সর্বজনীন পেনশন স্কিম প্রত্যয়
লড়াইয়ে একাট্টা শিক্ষক-কর্মচারীরা
কর্তৃপক্ষ অভয় দিলেও আন্দোলনকারীরা বলছেন 'জিম্মি করা হচ্ছে' আন্দোলনের যুক্তি খুঁজে পাচ্ছেন না অর্থমন্ত্রী দাবি আদায়ে সর্বাত্মক কর্মবিরতি অব্যাহত
প্রকাশ | ০৩ জুলাই ২০২৪, ০০:০০
যাযাদি ডেস্ক
সর্বজনীন পেনশন স্কিম প্রত্যয়ে যুক্ত হতে অসম্মতি জানিয়ে ৩৫ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা একাট্টা হয়ে সর্বাত্মক কর্মবিরতি অব্যাহত রেখেছেন। সোমবার থেকে শুরু হওয়া অনির্দিষ্টকালের এ আন্দোলনে অচল হয়ে পড়েছে উচ্চ শিক্ষা কার্যক্রম। মঙ্গলবার দ্বিতীয় দিনের কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে আন্দোলনকারীরা বলেছেন, এ স্কিমের মাধ্যমে শিক্ষকদের মূলত জিম্মি করা হচ্ছে। কোনোভাবেই প্রত্যয় স্কিম তারা মেনে নেবেন না। প্রয়োজনে তারা কঠোরতর আন্দোলনে যাবেন। এই লড়াইয়ে বিজয়ী হয়েই ক্লাসে ফিরবেন তারা।
তবে 'প্রত্যয়' নিয়ে অভয় দিয়েছে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ। তারা বলছে, ৩০ জুনের আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরিতে যোগদানকারীদের নতুন স্কিমে যুক্ত হওয়ার বাধ্যবাধকতা নেই। সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে একটি টেকসই পেনশন ব্যবস্থায় আনার লক্ষ্য নিয়েই এ স্কিম চালু হয়েছে। এক বার্তায় এ বিষয়ে ব্যাখ্যাও দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। কিন্তু এ অভয় বাণীতেও অনড় বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন। তারা এটিকে 'বৈষম্যমূলক' সিদ্ধান্ত হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। অবশ্য উচ্চ শিক্ষাঙ্গনের এই আন্দোলনের কোনো যুক্তিই খুঁজে পাচ্ছেন না অর্থমন্ত্রী। তার মতে, 'আন্দোলন অযৌক্তিক'।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মঙ্গলবার দুপুর ১২টা থেকে ১টা পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) শিক্ষক সমিতির নেতাসহ অন্য শিক্ষকরা কলাভবনের মূল ফটকে দ্বিতীয় দিনের মতো কর্মবিরতি পালন ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন।
অবস্থান কর্মসূচিতে ঢাবি শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. জিনাত হুদা বলেন, 'এ আন্দোলন শিক্ষার্থীদের জন্যই। ভবিষ্যতে তারাই শিক্ষক হবেন। এ আন্দোলন নিয়ে অনেক ধরনের অপপ্রচার চলছে। বলা হচ্ছে, শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে এ আন্দোলন করা হচ্ছে। মূলত শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের জন্যই এ আন্দোলন করছে। আর প্রত্যয় স্কিমের মাধ্যমে সারা বাংলাদেশের শিক্ষকদেরই মূলত জিম্মি করা হচ্ছে।'
উন্নত বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন-ভাতার উদাহারণ টেনে তিনি বলেন, 'উন্নত দেশের কথা বাদই দিলাম.. যেহেতু সবকিছুই বাদ দিচ্ছি; এই উপমহাদেশের দিকে তাকান, ভারত, শ্রীলঙ্কা এমনকি পাকিস্তানেও শিক্ষকদের বেতন অনেক বেশি। যাদের বিরুদ্ধে আমরা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন করেছিলাম, তাদের দেশেও শিক্ষকদের বেতন অনেক বেশি।'
কর্মসূচিতে অধ্যাপক
\হজিনাত হুদার সঞ্চালনায় আরও বক্তব্য রাখেন সমিতির সাবেক সহ-সভাপতি ও ঢাবি সাদা দলের আহ্বায়ক অধ্যাপক লুৎফুর রহমান, জহুরুল হক হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক আব্দুর রহিম, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এম ওহিদুজ্জামান, কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক আবদুল বাছিরসহ আরও অনেকে। এসময় শিক্ষকরা তাদের বক্তব্যে দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলমান রাখার ঘোষণা দেন।
একই দাবিতে সকাল ১০টা থেকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার বিল্ডিংয়ের সামনের মল চত্বরে এসে জড়ো হন কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। তারাও দুপুর ১টা পর্যন্ত অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন। এসময় অবিলম্বে দাবি না মানলে বিশ্ববিদ্যালয়কে অচল করে দেওয়ার ঘোষণা দেয়। প্রয়োজনে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব মূল ফটকে তালা ঝোলানোরও হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়। দাবি আদায়ে উপাচার্যকে ঊর্ধ্বতন মহলে আলোচনার আহ্বান জানান তারা।
