মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে প্রথম মুখোমুখি বিতর্ক

বাইডেন শিবিরে হতাশা চনমনে ট্রাম্প শিবির

প্রকাশ | ২৯ জুন ২০২৪, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে প্রথম মুখোমুখি টেলিভিশন বিতর্কে অংশ নেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প -ইন্টারনেট
মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে প্রথম মুখোমুখি টেলিভিশন বিতর্কে অংশ নিয়েছেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। বিতর্কে যোগ দিয়ে একে অন্যকে লক্ষ্য করে আক্রমণ ও পাল্টা আক্রমণ করেছেন নির্বাচনের দুই প্রধান প্রার্থী। অবশ্য বিতর্কের এই আক্রমণ এক সময় ব্যক্তিগত পর্যায়ে চলে যায়। এদিকে, বিতর্কে বাইডেন ভালো করতে পারেননি, এমনটি ধারণা করছেন তার নিজ দল ডেমোক্রেটিক পার্টির সদস্যরা। এ নিয়ে দলের মধ্যে হতাশা দেখা গেছে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের বিশ্লেষণে উঠে এসেছে, বাইডেনের বিতর্ক শীর্ষস্থানীয় ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে বিপদঘণ্টা বাজিয়ে দিয়েছে। অন্যদিকে বিতর্ক শেষ হওয়ার আগেই ট্রাম্পের প্রচারশিবির তার জয় দাবি করেছে। আর বিতর্কের পর রিপাবলিকান শিবির হয়ে উঠেছে চনমনে। খবর: বিবিসি, রয়টার্স ও সিএনএন। সিএনএন প্রতিবেদনে উলেস্নখ করা হয়েছে- মার্কিন কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ রিপাবলিকান দলের নেতা স্টিভ স্কালিস এক বিবৃতিতে বলেছেন, ট্রাম্প বিতর্কে জয়ী হয়েছেন। বাইডেন আরেক মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হওয়ার উপযুক্ত নন। ট্রাম্পই আগামী ৫ নভেম্বরের নির্বাচনের একমাত্র পছন্দের প্রার্থী। যদিও বাইডেন মনে করেন, তিনি ভালোই করেছেন। একই সঙ্গে বলেন, একজন মিথ্যাবাদীর সঙ্গে বিতর্ক করা কঠিন। মুখোমুখি এই টেলিভিশন বিতর্কে দুই নেতা পররাষ্ট্রনীতি, অর্থনীতি, সীমান্ত ইসু্য, সামাজিক নিরাপত্তা, চাইল্ড কেয়ার, কংগ্রেস ভবনে হামলার ঘটনা এবং গর্ভপাতসহ বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলার সময় তারা একে-অন্যের বিরুদ্ধে মিথ্যা বলার অভিযোগ আনেন এবং পরস্পরকে তীব্র বাক্যবাণে জর্জরিত করার চেষ্টা করেন। ট্রাম্পের সাবেক উপদেষ্টারা বিতর্কের সময় তার (ট্রাম্প) নৈপুণ্য উদযাপন করেছেন। বাইডেনের প্রতিক্রিয়া তারা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন। ডেমোক্র্যাটদের দিক থেকে আসা ব্যাপক উদ্বেগের দিকটিও তাদের নজরে এসেছে। ডেমোক্র্যাটিক পার্টির নেতাদের কেউ কেউ মনে করছেন, ট্রাম্পকে শক্তভাবে মোকাবিলা করতে পারেননি বাইডেন। এই সুযোগে ট্রাম্প অনর্গল মিথ্যা বলে গেছেন। সিএনএন জানিয়েছে, বাইডেন প্রশাসনের ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস নিজেও স্বীকার করেছেন, ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী (বাইডেন) ধীরগতিতে শুরু করেছিলেন। তবে পরে দৃঢ়ভাবে বিতর্ক শেষ করতে পেরেছেন। ভোটারদের বাইডেনের কৃতিত্বের দিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত, বিতর্কের দিকে নয়। আসন্ন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বাইডেন লড়বেন ডেমোক্রেটিক পার্টির হয়ে। আর রিপাবলিকান পার্টির হয়ে লড়বেন ট্রাম্প। যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার রাতে (বাংলাদেশ সময় শুক্রবার সকাল ৭টায়) সিএনএনের আটলান্টা স্টুডিওতে বিতর্কে