দক্ষিণ আফ্রিকার হৃদয় ভেঙে চ্যাম্পিয়ন ভারত
প্রকাশ | ৩০ জুন ২০২৪, ০০:০০ | আপডেট: ৩০ জুন ২০২৪, ০১:১১
ক্রীড়া প্রতিবেদক
টি২০ বিশ্বকাপের শ্বাসরুদ্ধকর ফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকার হৃদয় ভেঙে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে ভারত।
প্রথমে ব্যাট করে ভারত ৭ উইকেটে ১৭৬ রান করে। জবাবে প্রেটিয়াদের ইনিংস শেষ হয় ১৬৯ রানে। ১৩ বছর পর ৭ রানে জয় পেয়ে বিশ্বকাপ ঘরে তোলে রোহিত শর্মার দল।
বিশ্বকাপ জিতে ম্যাচসেরা পুরস্কার গ্রহণ করার সময় টি২০ সংস্করণ থেকে অবসরের ঘোষণা দেন বিরাট কোহলি।
২৯ জুন বার্বাডোজের কেনসিংটন ওভালে রুদ্ধশ্বাস এক ফাইনালে টানটান উত্তেজনা- কে হাসবে শেষ হাসি-দক্ষিণ আফ্রিকা নাকি ভারত? বোঝা যাচ্ছিল না তখনো। শেষ ওভারে হার্দিক পান্ডিয়ার হাতে বল তুলে দিলেন ভারতীয় অধিনায়ক রোহিত শর্মা। প্রথম বলেই ওয়াইড ফুলটস, সজোরে হাঁকালেন ডেভিড মিলার। ছক্কা হতেই যাচ্ছিল, দৌড়ে এসে লংঅফ বাউন্ডারিতে বল তালুবন্দি করলেও রাখতে পারেননি সূর্যকুমার। বুদ্ধি করে সেটি ভাসিয়ে দিলেন বাতাসে। পরের চেষ্টায় ভেতরে ঢুকে নিয়ে নিলেন ক্যাচ। ওই এক ক্যাচেই যেন সব শেষ দক্ষিণ আফ্রিকার। পরের ৫ বলে আর ১৬ রান নিতে পারেননি লোয়ার অর্ডাররা। শনিবার রাতে রুদ্ধশ্বাস এক ফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকাকে ৭ রানে হারিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো টি২০-এর বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ভারত।
এটি দলটির দ্বিতীয় টি২০ বিশ্বকাপ শিরোপা। একই সঙ্গে ১৩ বছর পর আইসিসির কোনো আসরের শিরোপার স্বাদ পেল তারা।
গ্রম্নপ পর্ব, সুপার এইট ও সেমিফাইনাল মিলিয়ে টানা ৮ ম্যাচে অপরাজিত দুই দলই। এক দলের জয়যাত্রা থামল তুমুল লড়াইয়ের মাধ্যমে।
বিরাট কোহলি (৭৬), অক্ষর প্যাটেল (৪৭) ও শিভাব দুবের (২৭) ব্যাটে ভর করে ফাইনালে লড়াকু সংগ্রহ দাঁড় করায় ভারত। টস জিতে ব্যাট করতে নেমে ৭ উইকেটে তাদের সংগ্রহ ১৭৬ রান। টি২০ বিশ্বকাপ ফাইনালে এটিই এখন সর্বোচ্চ স্কোর। এর আগে, ২০২১ বিশ্বকাপে ১৭৩ তুলেছিল অস্ট্রেলিয়া। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে রান তাড়ায় সেবার জিতেছিল অজিরা।
প্রথম শিরোপা
জিততে দক্ষিণ আফ্রিকার লক্ষ্য দাঁড়ায় ১৭৭ রান। প্রথমবারের মতো বৈশ্বিক মঞ্চের শিরোপা জয়ের জন্য উড়ন্ত শুরুর দরকার ছিল দক্ষিণ আফ্রিকার।
রান তাড়া করতে নেমে দ্বিতীয় ওভারেই উইকেট হারায় দক্ষিণ আফ্রিকা। জসপ্রিত বুমরাহর বল রক্ষণাত্মক খেলতে গিয়ে বোল্ড হয়ে যান রেজা হেনড্রিকস। ৫ বল খেলে ১ চারে ৪ রান করে যান তিনি। দলীয় ৭ রানে প্রথম উইকেট হারানোর পর ৫ রান যোগ করতেই দ্বিতীয় উইকেটের পতন।
