মাগুরার শালিখা উপজেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত ফটকি নদীর কচুরিপানা বিবর্ণ হয়ে মারা যাচ্ছে। ৪৯ কিলোমিটার দীর্ঘ এ নদীর ভাটিতে অনেক আগে কচুরিপানা বিবর্ণ হলেও এ বছর প্রায় ২২ কিলোমিটার উজানের এ দৃশ্যে নদী তীরের বাসিন্দারা শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। কৃষি বিভাগ বলছে, জোয়ারের মাধ্যমে উঠে আসা সমুদ্রের লবণাক্ত পানির তীব্রতায় বদলাচ্ছে পরিবেশ, মারা যাচ্ছে কচুরিপানাসহ জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণী, বিভিন্ন প্রজাতির গাছও আগামরা ও পাতা কঙ্কালকরণ পোকার আক্রমণের শিকার হচ্ছে। মিঠাপানিতে লবণাক্ততার প্রভাব বেড়ে যাওয়া মানবস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এছাড়া কৃষি ও মৎস্য সম্পদের ওপর চরম হুমকি বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
শুধু মাগুরার ফটকি নয়, দেশের দক্ষিণাঞ্চল ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নদ-নদীতে লবণাক্ত পানির তীব্রতা দিন দিন বাড়ছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জোয়ার-ভাটার তারতম্যের কারণে সমুদ্রে জোয়ারের সময় উপকূলীয় ২২ জেলার নদীতে ছড়িয়ে পড়ত সামুদ্রিক লবণাক্ত পানি। তবে দক্ষিণাঞ্চলের বরিশালসহ মাগুরা, নড়াইল, যশোর, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, মেহেরপুর, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলার নদ-নদীগুলো মিঠাপানির উৎস হিসেবে পরিচিত। গত কয়েক বছর ধরেই এসব জেলার নদ-নদীতে লবণাক্ত পানির অস্তিত্ব পাওয়া যাচ্ছে। মিঠাপানির নদীতে জন্মানো কচুরিপানা মারা যাওয়া এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
পরিবেশবিদরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই এমন অবস্থার উদ্ভব ঘটেছে। উজানের পানির চাপ কমে যাওয়ার পাশাপাশি সমুদ্রের পানির উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় বরিশালের কীর্তনখোলা ও তেঁতুলিয়া ছাড়িয়ে মেঘনা নদীতে ঢুকে পড়েছে সমুদ্রের লবণাক্ত পানি। লবণাক্ত এই পানি দক্ষিণাঞ্চল ছাড়িয়ে উত্তরাঞ্চলেও প্রবেশের আশঙ্কা রয়েছে। মিঠাপানিতে লবণাক্ততার প্রভাব বেড়ে গেলে মৎস্য ও কৃষিসহ জীববৈচিত্র্যের ওপর এর বিরূপ প্রভাব পড়বে। ইতোমধ্যে এর প্রভাব স্পষ্ট হতে শুরু করেছে এসব অঞ্চলে। বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে এর প্রতিকারে উদ্যোগ
নেওয়া জরুরি বলে মক্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
এদিকে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও অভিঘাতে এসব অঞ্চলে বৃষ্টিপাত কমে গেছে। সরে গেছে বৃষ্টিপাতের মৌসুম। এসব অঞ্চলে বছরের দীর্ঘ সময় ধরে বিরাজ করছে অসহনীয় দাবদাহ। চলতি বছরও দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা দীর্ঘদিন ধরে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের চুয়াডাঙ্গা ও যশোরে বিরাজ করেছে।
