কয়েকদিন টানা বৃষ্টিপাত না হওয়ায় মৌলভীবাজারের সীমান্তবর্তী ও হাকালুকি হাওড় তীরের কুলাউড়া, জুড়ী ও বড়লেখা এই তিনটি উপজেলার বন্যার পানি কিছুটা কমেছে। এতে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে কমেনি জনজীবনের দুর্ভোগ। আবার টানা বৃষ্টি হলে ও উজানের পাহাড়ি ঢলে বন্যার পানি বৃদ্ধির শঙ্কায় আছেন বন্যার্ত মানুষ। ফলে বন্যার পানি ধীরগতিতে কমলেও কমছে না বানভাসি মানুষের বিড়ম্বনা। এখনো বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পানিতে তলিয়ে আছে। বিশেষ করে হাকালুকি হাওড় তীরবর্তী এলাকায় পানি না কমায় দীর্ঘ জলাবদ্ধতায় রূপ নিয়েছে। এতে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন হাকালুকি হাওড়ের তীরবর্তী তিন উপজেলার বানভাসি মানুষ। বন্যাকবলিত হাকালুকি হাওড় তীরবর্তী এলাকার বিভিন্ন গ্রামের মানুষ তাদের খাদ্য সংকটের কথা জানিয়েছেন।
এ ছাড়াও জেলার হাওড় এলাকায় প্রায় ৩৮টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বন্যার পানি থাকায় ক্লাস চালু করা সম্ভব হয়নি বলে জানিয়েছেন জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার মো. ফজলুর রহমান।
হাওড়পাড় এলাকার বাসিন্দা আজিজুল ইসলাম, রফিক মিয়া, করিম মিয়া, আয়েশা বেগম ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, 'ত্রাণের জন্য রাত-দিন অপেক্ষায় থাকলেও এ পর্যন্ত সরকারি তরফে দুই ধাপে ১০ কেজি চাল ছাড়া কিছুই পাইনি। আর বেসরকারি সংস্থা ও ব্যক্তি উদ্যোগের ত্রাণ কেবল শুকনো খাবার, বিস্কুট, চিড়া, মুড়ি, গুড় পাচ্ছি; আর এসব খেয়ে আছি। বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে
এভাবে কত থাকা যায়? চিন্তা করে আর কিছু পাচ্ছি না।'
সরকারি-বেসরকারি কোনো মেডিকেল টিম এখনও তাদের দেখতে যায়নি। তাই তারা পানিবাহিত নানা রোগবালাই নিয়ে জীবন যাপন করছেন। বন্যায় তাদের আয়-রোজগার নেই। তাই এখন ঘরে চাল নেই, ভাত নেই, খাবার নেই এমনকি বিশুদ্ধ পানিও নেই। নেই স্যানিটেশন সুবিধাও। বাড়িফেরা আর পুনর্বাসনের দুশ্চিন্তায় তাড়া করছে আশ্রয়কেন্দ্রে ও অন্যত্র থাকা বানভাসিদের। কিন্তু তাদের অধিকাংশ বাড়িতে এখনও কোমর থেকে হাঁটু পর্যন্ত পানি। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে থাকা অনেকেই জানালেন ঈদের দিনও তারা অনাহারে-অর্ধাহারে ছিলেন। আর ওই সময় যারা বাড়িতে ছিলেন তারাও রাত-দিন পার করেছেন নানা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায়।