অধিনায়ক হিসেবে দুর্দান্ত করলেও ব্যাটসম্যান হিসেবে এবারের বিশ্বকাপে নিজেকে মেলে ধরতে পারেননি এইডেন মার্করাম। ফাইনালে এসেও অনুজ্জ্বল তিনি। দলকে চাপে ফেলে দলীয় ১২ রানে ড্রেসিং রুমে ফেরেন ডানহাতি ব্যাটসম্যান।
ইনিংসের তৃতীয় ওভারে অর্শদিপ সিংয়ের অফ স্টাম্পের বাইরের বলটিতে ব্যাট চালিয়ে দেন মার্করাম। হালকা বেরিয়ে যাওয়া বলটি ব্যাটে খেলতে পারেননি তিনি। ব্যাটের কানায় লেগে যাওয়া বলটি ডানদিকে ঝাঁপিয়ে গস্নাভসে জমান রিশাভ পান্ত। ১ চারে ৫ বলে ৪ রান করে ফিরলেন মার্করাম।
আরেকটি উইকেট নিতে উন্মুখ হয়ে ওঠা ভারত নেয় রিভিউর সাহায্য। কিন্তু তাতে লাভ হয়নি। উল্টো একটি রিভিউ হারায় তারা। অর্শদিপ সিংয়ের বাউন্সার পুল করেন কুইন্টন ডি কক। কিন্তু ব্যাটে লাগাতে পারেননি তিনি। বল জমা পড়ে রিশাভ পান্তের গস্নাভসে। আবেদন করে ভারত। আম্পায়ার সাড়া না দিলে কট বিহাইন্ডের রিভিউ নেয় তারা। রিভিউতে দেখা যায় বল ডি ককের ব্যাট কিংবা গস্নাভসের কোথাও লাগেনি। তখন ২ রানে ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকান কিপার-ব্যাটসম্যান। দলীয় ৭০ রানে স্টাবসকে নবম ওভারে বোল্ড করেন অক্ষর প্যাটেল। ২১ বলে ৩ চার ও ১ ছয়ে ৩১ রান করেন দক্ষিণ আফ্রিকান ব্যাটার।
১৩তম ওভারের প্রথম বলে সিঙ্গেল নিয়ে জ্যাকস ক্যালিসকে (২৩৮) ছাড়িয়ে এক বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে সর্বোচ্চ রান করেন কুইন্টন ডি কক। পরের বলে চার মারেন। একই শট খেলতে গিয়ে কুলদীপ যাদবের ক্যাচ হন তিনি। চতুর্থ উইকেটে ১০৬ রানের মাথায় ৩১ বলে ৩৯ রান করে অর্শদিপ সিংয়ের কাছে উইকেট হারালেন ডি কক।
কুলদিপ ইয়াদাভের গুগলি এক্সট্রা কাভারের ওপর দিয়ে ওড়ালেন হাইনরিখ ক্লাসেন। তার ওই বাউন্ডারিতে দলীয় শতরান স্পর্শ করল দক্ষিণ আফ্রিকা। এরপর মাত্র ২৩ বলে (৫১) ফিফটি করেন ক্লাসেন। মাত্র ১ রান যোগ করতেই সাজঘরে ফেরেন তিনি। দলীয় ১৫১ রানে পঞ্চম উইকেটের পতন।
শেষ ওভারে প্রয়োজন ছিল ১৬ রানের। এ মুহূর্তে হার্দিক পান্ডিয়া বোলিংয়ে এসে প্রথম বলেই ডেভিড মিলারকে (২১) ফেরান। তাতেই দক্ষিণ আফ্রিকার হার নিশ্চিত হয়ে যায়। রাবাদা মাঠে নেমেই চার মারেন।
আসরজুড়ে ছন্দের খোঁজে থাকা বিরাট কোহলি ফাইনাল ম্যাচের প্রথম ওভারেই তিনটি চার মারেন। মার্কো ইয়ানসেনের প্রথম বলটি লেগ সাইডে ঠেলে এক রান নেন রোহিত শর্মা। মুখোমুখি হওয়া প্রথম বলেই পয়েন্ট দিয়ে চার মারেন কোহলি। আরেকটি ফুল লেংথ বলে কাভার দিয়ে পাঠান বাউন্ডারিতে। ওভারের চতুর্থ বলে ডাবল নেওয়া কোহলি পরের বল ব্যাটেই লাগাতে পারেননি। ওভারের শেষ বলে স্ট্রেইট ড্রাইভে চার মারেন কোহলি। প্রথম ওভার থেকে আসে ১৫ রান।
