ভরা মৌসুমে এবার আমের বাজার কিছুটা অস্বাভাবিক। দাম গত বছরের চেয়ে দ্বিগুণ। হিমসাগর, ল্যাংড়া, আম্রপালি, ফজলিসহ কোনো জাতের আমই মিলছে না প্রতি কেজি ১২০ টাকার নিচে। ভালোমানের হলে খুচরায় গুনতে হচ্ছে আরও বেশি। এবার আম প্যাকেজিং ও উড়োজাহাজ ভাড়াও বাড়তি। দেশে চড়া দামের কারণে মুনাফা কমেছে রপ্তানিকারকদের। শঙ্কায় রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা পূরণ।
এ বছর আমের দাম বাড়ার বিষয়টি ওঠে এসেছে সরকারি কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের তথ্যেও। সংস্থাটি বলছে, গত বছর জুনে পাইকারিতে প্রতি কেজি হিমসাগর আমের দাম ছিল ৪১ টাকা। এ বছর তা ৭৯ টাকা ৩২ পয়সা। প্রতি কেজি ল্যাংড়ার দাম ৩৯ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৮০ টাকা ৮৬ পয়সা এবং গত বছরের ৪৩ টাকা কেজির আম্রপালি এবার পাইকারিতে বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ ৭২ টাকা ৫৮ পয়সায়।
বুধবার ঢাকার বিভিন্ন বাজার ও এলাকা ঘুরে দেখা যায় একই চিত্র। বাজারভেদে খুচরায় এখন প্রতি কেজি হিমসাগর বিক্রি হচ্ছে মানভেদে ১৪০ থেকে ১৮০ টাকা। ল্যাংড়া ১০০ থেকে ১৪০, আম্রপালি ১২০ থেকে ১৪০ এবং ফজলি আম বিক্রি হচ্ছে ১২০ থেকে ১৪০ টাকা কেজি দরে।
ঢাকার পাইকারি ব্যবসায়ীদের ভাষ্য, এবার দাম গত বছরের দ্বিগুণ। এরপর ঈদের পরে বিভিন্ন মোকামে লাফিয়ে বাড়ছে আমের দাম। যেখানে ভরা মৌসুমে আমের দাম কমার কথা ছিল, সেখানে ঈদের আগে-পরে মোকামে আমের দাম বেড়েছে মণে প্রায় এক হাজার টাকা।
পাইকারি ব্যবসায়ীর পাশাপাশি আম উৎপাদনকারী, সরকারি সংস্থার কর্মকর্তা, বাজার পর্যবেক্ষক ও গবেষকরা বলছেন, প্রধানত এবার আমের উৎপাদন কম হওয়ায় দাম বেশি। দীর্ঘ শীতের কারণে আমের মুকুল আসতে দেরি হয়েছে। এরপর এপ্রিলে শুরু হয় তীব্র তাপপ্রবাহ। এতে মুকুল-আমের গুটি ঝরে যায় বিভিন্ন এলাকায়। শেষে এবার শিলাবৃষ্টি ও ঝড় না হওয়ায় যতটুকু আম ছিল, তা আছে। সব মিলিয়ে আমের ফলন গত মৌসুমের চেয়ে অনেক কম।
কৃষি সম্প্র্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, গত বছরের চেয়ে এ বছর ফলন ১৫ থেকে ২০ শতাংশ কম হয়েছে। তবে বাগান মালিকরা বলছেন, ফলন কমেছে এক-তৃতীয়াংশের বেশি।
এছাড়া দেরিতে মুকুল আসা, অনাবৃষ্টির কারণে উৎপাদন খরচ অনেক বেড়েছে। সবচেয়ে বেশি আম উৎপাদনকারী এলাকা নওগাঁর অনেক বাগানে এবার আম হয়নি। ওই এলাকার সাপাহারের উৎপাদনকারী সিরাজুল ইসলাম বলেন, 'চারটি বাগানে যে উৎপাদন হয়েছে তা গত বছরের চেয়ে অর্ধেক। অনেক গাছে ফল আসেনি। প্রথমে যা এসেছিল, পরে ঝরে গেছে।'
তিনি বলেন, 'তীব্র
তাপপ্রবাহের কারণে সেচ দিতে বিঘাপ্রতি খরচ গতবারের চেয়ে দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা বেশি লেগেছে। সারের দামসহ অন্য কৃষি উপকরণের দামও বেড়েছে। এছাড়া সার্বিক মূল্যস্ফীতির কারণে কম দামে শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। কম উৎপাদন ও বেশি খরচের কারণে আমের দাম বেড়েছে।'
বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ড. মো. মেহেদী মাসুদ বলেন, 'আমের উৎপাদন কমার কারণে এবার সমস্যা হচ্ছে। উৎপাদন কমার প্রথম কারণ, এবার আমের অফ-ইয়ার। অর্থাৎ প্রাকৃতিকভাবেই এক বছর আম বেশি হলে পরের বছর কম হয়, অফ-ইয়ার বলা হয় ওই বছরকে।'