সরেজমিন খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দক্ষিণ-পশ্চিমের খুলনা ও বাগেরহাট জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত ১৪২ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের পশুর নদীতে জোয়ারের সময় ভাটি থেকে লবণাক্ত পানি উঠে এলেও উজান থেকে নেমে আসা পানির তোড়ে ভাটার সময় মিঠা পানিতে পূর্ণ হয়ে যেত। কিন্তু গত কয়েক বছরে উজানের পানির চাপ না থাকায় লবণাক্ত পানির পরিমাণ বেড়েই চলেছে নদীতে। এছাড়া দক্ষিণ-পশ্চিমের জেলাগুলো দিয়ে প্রবাহিত ইছামতি-কালিন্দি, কচা, কপোতাক্ষ নদ, কুমার নদ (চুয়াডাঙ্গা), মাথাভাঙ্গা, কয়রা, কাটাখালী, গড়াই, গুনাখালি, চিত্রা, চন্দনা-বারাশিয়া, নবগঙ্গা, ফটকি, বিশখালী, বেগবতী, ভৈরব নদ, রূপসা, শিবসা ইত্যাদি মিঠাপানির জলাধার ইতোমধ্যে দখল করেছে লবণাক্ত পানি।
পরিবেশবাদী সংগঠন 'সবুজ' বরিশালের সংগঠক মো. মিজানুর রহমান জানান, 'উজানের পানি প্রবাহ হ্রাসের কারণে এবং সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ায় উপকূলের ২২তম জেলা ছাড়িয়ে লবণাক্ত পানি ২৩তম জেলা হিসেবে বরিশালের নদ-নদীতে প্রবেশ করেছে। এর প্রভাব হবে মারাত্মক। কৃষি ও জীববৈচিত্র্যের ওপর প্রভাব ফেলবে। বিশেষ করে নারী ও শিশুরা স্বাস্থ্যগত নানা সমস্যায় পড়বে।'
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সংগঠক মো. রফিকুল আলম জানান, কীর্তনখোলাসহ বরিশালের এবং দক্ষিণ-পশ্চিমের বিভিন্ন নদ-নদী লবণ পানির অনুপ্রবেশ ঘটেছে। উজানের পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় সাগরের নোনা পানি ধীরে ধীরে উজানের দিকে আসছে। এ ব্যাপারে এখনই সরকারকে সতর্ক ও সজাগ থাকতে হবে। লবণাক্ততার কারণে মিঠা পানির উৎস নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এতে কৃষি ও জলজ প্রাণীসহ জীববৈচিত্র্যের মারাত্মক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
খুলনা ও বরিশাল বিভাগীয় পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, বরিশাল ও দক্ষিণ-পশ্চিমের নানা নদীতে মাত্রাতিরিক্ত লবণপানি প্রবেশ করায় বিষয়টি ভাবিয়ে তুলছে। ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের ফেব্রম্নয়ারি পর্যন্ত কীর্তনখোলা নদীর ইলেকট্রিক্যাল কন্ডাক্টিভিটি খুবই কম ছিল। হঠাৎ করে চলতি বছরের মার্চে কীর্তনখোলা নদীর পানিতে ইলেকট্রিক্যাল কন্ডাক্টিভিটি অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। এটা দীর্ঘস্থায়ী হলে পরিবেশ ও প্রকৃতির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।
এমন পরিস্থিতিতে উজানের নদীর পানি প্রবাহ স্বাভাবিক রাখতে প্রয়োজনে ওই সব নদী খনন করে নাব্যতা বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন পরিবেশবিদরা।
পরিবেশ নিয়ে কাজ করা মাগুরার শামীম খান বলেন, 'উজানের পানির প্রবাহ কমে যাওয়ার কারণে অভ্যন্তরীণ নদ-নদীতে লবণাক্ত পানি প্রবেশ করছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে ভবিষ্যতে দেশের উত্তরাঞ্চলের নদী-নদীতেও সামুদ্রিক লবণাক্ত পানি ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।'