ঢাবির কর্মচারী সমিতির সভাপতি সারোয়ার মোর্শেদ বলেন, আমরা এই আন্দোলন শেষ না করে আমরা ঘরে ফিরব না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে এমন রাজনীতি আমরা কখনো মেনে নেব না। আমরা চাই প্রধানমন্ত্রী আপনি সর্বজনীন সুযোগ-সুবিধা স্কিম নামে এমন একটি স্কিম তৈরি করুন, যার ফলে আমলাদের মতো কর্মচারীরাও সমান সুযোগ পাবে। বর্তমান পেনশন স্কিমে আমলা, সচিবরা সব সুযোগ পাবে কিন্তু আমাদের বেলায় এসে সেই পেনশনকে কাটছাঁট করা হয়েছে যা আমরা কখনো মেনে নেব না।
বিক্ষোভ-সমাবেশে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি মো. শাহজাহান, কর্মচারী সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মঞ্জুরুল হক, চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ইউনিয়নের তরিকুল ইসলাম, মনির রহমান, কর্মচারী সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক মঞ্জুরুল ইসলাম, ইমদাদ হাসান প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
আমাদের জবি প্রতিনিধি জানান, আন্দোলনের কারণে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে মঙ্গলবারও ক্লাস-পরীক্ষাসহ দাপ্তরিক কার্যক্রম বন্ধ ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সকালে ভাষাশহীদ রফিক ভবনের সামনে অবস্থান নেন। তারা বেলা ১টা পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করেন। পাশেই নতুন ভবনের সামনে অস্থায়ী প্যান্ডেল করে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অবস্থান নিয়ে কর্মসূচি পালন করেন।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি মমিন উদ্দীন বলেন, সমস্যা সমাধানে কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কোনো বার্তা আসেনি। তারা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলতে চান। দ্রম্নত ক্লাস-পরীক্ষায় ফিরতে চান।
কর্মসূচি দীর্ঘস্থায়ী হলে শিক্ষার্থীরা সংকটে পড়বে কিনা- এমন প্রশ্নের উত্তরে মমিন উদ্দীন বলেন, 'অবশ্যই সংকটে পড়বে। তবে আমরা করোনার সময় এমন সংকট কাটিয়ে উঠেছি। আমরা আন্দোলনটি করছি, ভবিষ্যতে যেন মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশায় আসতে আগ্রহী হন।'
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়
বরিশাল অফিস জানায়, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে চলমান আন্দোলনে কর্মকর্তাদের দুই গ্রম্নপের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এতে দুই পক্ষের ১০ জন কর্মকর্তা আহত হয়েছেন। পরে পুলিশ ও প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যরা এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাউন্ড ফ্লোরে ডিরেক্ট অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশন ব্যানার নিয়ে দাঁড়ালে অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের কর্মকর্তারা তাদের ওপর হামলা করলে এ মারামারির ঘটনা ঘটে। প্রায় আধাঘণ্টা যাবৎ দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এর আগে সকাল ৯টায় ডিরেক্ট অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশন গ্রাউন্ড ফ্লোরে ব্যানার টানালে তা ছিঁড়ে ফেলেন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের কতিপয় কর্মকর্তা। এ সময় তাদের মধ্যে বাগবিতন্ডা হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্টার প্রাথমিকভাবে তা থামিয়ে দেন?পরে নতুন ব্যানার নিয়ে গ্রাউন্ড ফ্লোরে দাঁড়ালে অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যরা প্রথমে ব্যানার ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। এ সময় অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের অন্য সদস্যরা চড়াও হলে দু'পক্ষের মধ্যে মারামারির ঘটনা ঘটে। মারামারির ঘটনায় দু'পক্ষের ১০ জন আহত হয়েছেন।
অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ডেপুটি রেজিস্ট্রার বাহাউদ্দীন গোলাপ বলেন, আমরা শান্তিপূর্ণ কর্মবিরতি ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করছি। এই কর্মসূচিকে বিতর্কিত করতেই ডিরেক্ট অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের নামে একটি অনুমোদনহীন সংগঠন হঠাৎ ব্যানার নিয়ে আলাদাভাবে অবস্থান নেয়। এতেই এই উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
পাবনা/পাবিপ্রবি প্রতিনিধি জানান, মঙ্গলবার সকাল ৯টা থেকে সর্বাত্মক কর্মবিরতি ও অবস্থান কর্মসূচি পালিত হয়। এই কর্মসূচি শেষে দুপুর ৩টায় আন্দোলনরত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (পাবিপ্রবি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. হাফিজা খাতুনকে তার কার্যালয়ে অবরুদ্ধ করেন। সেই সঙ্গে উপাচার্য কার্যালয়ে বিদু্যৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে রেখেছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির আন্দোলনরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একাংশ।
উপাচার্য কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, সকাল ৯টা থেকে প্রশাসনিক ভবনের সামনে কর্মকর্তারা আন্দোলন শুরু করেন। দুপুরের খাবারের পর কর্মকর্তারা মিছিল নিয়ে উপাচার্য কার্যালয়ের সামনে আসেন এবং দপ্তরের ভেতরে ঢুকতে চেষ্টা করেন। এ সময় উপাচার্যের ব্যক্তিগত সহকারী (পিএস) মনিরুজ্জামান, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা কর্মকর্তা হাসিবুর রহমান তাদের বাধা দিলে তাদের কর্মকর্তারা লাঞ্ছিত করেন বলে অভিযোগ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে কর্মকর্তা পরিষদের সভাপতি হারুনুর রশিদ ডন বলেন, 'উপাচার্যকে অবরুদ্ধ করার অভিযোগটি মিথ্যা। উপাচার্য ভেতরে অবস্থান করছেন, উনি চাইলে বের হয়ে যেতে পারেন। আর দুইজন কর্মকর্তাকে যে লাঞ্ছিত করা হয়েছে এই অভিযোগ করা হয়েছে, এটিও মিথ্যা। আমরা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করে যাচ্ছি, ওরা এসে আমাদের বাধা দেয়। পরে বিক্ষুব্ধ কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাদের হাতাহাতি হয়।'
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. কামাল হোসেন বলেন, 'যে ঘটনা ঘটেছে সেটি দুঃখজনক। সমস্যাটি সমাধানের জন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে বসা হচ্ছে। সিদ্ধান্ত হলে সেটা আপনাদের জানাব।'
রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়
মঙ্গললবার সকালে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক ভবনগুলো খুললেও দুপুর ১২টা পর্যন্ত কোনো শিক্ষার্থীকে দেখা যায়নি। অধিকাংশ শ্রেণিকক্ষ ও পরীক্ষা কক্ষগুলো তালাবদ্ধ রয়েছে। কর্মচারীরা এলেও তারা অলস সময় পার করেন।
বেরোবি শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান মন্ডল বলেন, দাবি আদায় না না হওয়া পর্যন্ত বেরোবিতে সব ধরনের ক্লাস-পরীক্ষা, সমন্বয় সভা, ভর্তি কার্যক্রম ও প্রভোস্ট অফিস বন্ধ থাকবে।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান ভবনের সামনে মঙ্গলবার দুপুর ১২টা থেকে ১টা পর্যন্ত অবস্থান কর্মসূচি পালিত হয়। এ সময় উপস্থিত ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন, সাধারণ-সম্পাদক অধ্যাপক ড. মো. আলমগীর কবীর, বিভিন্ন অনুষদের ডিন, বিভাগীয় প্রধানসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা।
শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন বলেন, আমাদের কথা একটাই আমরা এটা মানি না, মানব না এবং কোনোভাবেই মানতে পারি না।
শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. মো. আলমগীর কবীর বলেন, আমাদের আন্দোলন সরকারের বিরুদ্ধে নয়, আমাদের আন্দোলন তাদের বিরুদ্ধে যারা আমাদের এই অবস্থানে নিয়ে এসেছে।
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
স্টাফ রিপোর্টার, টাঙ্গাইল জানান,
টাঙ্গাইলের মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ভবনের সামনে সমবেত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি পূর্ণদিবস কর্মবিরতি এবং প্রশাসনিক ভবনের সামনে সমবেত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশন অর্ধদিবস কর্মবিরতি কর্মসূচি পালন করে।
বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের আহ্বানে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ভবনের সামনে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি আয়োজিত কর্মবিরতি চলাকালে বক্তব্য রাখেন শিক্ষক সমিতির সভাপতি প্রফেসর ডক্টর এএসএম সাইফুলস্নাহ ও সাধারণ সম্পাদক প্রফেসর ডক্টর মো. মাসুদার রহমান।
অপরদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সামনে সমবেত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের উদ্যোগে অর্ধদিবস কর্মবিরতি চলাকালে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় অফিসার্স ফেডারেশনের উপদেষ্টা ও ভাসানী বিশ্ববিদ্যালয় অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. মফিজুল ইসলাম মজনু, সাধারণ সম্পাদক ডক্টর ইকবাল বাহার বিদু্যৎ এবং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আজাদ খান ভাসানী প্রমুখ।
'অভয়' দিয়ে পেনশন কর্তৃপক্ষের ব্যাখ্যা
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের আন্দোলনের মধ্যে সর্বজনীন পেনশনের পঞ্চম স্কিম 'প্রত্যয়' নিয়ে একটি অভয় বাণী দিয়েছে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ। এক বার্তায় জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ বলেছে, গত ৩০ জুনের আগে চাকরিতে যোগদানকারী শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নতুন স্কিমে যুক্ত হওয়ার বাধ্যবাধকতা নেই।
মঙ্গলবার জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ থেকে 'সর্বজনীন পেনশন স্কিম প্রত্যয়ের শুভযাত্রা ও প্রাসঙ্গিক বিষয়ের স্পষ্টীকরণ' শীর্ষক বার্তা পাঠানো হয়।
সেখানে বলা হয়, সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে একটি টেকসই পেনশন ব্যবস্থায় আনার লক্ষ্য নিয়েই স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত ও রাষ্ট্রায়ত্ত এবং তার অঙ্গসংগঠনের প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য 'প্রত্যয়' স্কিম চালু করা হয়েছে।
জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ বলছে, সরকারি, স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত ও রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান ছাড়া দেশের বিপুলসংখ্যক জনসাধারণ একটি সুগঠিত পেনশনের আওতার বাইরে থাকায় সরকার সব শ্রেণি-পেশার মানুষের জন্য সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু করেছে।
সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা আইন, ২০২৩ এর ১৪ (২) ধারা অনুযায়ী, ১ জুলাই ২০২৪ বা তার পরে স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত ও রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানে চাকরিতে যোগদানকারী সব কর্মচারী বাধ্যতামূলকভাবে প্রত্যয় স্কিমের আওতাভুক্ত হবেন। অর্থমন্ত্রীও তার বাজেট বক্তৃতায় বিষয়টি বলেছেন। শিক্ষকদের আশ্বস্ত করতে প্রত্যয় স্কিমের কিছু বিষয় ব্যাখ্যা করা হয়েছে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের বার্তায়।
১) ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত যেসব শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী চাকরিতে আছেন, তারা আগের মতো সব পেনশন সুবিধা পাবেন। ২) বর্তমানে সরকারি পেনশনে 'আনফান্ডেড ডিফাইন্ড বেনিফিট' সিস্টেমের পেনশন ব্যবস্থা প্রচলিত আছে। ফলে পেনশনের যাবতীয় ব্যয় প্রয়োজন অনুযায়ী জাতীয় বাজেট বরাদ্দ থেকে মেটানো হয়। ২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে 'ফান্ডেড ডিফাইন্ড কনট্রিবিউটরি' পদ্ধতির পেনশন ব্যবস্থা চালু হয়েছে। সে কারণে বিশ্বের অন্য দেশের মতো বেতন থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণে মাসিক জমার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। প্রত্যয় স্কিমে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বা কর্মচারীর প্রাপ্ত মূল বেতনের ১০ শতাংশ বা সর্বোচ্চ ৫ (পাঁচ) হাজার টাকা, যেটা কম হয়, তা কর্মকর্তা