'দ্বিতীয়ত, আবহাওয়ার বিরূপ প্রভাব। তীব্র তাপপ্রবাহে প্রচুর আম ঝরে গেছে। এরপর আর বৃষ্টি হয়নি, তাতে যে আমগুলো ছিল সেটাও বড় হয়নি। এবার আমের সাইজও ছোট। ফলন কমেছে, যা প্রায় ২০ শতাংশ পর্যন্ত। এ বছর বাসাবাড়ি ও রাস্তাঘাটের সাধারণ গাছেও (অস্থায়ী বাগান) আম খুব কম হয়েছে। কারণ মুকুল আসার সময় প্রচন্ড শীত ছিল। যে কারণে কুশি এসেছে, পাতা হয়েছে, মুকুল হয়নি।'
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরো (বিবিএস) বলছে, বাংলাদেশে ২০২২-২৩ সালে ১ লাখ ২৩ হাজার ৯৯৮ হেক্টর জমি থেকে ১৪ লাখ ৮২ হাজার টন আম উৎপাদন হয়। হেক্টরপ্রতি গড় ফলন ছিল প্রায় ১২ টন। যদিও কৃষি সম্প্র্রসারণ অধিদপ্তর দাবি করে, দেশে গত বছর ২ লাখ হেক্টর জমিতে সাড়ে ২৪ লাখ টন আম উৎপাদন হয়েছিল।
আমের উৎপাদন গত কয়েক বছর ধারাবাহিকভাবে যে বেড়েছে তাতে দুই সংস্থার তথ্যে কোনো বিভেদ নেই। দুই সংস্থার হিসাবই বলছে, প্রতি বছর আমের উৎপাদন বাড়ছে। বিবিএসের হিসাবে, ২০০০-০১ সালে দেশে ৫০ হাজার ৬২৬ হেক্টর জমি থেকে ১ লাখ ৮৭ হাজার টন আম উৎপাদন হয়, যেখানে হেক্টরপ্রতি গড় ফলন ছিল ৩ দশমিক ৭৭ টন। গত ২৩ বছরে দেশে আম চাষের জমির পরিমাণ ২ দশমিক ৪৫ গুণ, উৎপাদনের পরিমাণ প্রায় ১২ গুণ এবং হেক্টরপ্রতি গড় ফলন ৩ দশমিক ১৭ গুণ বেড়েছে।
প্রতি বছর উৎপাদন বাড়ার কারণে দাম ক্রমান্বয়ে কমেছিল। তখন নিম্নআয়ের পরিবারগুলো আম খাওয়ার সুযোগ পেয়েছে, যা কাঁঠাল, কলা, লিচু ও পেঁয়ারার মতো ফলের তুলনায় বেশি ছিল বলে মনে করা হয়। বিবিএসের খানা আয়-ব্যয় জরিপ-২০২২ অনুযায়ী, ২০২২ সালে দেশের একজন মানুষ প্রতিদিন গড়ে ৯৫ দশমিক ৪ গ্রাম ফল খেয়েছেন, যা ২০১০ সালে ছিল ৪৪ দশমিক ৭ গ্রাম।
আম রপ্তানি নিয়ে শঙ্কা
গত কয়েক বছর উৎপাদন বাড়ায় আম রপ্তানিতে ভালো করছে বাংলাদেশ। এ বছরও আম রপ্তানি শুরু হয়েছে। এবার ৩ হাজার ১০০ টন আম রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে। বিশ্বের ৩৮টি দেশে এসব আম রপ্তানি করা সম্ভব হবে বলে আশা করছে কৃষি মন্ত্রণালয়। এবার বাংলাদেশ থেকে ইংল্যান্ড, জার্মানি, ইতালি ও ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশে গোপালভোগ, হিমসাগর, আম্রপালি, ফজলি, সুরমা ফজলি, বারি-৪ জাতের আম যাচ্ছে। গত বছর বিশ্বের ৩৮টি দেশে ৩ হাজার ৯২ টন আম রপ্তানি করা হয়েছিল।
এবার দেশে আমের বেশি দামের কারণে রপ্তানিতেও সমস্যা হতে পারে বলে মনে করছেন বাংলাদেশ ফ্রুটস, ভেজিটেবলস অ্যান্ড অ্যালাইড প্রোডাক্ট এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা। সংগঠনটির উপদেষ্টা মো. মনজুরুল ইসলাম বলেন, 'এবার স্থানীয় বাজারে আমের দাম বেশি, রপ্তানিতে এর প্রভাব পড়বে। প্যাকেজিং ও উড়োজাহাজের ভাড়া বেড়েছে। এসব কারণে রপ্তানিকারকদের মুনাফা কমছে।'
তিনি বলেন, 'গত বছরের চেয়ে এবার রপ্তানি কমতে পারে। গত বছর এ সময় যেভাবে রপ্তানি হতো, এবার এখন পর্যন্ত তেমন হচ্ছে না। যদিও সরকার ও আমরা চেষ্টা করছি যত বেশি রপ্তানি করা যায়।'
কৃষি সম্প্র্রসারণ অধিদপ্তরের রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদন প্রকল্পের পরিচালক মোহাম্মদ আরিফুর রহমান বলেন, 'আমের দামের চেয়ে বড় সমস্যা এবার উড়োজাহাজের ভাড়া। তবে বিদেশে এবার প্রচুর আমের চাহিদা রয়েছে। রপ্তানিকারকের সংখ্যাও বেড়েছে। যে কারণে রপ্তানি কমবে বলে আমি মনে করছি না।'