ঝোড়ো শুরুর আভাস দিয়ে শুরুতেই ফেরেন রোহিত শর্মা। তাতে ১.৩ ওভারেই ভারতের রান হয়ে যায় ২৩। কিন্তু তৃতীয় বলেই স্কয়ার লেগে হেনরিখ ক্লাসেনের হাতে ধরা পড়েন ৫ বলে ৯ রান করে। এরপর দলপতির পথই অনুসরণ করলেন ঋষভ পান্তও! রোহিতের মতোই সুইপ করতে গিয়ে উইকেটের পেছনে ক্যাচ তুলে দিয়েছেন। এতে ৩ বলের মধ্যে ২ উইকেট নেই ভারতের। দলীয় ২৩ রানের মাথায় দুই উইকেট হারিয়ে বসে ভারত। কেশভ মহারাজ দুই উইকেট নিয়ে ভারতকে চাপে ফেলেন।
সেখান থেকে ১১ রান যোগ করতেই তৃতীয় উইকেটের পতন। কাগিসু রাবাদার করা ওভারের তৃতীয় বলে ফাইন লেগ দিয়ে মারতে গিয়ে ক্লাসেনের হাতে ধরা পড়েন সূর্যকুমার যাদব। এই বলে ঝুঁকি নিয়ে মারার দরকার ছিল না তার। কিন্তু আগ্রাসী ব্যাটিংয়ে প্রোটিয়াদের ওপর চাপ তৈরি করার চেষ্টা করতে গিয়ে উইকেটটি বিলিয়ে দিয়ে আসেন সূর্য। ৪ বল খেলে ৩ রান করেন তিনি।
৩৪ রানেই ৩ উইকেট হারানো ভারতের দলীয় সংগ্রহকে টেনে তুলেছেন বিরাট কোহলি ও অক্ষর প্যাটেল। চতুর্থ উইকেটে তারা দু'জন ৭২ রান সংগ্রহ করেন। দলীয় ১০৬ রানে অক্ষর প্যাটেল আউট হন। ৩১ বলে ৪৭ রান করার পখে ১টি চার ও ৪টি ছক্কা মারেন।
কোহলির সঙ্গে ব্যাট করতে নামেন শিভাম দুবে। পঞ্চম উইকেটে দলীয় ১৬৩ রানের মাথায় ৪৮ বলে ফিফটি করা কোহলি ৫৯ বলে ৬টি চার ও ২ ছক্কায় ৭৬ রানের ঝোড়ো ইনিংস খেলে আউট হন। জানসেনের করা ১৯তম ওভারের পঞ্চম বলে ওয়াইড লং অনে রাবাদার হাতে ক্যাচ দিয়ে আউট হন তিনি। এরপর ১৭৬ রানে শিভাম দুবে ও রবিন্দ্র জাদেজা আউট হন।
বল হাতে প্রোটিয়াদের কেশভ মহারাজ ৩ ওভারে ২৩ রান দিয়ে ২টি উইকেট নেন। ১টি করে উইকেট নেন মার্কো জানসেন, কাগিসো রাবাদা ও অ্যানরিখ নরকিয়া।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
ভারত:২০ ওভারে ১৭৬/৬ (রোহিত শর্মা ৯, ঋষভ পান্ত ০, সূর্য কুমার ৩, অক্ষর প্যাটেল ৪৭, শিভাব দুবে ২৭, রবিন্দ্র হার্দিক পান্ডিয়া ৫*, জাদেজা ২; মার্কো জানসেন ১/৪৯, কেশভ মহারাজ ২/২৩, কাগিসো রাবাদা ১/৩৬, এইডেন মার্করাম ০/১৬, অ্যানরিখ নরকিয়া ২/২৬, তাব্রেইজ শামসি ০/২৬)।
দক্ষিণ আফ্রিকা:২০ ওভারে ১৬৯/৮ (রেজা হেনড্রিকস ৪, কুইন্টন ডি কক ৩৯, এইডেন মার্করাম ৪, ট্রিস্টান স্টাবস ৩১, ক্লাসেন ৫২, ডেভিড মিলার ২১, মার্কো জানসেন ২, কেশভ মহারাজ ২*, কাগিসো রাবাদা ৪, অ্যানরিখ নরকিয়া ১*: অর্শ্বদিপ সিং ২/২০, জসপ্রিত বুমরাহ ২/১৮, অক্ষর প্যাটেল ১/৪৯, কুলদীপ ০/৪৫, রবিন্দ্র জাদেজা ০/১২, হার্দিক পান্ডিয়া ৩/২০)।
ফল:ভারত ৭ রানে জয়ী।
ম্যাচসেরা:বিরাট কোহলি।
সিরিজ সেরা : জসপ্রিত বুমরাহ।