ঈদের পর ফের অস্থির দেশের ডিমের বাজার। গত দু-সপ্তাহ ধরে সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে অতিপ্রয়োজনীয় এই ভোগ্যপণ্যের দাম লাগামহীন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একটি চক্র পরিকল্পিতভাবে কয়েক স্তরে গোটা দেশের ডিমের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে।
প্রথম স্তরে বাজার চাহিদার ওপর ভিত্তি করে খামারিদের কাছ থেকে কম দামে ডিম সংগ্রহ করে মজুদ, পরে বাজারে সরবরাহ সংকট দেখিয়ে বাড়তি দামে ডিম বিক্রি করা হয়। পুরো প্রক্রিয়ার মধ্যে জড়িত রয়েছে স্থানীয় আড়তদার থেকে শুরু করে কোল্ড স্টোরেজ মালিকরা। অভিযোগ রয়েছে, তেজগাঁও ডিম ব্যবসায়ী সমিতি পুরো সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। তাদের এসএমএসের (খুদে বার্তা) ভিত্তিতেই খামারি ও পাইকারি পর্যায়ে দাম নিয়ন্ত্রিত হয়।
এদিকে চলতি সপ্তাহে রেকর্ড ১৬৫ টাকা বিক্রি হয়েছে ডিমের ডজন। এতে বাজারে রীতিমতো নাজেহাল সাধারণ ভোক্তারা। এই দামে চাহিদা অনুযায়ী ডিম কিনতে পারছে না বেশিরভাগ ক্রেতা।
এর আগে ২০২২ সালে কোরবানির ঈদের পর ডিমের ডজন প্রথমবারের মতো ১৫০ টাকা উঠেছিল। যা গত বছর
এ সময় ১৫৫ টাকা। এবার সে রেকর্ড ভেঙে ডিমের ডজন ছুঁয়েছে ১৬৫ টাকা কোনো কোনো বাজারে বিক্রি হয়েছে ১৭০ টাকা দরে। বুধবার দাম কিছুটা কমলে ডজন বিক্রি হয়েছে ১৬০ টাকার ওপর। আর হালি কিনতে গুনতে হয়েছে ৬০ টাকা পর্যন্ত। বাজারে এমন অস্থিরতার জন্য ডিম ব্যবসায়ী সমিতি ও করপোরেট কোম্পানিগুলোর কারসাজিকে দুষছেন খামারি ও পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন নেতারা।
অন্যদিকে ক্রেতাদের প্রশ্ন, একটা ডিমের দাম কিভাবে ১৫ টাকা হয়? তারা জানান, ঈদের আগে বাজার মোটামুটি স্বাভাবিক হয়েছিল। কিন্তু ঈদের পর সরবরাহ থাকা সত্ত্বেও একটা ডিমে ৩ থেকে ৪ টাকা পর্যন্ত বাড়তি নেওয়া হচ্ছে। এই দামে তো বাচ্চাদের দিনে ১টা ডিম খাওয়ানোর পরিস্থিতিও আমরা হারিয়ে ফেলছি বলেও ক্ষোভ প্রকাশ করেন ভোক্তারা।
প্রান্তিক খামারিরা বলছেন, ডিমের করপোরেট ব্যবসায়ী ও আড়তদারদের পুরনো চক্র সক্রিয় হয়ে ওঠায় বাজারে এ অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। এ নিয়ে বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএ) দাবি করেছে, সারাদেশে হঠাৎই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ডিমের বাজার অস্থির হয়েছে। এর নেপথ্যে রয়েছে রাজধানীর তেজগাঁও ডিম ব্যবসায়ী সমিতির কারসাজি। কারণ তারাই সারাদেশের ডিমের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে।
বিপিএ সভাপতি মো. সুমন হাওলাদার বলেন, 'ডিম ব্যবসায়ী সমিতি এবং করপোরেট কোম্পানিগুলোর কারসাজিতে হুটহাট বাজার অস্থির হয়ে উঠেছে। ক্ষুদ্র খামারিরা যখন ডিম উৎপাদন করেন, তখন করপোরেট প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রিক চক্র দাম কমিয়ে রাখে। এ অবস্থায় প্রান্তিক খামারিরা উৎপাদনে টিকে থাকতে পারেন না। তখন ক্ষুদ্র খামারিরা উৎপাদন কমিয়ে দিলে এ অসাধু চক্র ইচ্ছামতো দাম বাড়ায়। সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে নিঃস্ব হচ্ছেন প্রান্তিক খামারিরা।'