চরম অসহায় বন্যার্ত এ মানুষগুলোর এখন দু'চোখের জল যেন তাদের সান্ত্বনার ভাষা। তাদের মতো অসহায় ওই এলাকার গৃহপালিত পশুগুলোও। খাদ্য আর বাসস্থান হারিয়ে তারাও পড়েছে চরম সংকটে। খাদ্যহীন, গৃহহীন মানুষগুলোর দুর্ভোগ আর মানবেতর জীবন যাপন এখন তাদের নিত্যসঙ্গী। বানভাসি অসহায় মানুষগুলো রাত পোহালেই ত্রাণের আশায় পথের পানে চেয়ে থাকেন। কিন্তু তারা হতাশ হচ্ছেন। কারণ, তারা দুর্দিনে পাচ্ছেন না আশানুরূপ সাহায্য। সরকারি তরফে যে সহযোগিতা আসছে তা যেমন পর্যাপ্ত নয়। আর এবারের বন্যায় ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান কিংবা বিভিন্ন সংগঠনের উদ্যোগে ত্রাণ বিতরণও হচ্ছে কম।
মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসক উর্মি বিনতে সালাম জানান, এ জেলায় বছরে এক হাজার ৫০ মেট্রিক টন বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তার মধ্যে বন্যাকবলিত মানুষের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে ৯৩৪ মেট্রিক টন চাল আর বিভিন্ন সময়ে ৩৯ মেট্রিক টন বিতরণ করা হয়। বর্তমানে ত্রাণসামগ্রী ১১৬ মেট্রিক টন ও নগদ ২৫ হাজার টাকা মজুত আছে। ২০২৩-২৪ সালে অর্থবছরে মোট বরাদ্দ ৩০ লাখ টাকা নগদ সহায়তা এসেছে। তার মধ্যে উপজেলায় উপ-বরাদ্দ ৭ লাখ ১২ হাজার ৫০০ টাকা আর বন্যাকবলিত উপ-বরাদ্দ ১২ লাখ ৬২ হাজার ৫০০ টাকা রয়েছে। এছাড়া গো-খাদ্যের ক্রয়ের জন্য উপ-বরাদ্দ ৫ লাখ টাকা এবং শিশুখাদ্য ক্রয়ের জন্য উপ-বরাদ্দ ৫ লাখ টাকা।
তিনি আরও জানান, ইতিমধ্যে বন্যাকবলিত এলাকায় সরকারিভাবে প্রাপ্ত তিন হাজার ৫০০ প্যাকেট শুকনো খাবার আর উপজেলা প্রশাসনের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় দুই হাজার ৮০০ প্যাকেট বিতরণ করা হয়েছে। প্রতিটি আশ্রয়কেন্দ্রে বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করা হয়েছে। এখনও বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দেয়নি। ইতোমধ্যে ৭৫ হাজার পিস পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট ও ২৫০০টি খাবার স্যালাইন সরবরাহ করা হয়েছে।
জেলা প্রশাসক জানান, ৯২৯ বর্গকিলোমিটার এলাকায় ৪৮টি ইউনিয়নে ৫২০টি গ্রামে বন্যায় আক্রান্ত হয়েছেন ২ লাখ ৯৩ হাজার ৩৬৯ জন। ১২৬টি আশ্রয়কেন্দ্রে লোকসংখ্যা ৭ হাজার ৪৬৮ জন এবং ৫৪টি মেডিকেল টিম কাজ করছে। আশ্রয়কেন্দ্রে গবাদিপশুর সংখ্যা ৬৬৭টি। পুরো জেলায় বন্যা পরিস্থিতির দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
মৌলভীবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী জাবেদ ইকবাল জানান, কুশিয়ারা, ধলাই ও মনু নদীর পানি কমলেও জুড়ী নদীর পানি বিপৎসীমার ১৬৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। যার ফলে হাওড় এলাকায় বন্যার পানি ধীরগতিতে নামছে।
মৌলভীবাজার জেলার মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার মো. ফজলুর রহমান বলেন, 'জেলায় ৩৮টি মাধ্যমিক উচ্চবিদ্যালয় এখনও পানিতে ডুবে আছে। সদর উপজেলায় ২টি, বড়লেখা উপজেলায় ১৮টি, জুড়ী উপজেলায় ৮টি, কুলাউড়া উপজেলায় ১০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পানি থাকায় ক্লাস চালু করা সম্ভব হয়নি।'