে পাস না করলেও তাকে এসএসসি পরীক্ষা দিতে দেওয়া হবে। তিনি আরও বলেন, 'দুটি বিষয়ে যদি কোনো শিক্ষার্থী 'বিকাশমান' পায়, তবে তাকে পরীক্ষা দিতে দেওয়া হবে। তবে 'প্রারম্ভিক' পেলে নয়। কেউ যদি তিনটি বিষয়ে বিকাশমান বা তার নিচে থাকে, তাহলে সে ফেল বলে গণ্য হবে। আর দুটি বিষয়ে প্রারম্ভিকে থাকে, তাহলে সে ফেল। আমরা বলেছি, একটি বা দুটি বিষয়ে শিখনকালীন মূল্যায়ন যদি কোনো শিক্ষার্থী সম্পন্ন করে থাকে, ৭০ শতাংশ ক্লাসে তার উপস্থিতি থাকে এবং দুটি বিষয়ে তার বিকাশমান থাকে, তখন তাকে শর্তসাপেক্ষে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি করা যাবে।'
তবে, একাদশে ভর্তি হলেও দুটি বিষয়ে কোনো শিক্ষার্থী পাস না করলে, সে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবে না। বিকাশমানের পরের স্তর 'অনুসন্ধানী' স্তরে গেলে একজন শিক্ষার্থী পাস করেছে বলে গণ্য হবে।
অধ্যাপক মশিউজ্জামান বলেন, এসএসসি পরীক্ষার আগে কোনো নির্বাচনী পরীক্ষা থাকবে না। তবে গ্রেড টেনে ভর্তি হয়ে তাকে ৭০ শতাংশ ক্লাসে উপস্থিত থাকতে হবে, নইলে সে এসএসসি পরীক্ষা দিতে পারবে না।
আগের মতোই শিক্ষা বোর্ডগুলোর অধীন এসএসসি পরীক্ষা হবে। মাদ্রাসায় অন্য সব বিষয় আগের মতোই নম্বরের ভিত্তিতে পরীক্ষা হবে। কিন্তু নতুন শিক্ষাক্রমের যে বিষয়গুলো রয়েছে, সেগুলোন মূল্যায়ন হবে নতুন নিয়মে।
গত বছর প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। প্রথম বছর প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন এই শিক্ষাক্রম শুরু হয়। আর এ বছর জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়া নতুন শিক্ষাবর্ষে ওই তিন শ্রেণি ছাড়াও দ্বিতীয়, তৃতীয়, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে চালু হয়েছে এই শিক্ষাক্রম।
২০২৫ সাল থেকে পুরোপুরি নতুন শিক্ষাক্রমে পড়বে শিক্ষার্থীরা। আর ২০২৭ সালে দ্বাদশ শ্রেণিতে (উচ্চমাধ্যমিক) বাস্তবায়িত হবে নতুন শিক্ষাক্রম।