তিনি আরও বলেন, করপোরেট কোম্পানি থেকে আড়তে, সেখান থেকে খামারি ও ব্যবসায়ীদের মোবাইল ফোনে এসএমএস পাঠিয়ে এবং ফেসবুকে পোস্ট করে ডিমের বাড়তি বা কম দাম বাস্তবায়ন করে তেজগাঁও ডিম ব্যবসায়ী সমিতি। আর সারাদেশেই এ দামে তখন বেচাকেনা চলে। তারা ইচ্ছামতো ডিমের দাম কমিয়ে কোল্ড স্টোরেজে জমা করে এবং পরবর্তী সময়ে সেই ডিমই আবার বাড়তি দামে বাজারে ছাড়া হয়।
এদিকে বুধবার রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে প্রতি ডজন ডিম বিক্রি হয়েছে ১৫৫ থেকে ১৬০ টাকায়, যা পাড়া-মহলস্নার দোকানে বিক্রি হয়েছে ১৬৫ টাকার ওপর। আর ডিমের হালি বিক্রি হয়েছে ৬০ টাকা দরে।
খুচরা বিক্রেতারা জানান, এ সপ্তাহের শুরুতে বাজারে ডিমের সরবরাহ কম ছিল তাই বেশি দামে ডিম কিনে বিক্রি করতে হয়েছে। তবে মঙ্গলবার থেকে সরবরাহ বেড়েছে। তাই ডজনে ১০ টাকা পর্যন্ত কমেছে। এদিকে বাজারে পাইকারি পর্যায়ে প্রতি পিস ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৩ টাকা দরে, ফলে খুচরা ব্যবসায়ীরা ১৬০ টাকার নিচে ডিম বিক্রি করতে পারছে না।
পাইকারি ডিম বিক্রেতারা বলছেন, বাজারে ডিমের সরবরাহ কিছুটা কমেছে। এ ছাড়া এপ্রিল-মে মাসে প্রচন্ড তাপপ্রবাহে ক্ষতির মুখে পড়েছেন খামারিরা। অতি গরমে অনেকের খামারে মুরগি মারাও গেছে। যার প্রভাব পড়েছে ডিমের বাজারে। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, গত বছর এ সময় রাজধানী ঢাকার বাজারগুলোয় ডিমের দাম ছিল ৪৫ থেকে ৪৮ টাকা হালি, যা ১২ শতাংশ বেড়েছে।
এদিকে খামারিদের অভিযোগের বিষয়ে তেজগাঁও ডিম ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আমান উলস্নাহ বলেন, 'অতিরিক্ত গরমে খামারিদের লাখ লাখ মুরগি মারা গেছে। যে কারণে ডিমের প্রায় ৩০ শতাংশ উৎপাদন কম হয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে বাজারে। সরবরাহ কমায় দাম বেড়েছে।'
সরবরাহ কমার সুযোগে অনেকে কমিশন বাড়িয়ে নিচ্ছেন, কোম্পানিগুলোও চড়া দামে ডিম বিক্রি করছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ এগ প্রোডিউসার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি তাহের আহমেদ সিদ্দিকী। তিনি বলেন, সরবরাহ কমার পাশাপাশি চাহিদাও একটু বেড়েছে। আর পাইকাররা কমিশন বাড়িয়ে রাখায় ডিমের দাম বেশি পড়ছে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, দেশে গত ১০ অর্থবছরে ডিম ও দুধ উৎপাদন বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। এ সময় মাংস উৎপাদন বেড়েছে দ্বিগুণের কাছাকাছি। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে দেশে ডিমের উৎপাদন ছিল ১ হাজার ১৭ কোটি, যা এখন বেড়ে হয়েছে ২ হাজার ৩৩৮ কোটি। তবে বাজারের অস্থিতিশীলতার কারণে উৎপাদন বাড়ার সুফল পাচ্ছেন না সাধারণ ভোক্তারা।