বা কর্মচারীর বেতন থেকে কেটে রাখবে এবং সমপরিমাণ অর্থ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা দেবে। সেই টাকা প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত কর্মকর্তা-কর্মচারীর কপার্স হিসেবে জমা করবে। ৩) 'আনফান্ডেড ডিফাইন্ড বেনিফিট' সিস্টেমের পেনশন ব্যবস্থায় সরকারের আর্থিক সংশ্লেষ ক্রমাগত বৃদ্ধি পায় যা দীর্ঘমেয়াদে কোনোক্রমেই টেকসই ব্যবস্থা নয়। অপরদিকে 'ফান্ডেড ডিফাইন্ড কনট্রিবিউটরি' পেনশন সিস্টেমে প্রাপ্ত কন্ট্রিবিউশন এবং বিনিয়োগ মুনাফার ভিত্তিতে একটি ফান্ড গঠিত হয় বলে দীর্ঘমেয়াদে এটি একটি টেকসই পেনশন ব্যবস্থা। ভারতেও ২০০৪ সাল থেকে ফান্ডেড কন্ট্রিবিউটরি পেনশন ব্যবস্থা চালু আছে। ৪) নতুন পেনশন ব্যবস্থাপনা প্রবর্তনের মাধ্যমে ধীরে ধীরে সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে টেকসই সামাজিক নিরাপত্তা কাঠামোর মধ্যে আনা সম্ভব হবে। ৫) কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে আবেদনের পর নিজ বিশ্ববিদ্যালয় বা অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে একই পদে বা উচ্চতর কোনো পদে নিয়োগ পেলে তিনি সার্ভিস প্রটেকশন ও পে-প্রটেকশন পান বলে সেটি নতুন নিয়োগ হিসেবে গণ্য করা হয় না। সেক্ষেত্রে তার বিদ্যমান পেনশন সুবিধার আওতায় থাকার সুযোগ থাকবে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ও কর্মচারী যারা ২০২৪ সালের ১ জুলাই এবং তারপর নতুন নিয়োগ পাবেন, কেবল তারা প্রত্যয় স্কিমে অন্তর্ভুক্ত হবেন। ৬) সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা আইনে ৬০ বছর বয়স থেকে পেনশনপ্রাপ্তির কথা থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ৬৫ বছরে অবসরে যাবেন বলে তখন থেকে আজীবন পেনশন পাবেন। এক্ষেত্রে সরকার আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধন করবে। ৭) লাম্পগ্রান্ট ও পিআরএল অর্জিত ছুটি প্রাপ্যতার ভিত্তিতে দেওয়া হয়। ছুটি জমা থাকা সাপেক্ষে তা বহাল থাকবে। ৮) কন্ট্রিবিউটরি পেনশন সিস্টেমে অংশগ্রহণকারীর সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এককালীন নয় বরং মাসিক পেনশনের যুক্তিসঙ্গত পরিমাণ নির্ধারণ করাই অগ্রগণ্য। সে কারণে এক্ষেত্রে আনুতোষিকের ব্যবস্থা রাখা হয়নি বরং বিদ্যমান মাসিক পেনশনের কয়েকগুণ বেশি মাসিক পেনশন দেওয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। প্রত্যয় স্কিমে মাসিক ৫০০০ টাকা বেতন থেকে কাটা হলে একই পরিমাণ অর্থ প্রতিষ্ঠান জমা করলে ৩০ বছর পর একজন পেনশনার প্রতি মাসে ১,২৪,৬৬০ টাকা হারে আজীবন পেনশন পাবেন। তার নিজ আয়ের মোট জমা অর্থের পরিমাণ হবে ১৮ লাখ টাকা। আর তিনি যদি ১৫ বছর ধরে পেনশন পান, সেক্ষেত্রে তার মোট প্রাপ্তি হবে ২ কোটি ২৪ লাখ ৩৮ হাজার ৮০০ টাকা যা তার জমার প্রায় ১২ দশমিক ৫ গুণ। পেনশনার পেনশনে যাওয়ার পর ৩০ বছর জীবিত থাকলে তার জমার প্রায় ২৫ গুণ অর্থ পেনশন পাবেন।
৯) বিদ্যমান ব্যবস্থায় পেনশনার আজীবন পেনশন পান। তার অবর্তমানে পেনশনারের স্পাউস এবং প্রতিবন্ধী সন্তান আজীবন পেনশন পান। নতুন পেনশন ব্যবস্থায়ও পেনশনার আজীবন পেনশন পাবেন। পেনশনারের অবর্তমানে তার স্পাউস বা নমিনি পেনশনারের পেনশন শুরুর তারিখ থেকে ১৫ বছর হিসাবে যে সময় অবশিষ্ট থাকবে সে পর্যন্ত পেনশন প্রাপ্য হবেন। যেমন একজন অবসরে যাওয়ার পর ৫ বছর পেনশন পেয়ে তারপর মারা গেলে, তার স্পাউস বা নমিনি আরও ১০ বছর পেনশন পাবেন।
আন্দোলন অযৌক্তিক: অর্থমন্ত্রী
সর্বজনীন পেনশনের প্রত্যয় স্কিম বাতিলের দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের আন্দোলন অযৌক্তিক বলে মন্তব্য করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী।
মঙ্গলবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে অর্থমন্ত্রীর অফিস কক্ষে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) দক্ষিণ, মধ্য ও পশ্চিম এশিয়ার ভাইস প্রেসিডেন্ট ইয়াংমিং ইয়ংয়ের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ শেষে মন্ত্রী এ কথা বলেন। প্রত্যয় স্কিম নিয়ে শিক্ষকদের আন্দোলনের কোনো যুক্তি খুঁজে পাচ্ছে না বলেও জানান তিনি।