অংশ নেন বাইডেন ও ট্রাম্প। চার বছর পর তারা প্রথমবারের মতো মুখোমুখি বিতর্কে অংশ নেন। বিতর্ক মঞ্চে উঠলে প্রথা অনুসারে করমর্দন করেননি তারা। প্রায় দেড় ঘণ্টার বিতর্কে ট্রাম্প ৪০ মিনিট ১২ সেকেন্ডের মতো কথা বলেন। অন্যদিকে বাইডেন কথা বলেন ৩৫ মিনিট ৪১ সেকেন্ড। বিতর্কে ডোনাল্ড ট্রাম্প অর্থনীতি সামলানো, পররাষ্ট্রনীতির রেকর্ড ও ব্যাপক সংখ্যক অভিবাসীর বিষয়ে জো বাইডেনের তীব্র সমালোচনা করেন। আর আদালতে সম্প্রতি ট্রাম্পের সাজার প্রসঙ্গ তুলে তাকে 'গণতন্ত্রের জন্য হুমকি' বলে উলেস্নখ করেন। ট্রাম্প বিতর্ক শেষ করেছেন এই বলে যে আমেরিকার মানুষ এখন জাহান্নামে বাস করছে। 'সাড়ে তিন বছর ধরে আমরা জাহান্নামে বাস করছি।' আর শেষ বক্তব্যে বাইডেন আমেরিকানদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ইসু্য মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনার প্রতিশ্রম্নতি দেন এবং বলেন যে তিনি কর কমিয়ে আনতে চান। একই সঙ্গে দাবি করেন যে ট্রাম্প কর বাড়িয়ে দেবেন। পর্ন তারকা স্টর্মি ড্যানিয়েলসের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টি তুলে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে আক্রমণ করেন বাইডেন। তার আগে ট্রাম্প সম্প্রতি জো বাইডেনের ছেলে হান্টার বাইডেনের বন্দুক আইনে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার বিষয়টি তুলেছিলেন। অর্থনীতি মার্কিন অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে একে-অপরকে দোষারোপ করেন। বাইডেন দাবি করেন, তিনি ট্রাম্পের রেখে যাওয়া নাজুক অর্থনীতি পেয়েছেন। অন্যদিকে ট্রাম্পের দাবি, বাইডেন উত্তরাধিকার সূত্রে একটি ভালো অর্থনীতি পেয়েছেন। সীমান্ত সংকট বাইডেনের কাছে প্রশ্ন রাখা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্ত সংকটে কেন ভোটাররা তার ওপর আস্থা রাখবেন। জবাবে বাইডেন বলেন, মার্কিন কংগ্রেসে একটি দ্বিদলীয় সীমান্ত বিল পাস করার জন্য তার প্রশাসন অনেক চেষ্টা করেছে। অভিবাসন নিয়ে ট্রাম্পের আমলের নানা পদক্ষেপের সমালোচনা করেন বাইডেন। তিনি বলেন, তখন এমন একটি পরিস্থিতি দেখা যায়, যেখানে অভিবাসনপ্রত্যাশী মায়েদের কাছ থেকে তাদের শিশুদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। শিশুদের আলাদা করছিলেন। শিশুদের খাঁচায় রাখছিলেন। পরিবারগুলোর পৃথককরণ নিশ্চিত করেছিলেন। এটা সঠিক উপায় নয়। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রে সহিংস অপরাধের জন্য বাইডেনের অভিবাসননীতিকে দায়ী করেন ট্রাম্প। ক্যাপিটল হিলে হামলা ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি মার্কিন কংগ্রেস ভবন ক্যাপিটল হিলে হামলার জন্য ট্রাম্পকে দায়ী করেন বাইডেন। তিনি বলেন, ক্যাপিটল হিলে যেতে লোকজনকে উৎসাহিত করেছিলেন ট্রাম্প। তিনি বসে বসে সেদিনের ঘটনা দেখেছেন। ট্রাম্প বলেন, সেদিন তার কার্যত কিছুই করার ছিল না। গাজা যুদ্ধ ইসরাইল ও হামাসের মধ্যকার যুদ্ধের অবসান ঘটাতে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে সমর্থন করবেন কি না, এই প্রশ্নে সরাসরি কোনো উত্তর দেননি ট্রাম্প। বাইডেনকে প্রশ্ন করা হয়, এই যুদ্ধ শেষ করতে তিনি কী করবেন। উত্তরে বাইডেন বলেন, হামাসই এই যুদ্ধের শেষ চায় না। বাইডেন ইসরাইলের প্রতি তার জোরালো সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেন। ইউক্রেন যুদ্ধ বিতর্কে ইউক্রেন যুদ্ধের প্রসঙ্গ উঠে আসে। বাইডেন