তিনি আরও বলেন, 'উজানের পানি প্রবাহ না থাকায় চুয়াডাঙ্গার মাথাভাঙ্গা নদী শুকিয়ে যাচ্ছে, ফটকি নদীর উজানে বেগবতী নদীর অনেক এলাকা এখন মাঠ। নদীর বুক চিরে আবাদ হচ্ছে ফসলের। ফরিদপুরের বোয়ালমারীর চন্দনা-বারাশিয়া নদী এখন শুকনো খাল, মাগুরার শ্রীপুরের ওপর দিয়ে প্রবাহিত কুমার নদও শ্রীহীন। নদীতে লবণাক্ত পানির উপস্থিতি ঠেকাতে প্রতিবেশী দেশের কাছ থেকে উজানের সব নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে।'
জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ছে এ অঞ্চলের কৃষি ও সার্বিক জীবনযাত্রার ওপর। দক্ষিণাঞ্চলের লবণাক্ততা ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়ে পশ্চিমাঞ্চলের এলাকাগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছে। বৃষ্টিপাত কমে যাওয়ায় নদ-নদীর পানিপ্রবাহ শুষ্ক মৌসুমে স্বাভাবিক মাত্রায় থাকে না। ফলে নদীর পানির বিপুল চাপের কারণে সমুদ্রের লোনাপানি যতটুকু এলাকাজুড়ে আটকে থাকার কথা ততটুকু থাকে না, পানির প্রবাহ কম থাকার কারণে সমুদ্রের লোনাপানি স্থলভাগের কাছাকাছি চলে আসে। দক্ষিণ-পশ্চিম যশোরে এমনটা দেখতে পাওয়া যায়, সেখানে শুষ্ক মৌসুমে গঙ্গার পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় লবণাক্ততা বৃদ্ধি পায়।
গবেষকরা বলছেন, এ অঞ্চলের ভূভাগের অনেক ভেতর পর্যন্ত লোনাপানি ইতোমধ্যেই ঢুকে পড়েছে। এই সমস্যা উপকূলীয় অঞ্চল থেকে যশোর, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর এবং কুমিলস্না পর্যন্ত উত্তর দিকে বিস্তৃত হয়েছে এবং আরো উত্তরে বিস্তৃত হতে পারে। চট্টগ্রাম শহর সন্নিকটের হালদা নদীর পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ বেড়ে ৮ পিপিটি হয়ে গেছে। এছাড়া খুলনার সুন্দরবনের অবস্থান এমন একটা জায়গায়, যা ত্রিভুজাকৃতির বঙ্গোপসাগরের শীর্ষবিন্দুতে গাঙ্গেয় মোহনায় অবস্থিত। এই গাঙ্গেয় মোহনার মহীঢাল খুব মসৃণভাবে সমুদ্রে নেমে গেছে। এর ফলে আন্দামান সাগরে উৎপন্ন জলঘূর্ণিঝড়গুলোর উত্তরমুখী যাত্রায় মহীঢালের অগভীরতার কারণে জলোচ্ছ্বাস অত্যন্ত উঁচু হয়ে আসে। সাগরের জোয়ারও অপেক্ষাকৃত উঁচু হয়। তাই সাগরের লোনাপানি ঢুকে পড়ে উপকূলভাগে, লবণাক্ত করে তোলে ভূ-অভ্যন্তরের পানিও। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় ইতোমধ্যেই সুন্দরবনের সুন্দরী গাছে ব্যাপক মাত্রায় আগামরা রোগ দেখা দিয়েছে। সুন্দরবনের বুড়িগোয়ালিনী রেঞ্জ ইতোমধ্যেই পানির উচ্চতাজনিত কারণে লবণাক্ততার শিকার। এদিকে ননিয়ানরেঞ্জ আক্রান্ত হওয়ার মুখে।
মাটিতেও লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় সাতক্ষীরা-আশাশুনি সড়কের দুই পাশের সারি সারি রেইনট্রি গাছ ইতোমধ্যে মারা গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গাছগুলো মারা যাওয়ার অনেক কারণের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মাটির লবণাক্ততা ও ক্ষার বেড়ে যাওয়া। তাছাড়া প্রত্যেক গাছের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৃষ্টিপাত কমে গেছে। মৌসুমি বৃষ্টি না হলে রেইনট্রি গাছ খাদ্য সংকটে পড়ে। এছাড়া বিভিন্ন ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েও গাছ মরে যেতে পারে।
চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মানুষের শরীরে নির্দিষ্ট পরিমাণ লবণের প্রয়োজন এবং সেটি আসে খাদ্য ও পানি থেকে। কিন্তু বর্তমানে পানিতে লবণের পরিমাণ অনেকগুণ বেশি। এই পানি শরীরে প্রবেশ করলে স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়ে যায়। বিশেষ করে গর্ভবতী নারীদের জন্য তা হয়ে ওঠে আরও বেশি বিপজ্জনক। গর্ভাবস্থায় নারীরা বেশি লবণাক্ত পানি খেলে খিঁচুনি ও উচ্চ রক্তচাপ হয়। এ কারণে নারীদের গর্ভাবস্থায় সন্তান মারা যাওয়ার হারও বেশি, যা বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
এদিকে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণাকেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর,বি) এক গবেষণায় বলা হয়েছে, লবণাক্ততার কারণে উপকূলের নারীরা শুধু অকাল গর্ভপাতেরই শিকার হন না, ৩ শতাংশ শিশুও মারা যায়। এছাড়া বেশি লবণ খাওয়ার সঙ্গে উচ্চ রক্তচাপের সম্পর্ক রয়েছে, যা হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। লবণাক্ততা কমাতে ভূগর্ভস্থ পানির উচ্চতা ৮-১০ ফুট নিচে থাকা উচিত।
যদিও কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, লবণাক্ততার সম্ভাবনাকেও কাজে লাগানো যেতে পারে। লবণ সহ্য করতে পারে এমন ধান ব্রি ধান-৪৭ এবং বিনা ধান-৮ কৃষক পর্যায়ে রয়েছে। এ ধান সর্বোচ্চ ১২ ডিএস-এম মাত্রার লবণ সহ্য করতে পারে। তবে পরিবেশবিদরা বলছেন, দেশের উপকূল অঞ্চলে যে হারে লবণাক্ততা দিন দিন বেড়ে চলেছে সেই হারে প্রতিকারের ব্যবস্থা নেই। বরং কৃত্রিম উপায়ে উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ত পানি আটকিয়ে বাগদা চিংড়ি চাষের ফলে লবণাক্ততা আরও বাড়ছে। এ পরিস্থিতিতে যত দ্রম্নত লবণাক্ততা দূরীকরণে সমন্বিত ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায় ততই মঙ্গলজনক।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দক্ষিণ-পশ্চিমের ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর গত ৩০ বছরের তুলনায় অনেক নিচে নেমে গেছে। এসব অঞ্চলের গভীর নলকূপ থেকে শুষ্ক মৌসুমে পানি উঠছে না। সুপেয় পানির অন্য উৎসগুলোয় লবণাক্ততা ছড়িয়ে পড়েছে। আবার লবণ পানি পরিশোধন করতে যে ফিল্টারগুলো বসানো হয়েছিল সেগুলো অকেজো হয়ে পড়ায় দুষ্কর হয়ে পড়েছে বিশুদ্ধ পানি সংগ্রহ। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অপরিকল্পিতভাবে ভূ-গর্ভের পানি উত্তোলন এবং লবণাক্ততার সমস্যা দূর করতে সরকারি বেসরকারি পর্যায়ে যেসব উদ্যোগ হাতে নেওয়া হয়েছে সেগুলো তদারকি না করার ফলে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে মত বিশেষজ্ঞদের।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলের জেলা পর্যায়ের তথ্য অনুযায়ী, খুলনার ২২ শতাংশ, বাগেরহাটের ১৫ শতাংশ এবং সাতক্ষীরার ১৩ শতাংশ মানুষ খাবার পানির সংকটে রয়েছে। সরকারিভাবে এই তথ্য দেওয়া হলেও বাস্তবের চিত্র আরও ভয়াবহ বলছেন পরিবেশবাদীরা।