ভ্যাপসা গরমে উৎপাদনে ভাটা
প্রকাশ | ৩০ জুন ২০২৪, ০০:০০
সাখাওয়াত হোসেন
আষাঢ় মাসের শুরু থেকে প্রায় প্রতিদিন কোথাও না কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে। দেশের অধিকাংশ এলাকার আকাশ থাকছে মেঘলা। তারপরও ভ্যাপসা গরম থেকে স্বস্তি মিলছে না। বৃষ্টি থেমে গেলেই বাড়ছে গরমের তীব্রতা। হাঁসফাঁস হয়ে উঠছে জনজীবন। আবহাওয়াবিদরা জানান, আষাঢ়ের শুরুর দিকের বৃষ্টির ধরন এ রকমই। অল্প সময় হালকা বৃষ্টিপাত হলেও বরং গরমের তীব্রতা কিছুটা বেশি অনুভূত হয়। তবে এবারের ভ্যাপসা গরম আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি।
এদিকে এ ধরনের অস্বস্তিকর গরমের কারণে শ্রমিকরা স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে না পারায় শিল্প-কারখানা ও কৃষি খাতে উৎপাদন বেশ খানিকটা কমেছে। ভ্যাপসা গরমে টানা কয়েকদিন কাজ করলে শ্রমিকরা অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। ফলে শ্রমিক উপস্থিতিও কিছুটা কম। সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা, এ ধারা অব্যাহত থাকলে শিল্প ও কৃষিপণ্য উৎপাদন যেমন কমবে, তেমনি উৎপাদন খরচ বাড়বে বলে করছেন।
শিল্প খাত পর্যবেক্ষকরা জানান, গার্মেন্টসসহ অধিকাংশ শিল্পকারখানায় পর্যাপ্ত সংখ্যক সিলিং ও এডজাস্ট ফ্যান থাকলেও তীব্র গরমে শ্রমঘন এসব কর্মস্থলে টানা কয়েক ঘণ্টা কাজ করতে গিয়ে শ্রমিকরা ঘেমে-নেয়ে উঠছে। শরীর সহজেই ক্লান্ত হয়ে পড়ছে। একই শ্রমঘণ্টাতে আগের
মতো পণ্য উৎপাদন অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনকি কর্মঘণ্টা বাড়িয়েও 'প্রোডাকশন স্কেল' আগের জায়গায় ধরে রাখতে পারছে না ক্লান্ত শ্রমিকরা।
সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, গ্যাস সংকটের কারণে বিদু্যৎ উৎপাদন কমায় শিল্প কারখানাগুলো চাহিদা অনুযায়ী বিদু্যৎ পাচ্ছে না। এর ওপর ভ্যাপসা গরমের কারণে ফ্যাক্টরিতে সিলিং ফ্যান, এসি ও এডজাস্ট ফ্যান সার্বক্ষণিক চালিয়ে রাখতে হচ্ছে। ফলে উৎপাদন কাজে বিদু্যতের ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। যা প্রোডাকশন ভলিয়ম ধরে রাখার ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কৃষি খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, ভ্যাপসা গরমের কারণে সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত কৃষকরা ফসলের মাঠে স্বাভাবিক গতিতে কাজ করতে না পারায় কৃষিপণ্য উৎপাদনেও ভাটার টান ধরেছে। এ ছাড়া ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে সময়মতো সেচ দেওয়া যাচ্ছে না। যা শস্য ফলনের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গবেষকরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে তাপপ্রবাহের মতো ঘটনা বাড়ছে, আর তীব্র গরমে কাজ করতে গিয়ে শ্রমিকরা তাদের কর্মক্ষমতা হারাচ্ছেন। তাতে মোট দেশজ উৎপাদন কমছে। যা অর্থনীতির জন্য হয়ে দাঁড়াচ্ছে বড় ঝুঁকি। তীব্র গরমের কারণে দেশে তৈরি পোশাক এবং কৃষি খাতের উৎপাদন সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