বলেন, তিনি মনে করেন, রুশ প্রেসিডেন্ট ভস্নাদিমির পুতিন একজন যুদ্ধাপরাধী। তিনি পুরনো সোভিয়েত সাম্রাজ্য আবার প্রতিষ্ঠা করতে চান। ইউক্রেনকে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থের চেয়ে বেশি অস্ত্র দেওয়ার কথা জোরালোভাবে বলেন বাইডেন। আর ট্রাম্প বলেন, তিনি নির্বাচনে জিতলে ইউক্রেনে যুদ্ধ থামাবেন। ইউক্রেনে যুদ্ধ বন্ধে পুতিনের শর্ত নিয়ে ট্রাম্পকে প্রথমে একবার প্রশ্ন করেন সঞ্চালক। প্রথমবার ট্রাম্প উত্তর এড়িয়ে যান। এরপর দ্বিতীয়বার ট্রাম্পকে প্রশ্ন করা হয়, পুতিনের শর্তগুলো তার কাছে গ্রহণযোগ্য কি না? জবাবে ট্রাম্প বলেন, গ্রহণযোগ্য নয়। মামলা ট্রাম্পের ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হওয়া নিয়ে তাকে তীব্র আক্রমণ করেন বাইডেন। তিনি ট্রাম্পের নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। এ নিয়ে তিনি ট্রাম্পকে 'কটূক্তি' করেন। ট্রাম্পকে একজন দোষী সাব্যস্ত অপরাধী হিসেবে উলেস্নখ করেন বাইডেন। বিতর্কের এক পর্যায়ে বাইডেন বিভিন্ন অপরাধের অভিযোগে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে যে একাধিক মামলা রয়েছে, সে প্রসঙ্গ উলেস্নখ করেন। প্রকাশ্যে এক নারীকে যৌন নিপীড়নের দায়ে ট্রাম্পকে যে আদালত জরিমানা করেছেন, সে কথা তোলেন বাইডেন। ট্রাম্প বিস্তর অপরাধ করেছেন বলে বাইডেন অভিযোগ করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ট্রাম্প রাতে এক পর্ন তারকার সঙ্গে যৌন সম্পর্ক করেন, অথচ তখন ঘরে তার স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। বয়স বয়স নিয়ে বাইডেন বলেন, ট্রাম্প তার চেয়ে মাত্র কয়েক বছরের ছোট। তবে তিনি (ট্রাম্প) অনেক কম দক্ষ। বাইডেন ভোটারদের ট্রাম্পের রেকর্ড দেখার জন্য আহ্বান জানান। প্রতিক্রিয়ায় বাইডেনের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে ট্রাম্প দু'জনের জ্ঞানীয় ক্ষমতার পরীক্ষার কথা বলেন। এদিকে সংবাদ সংস্থা বিবিসি এক প্রতিবেদনে দুই নেতার বিতর্কের পর পর্যবেক্ষকদের মতামত তুলে ধরেছেন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাটদের যারা মনোযোগ দিয়ে বিতর্ক দেখেছেন তারা অনেকেই তাদের প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন। সাবেক ডেমোক্র্যাট কংগ্রেসওম্যান স্টেফাইন মারফি বলেছেন, কিছু মুহূর্ত ছিল যেখানে বাইডেন তার বয়স তুলে ধরেছেন। 'তাকে বোঝাটা কষ্টসাধ্য ছিল।' অন্যদিকে তার মতে ডোনাল্ড ট্রাম্প কিছু মন্তব্য করেছেন যা 'সত্যি নয়' এবং এগুলো সত্যতা যাচাই করা উচিত। তিনি জানান, তার উদ্বেগের জায়গা হলো নির্বাচনের ফল গ্রহণ করবেন কি না তা বলতে ডোনাল্ড ট্রাম্প অনীহা দেখিয়েছেন। সাবেক রিপাবলিকান কংগ্রেসওম্যান রোডনি ডেভিস বলেছেন, বিতর্কটি ছিল 'ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরিষ্কার জয়'। 'আমেরিকাজুড়ে ডেমোক্র্যাটদের জন্য দুঃখজনক বিতর্কের ধরনটি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে সহায়তা করেছে'-বলেছেন তিনি। মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রফেসর কোরউইন স্মিডট বলেছেন, বাইডেন তার অনেক দুর্বলতা দেখিয়েছেন এবং খুব বেশি শক্তির জায়গা দেখাননি। ভিজু্যয়াল, কণ্ঠ ও জবাব দেওয়ার গতির কারণে তাকে অনুসরণ করাটা কঠিন ছিল। 'অনেক তথ্যভিত্তিক জবাব ও পয়েন্ট প্রেসিডেন্ট বাইডেন দিয়েছেন। কিন্তু বলার ধরনের কারণে সেগুলো দ্রম্নত হারিয়ে গেছে'- উলেস্নখ করেন তিনি।