বিশ্ব ব্যাংকের পরিসংখ্যানের বরাতে গবেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে মোট কর্মশক্তির ৩৭ শতাংশ কৃষিতে এবং ২২ শতাংশ শিল্পে যুক্ত। যাদের বাইরে কাজ করতে হয়, তারা ভ্যাপসা গরমে সহজেই ক্লান্ত হয়ে পড়ছে; নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। আর তৈরি পোশাক শিল্পের মতো যেসব কারখানা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত নয়, তাপ থেকে সুরক্ষার ব্যবস্থাও যেখানে কম, সেসব শিল্পের কর্মীও ভ্যাপসা গরমের কারণে বিরূপ প্রভাবের মুখোমুখি হচ্ছেন। বর্তমানে দেশের বেশিরভাগ কারখানার ভেতরের তাপমাত্রা এখন ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপর। যা শ্রমিকদের বড় ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
গাজীপুর, সাভার, আশুলিয়া ও নারায়ণগঞ্জের একাধিক বস্ত্র শিল্প কারখানার প্রোডাকশন ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভ্যাপসা গরমের কারণে কারখানাগুলোয় শ্রমিকের উপস্থিতি কমে গেছে। ঈদের পর যারা কাজে যোগ দিয়েছেন, তাদের বেশিরভাগই দিনের চেয়ে রাতে কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন।
গাজীপুরে অবস্থিত তৈরি পোশাকের কাঁচামাল উৎপাদনকারী একটি কারখানা উৎপাদন মহাব্যবস্থাপক আব্দুর রাজ্জাক জানান, বস্ত্র শিল্পের এ কারখানায় তিন শিফটে প্রায় এক হাজার শ্রমিক কাজ করেন। ঈদের ছুটি শেষ হলেও অনেক শ্রমিক এখনো কাজে ফেরেননি। ভ্যাপসা গরমের মধ্যে উৎপাদন স্বাভাবিক রাখতে নানা উদ্যোগ নিলেও সব শিফটে সমান হারে শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। শ্রমিকদের উপস্থিতি তুলনামূলক বেশি থাকছে রাতের শিফটে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ পরিস্থিতি কেবল বস্ত্র শিল্পে নয়, তৈরি পোশাক কারখানাগুলোয়ও শ্রমিকের উপস্থিতি তুলনামূলক কম। যেসব কারখানায় শিফটিং ডিউটি করার সুযোগ রয়েছে, সেখানে বেশিরভাগ শ্রমিক দিনে ভ্যাপসা গরমের কারণে রাতের শিফটে কাজ করতে চাচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, কারখানার উৎপাদন ৩০ শতাংশ কম শ্রমিক দিয়ে চালিয়ে নিতে হচ্ছে। প্রতিবারই ঈদের পর শ্রমিকের উপস্থিতি কম থাকে। এবারও ব্যতিক্রম নয়। তবে গরমের তীব্রতার কারণে উপস্থিতি আরও কমে গেছে।
শিল্পসংশ্লিষ্টরা বলছেন, এবার তাপ প্রবাহের প্রভাব শিল্পোৎপাদনে পরোক্ষভাবে হলেও পড়েছে। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, কারখানার আশপাশ এলাকায় থাকা শ্রমিকদের আবাসন ব্যবস্থা খুব একটা উন্নত নয়। তীব্র গরমে এ ধরনের আবাসনে থাকতে তাদের খুবই কষ্ট হয়। আবার তীব্র গরমের কারণে কাজের প্রতি শ্রমিকের আগ্রহে ব্যাঘাত ঘটছে।
বিটিএমএর সহসভাপতি ফজলুল হক বলেন, শিল্প কারখানাগুলো জ্বালানি সংকটের পাশাপাশি এখন তীব্র গরমের প্রভাব মোকাবিলা করছে। প্রায় ২০ শতাংশ শ্রমিক অনুপস্থিত রয়েছে কারখানায়। ফলে উৎপাদন স্বাভাবিকভাবেই কমেছে।
এদিকে ভ্যাপসা গরমে বেশি ভোগান্তিতে পড়েছে কৃষিশ্রমে নিয়োজিত মানুষ। ফসলের ক্ষেতে দীর্ঘক্ষণ কাজ করতে তাদের যেমন কষ্ট হচ্ছে, তেমনি উৎপাদনে হতাশাজনক ফল মিলছে। কৃষকদের ভাষ্য, আষাঢ় মাসে গরমের এত তীব্রতা এর আগে কখনো অনুভব করেননি তারা। গরমের কারণে টানা এক ঘণ্টাও ক্ষেতে কাজ করতে পারছেন না। কিছু সময় পরপর তাদের বিশ্রাম নিতে হচ্ছে। এ কারণে তাদের আয়ও কমেছে।
কৃষি সংশ্লিষ্টরা জানান, এখন রোপা-আমন চাষের মৌসুম। এ সময় আকাশ সাধারণত মেঘলা থাকে। ফলে খুব বেশি গরম অনুভূত হয় না। কিন্তু এবারের চিত্র একেবারেই ভিন্ন। প্রখর রৌদ্রতাপ না থাকলেও ভ্যাপসা গরমের কারণে মাঠে ঠিকমতো কাজ করা যাচ্ছে না। শ্রমিকদের কাজের গতি প্রায় অর্ধেক কমে গেছে। যেসব শ্রমিক গত বছর চুক্তিতে আমন চারা রোপণ করে একদিনে ৯০০ থেকে ১০০০ টাকা মজুরি নিয়েছেন, তারা এবার একই কাজে ৭০০ টাকা মজুরি তুলতে হিমশিম খাচ্ছেন।
লন্ডন স্কুল অব ইকনোমিক্সের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পরিবর্তিত জলবায়ুর সঙ্গে যদি পুরোপুরি খাপ খাইয়ে নেওয়া না যায়, আর বাংলাদেশের গড় তাপমাত্রা যদি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যায়, তাহলে ২০৪০ সাল নাগাদ উচ্চ তাপের অর্থনৈতিক খাতে (কৃষির মতো যেসব খাতে খোলা আকাশের নিচে কাজ করতে হয়) শ্রম সরবরাহ এবং উৎপাদনশীলতা এখনকার তুলনায় ১১.৩ শতাংশ পয়েন্ট পর্যন্ত হ্রাস পেতে পারে। একইভাবে গড় তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে গেলে ২০৬০ সাল নাগাদ এসব খাতে শ্রম সরবরাহ এবং উৎপাদনশীলতা ২০.৯ শতাংশ পয়েন্ট এবং তাপমাত্রা ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ২০৮০ সাল নাগাদ ৪৬.২ শতাংশ পয়েন্ট কমে যেতে পারে।
এমনকি যেসব ক্ষেত্রে ঘরের ভেতর বা ছায়ার নিচে কাজ করতে হয়, সেসব শিল্প খাতেও ক্ষতির ঝুঁকি কম নয়। গবেষকদের অনুমান বলছে, গড় তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে গেলে ২০৪০ সাল নাগাদ এসব খাতে শ্রম সরবরাহ এবং উৎপাদনশীলতা ৯ শতাংশ পয়েন্ট; তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে গেলে ২০৬০ সাল নাগাদ ১৩.৩ শতাংশ পয়েন্ট এবং তাপমাত্রা ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে গেলে ২০৮০ সাল নাগাদ ২৫.১ শতাংশ পয়েন্ট কমে যেতে পারে। অর্থাৎ গড় তাপমাত্রা যত বাড়বে, দেশের শ্রমিকদের স্বাস্থ্য, উৎপাদনশীলতা এবং জাতীয় উৎপাদনের ওপর তত বেশি বিরূপ প্রভাব পড়বে।
এদিকে দেশে আষাঢ়ের প্রথম সপ্তাহের পর ভ্যাপসা গরম ক্রমান্বয়ে কমবে আবহাওয়াবিদরা এমন পূর্বাভাস দিলেও এখন তারা সে সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে। মঙ্গলবার ঢাকা আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, দেশের ২৪টি জেলার ওপর দিয়ে তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। সঙ্গে ভ্যাপসা গরমও অব্যাহত থাকতে পারে। লঘুচাপের বর্ধিতাংশ পশ্চিমবঙ্গ থেকে উত্তর-পশ্চিম বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত আছে। মৌসুমি বায়ু বাংলাদেশের ওপর মোটামুটি সক্রিয় এবং উত্তর বঙ্গোপসাগরের অন্যত্র মাঝারি অবস্থায় আছে।