বগুড়া জেলা কারাগার থেকে ফাঁসির চার আসামি কনডেম সেলের ছাদ ফুটো করে পালিয়েছেন। তবে তারা বাইরে গিয়ে খুব বেশি সময় মুক্ত থাকতে পারেননি। মাত্র ১৫ মিনিটের মধ্যেই পুলিশ অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়। মঙ্গলবার রাত ৩-৫৫ মিনিটে এ ঘটনার পর ৪-১০ মিনিটের মধ্যে কয়েদিরা ধরা পড়েন। পুলিশ ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কারাগারের ওই ভবনটি খুবই পুরনো। ভবনের ছাদেও নেই কোনো রড, শুধু চুন ও সুরকি দিয়ে ছাদটি তৈরি করা হয়েছিল। দেশের কারাগার থেকে কয়েদি পালানোর ঘটনা এটি নতুন নয়। তবে নতুন করে এমন ঘটনায় ফের প্রশ্ন উঠেছে নিরাপত্তা নিয়ে। এ ঘটনা উদ্বেগজনক বলছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা।
এদিকে এ ঘটনায় বগুড়া জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কারাগারে নিরাপত্তার কোনো ঘাটতি আছে কিনা, কমিটিকে তা তদন্ত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ডিআইজ প্রিজন থেকেও একটি তদন্ত কমিটি গঠন করার কথা রয়েছে।
পালিয়ে যাওয়া কয়েদিরা হলেন- বগুড়া সদরের কুটুরবাড়ি পশিচমপাড়া এলাকার ইসলাইল শেখের ছেলে ফরিদ শেখ, কাহালু উপজেলার উলট্ট পূর্বপাড়া এলাকার আব্দুল মান্নানের ছেলে জাকারিয়া, কুড়িগ্রামের ভুরুঙ্গামারি উপজেলার দিয়াডাঙ্গা এলাকার নজরুল ইসলাম মঞ্জুর ও নরসিংদীর মাধবদী উপজেলার ফজরকান্দি এলাকার মৃত ইসরাফিল খাঁর ছেলে আমির হামজা। এর মধ্যে জাকারিয়ার বাবা কাহালু পৌর মেয়র বলে জানা গেছে।
পরিকল্পনা এক মাস আগের : এ ঘটনার বিস্তারিত জানাতে বুধবার সকালে বগুড়ার পুলিশ সুপার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী তার নিজ কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে
\হআসেন। সেখানে তিনি সাংবাদিকদের জানান, 'ওই চার কয়েদি একই কক্ষে থাকতেন। তারা প্রায় এক মাস আগেই পালানোর পরিকল্পনা করেন। তারা প্রতিদিনই ধারাবাহিকভাবে কাজ করে গেছেন।'
যেভাবে চম্পট দেন কয়েদিরা
কারাগার থেকে কয়েদিদের পলায়নের ঘটনা বর্ণনা করে জেলা পুলিশপ্রধান বলেন, 'আসামিরা অভিনব পন্থা অবলম্বন করেছেন। ভবনটি বেশ পুরনো। তারা প্রায় এক মাস ধরে এই পরিকল্পনা করেছেন।
তিনি বলেন, 'তারা বালতির হাতল লোহা বা স্টিল নির্মিত সেটি সোজা করে ছাদের অংশ ফুটো করেছেন। ভবনটিতে কোনো রড ছিল না। ইট-সুরকির অনেক পুরনো ভবন। ফুটোটি তারা ধীরে ধীরে বড় করেছেন। এ ছাড়া পুরনো চাদর, গামছা ও কাপড় পর্যায়ক্রমে বেঁধে ছাদ পর্যন্ত একটি রশির মতো তৈরি করেন। একটি পাটাতন তৈরি করেন। মূলত পাটাতনে পাড়া দিয়ে রশি বেয়ে ছাদের ফুটো দিয়ে বেরিয়ে যান।'
পুলিশ সুপার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী বলেন, 'এরপর ছাদ নেমে প্রিজন সেলের সামনে একটি উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ আছে। সেটি লোহার খাঁচা দিয়ে বদ্ধ। সেই লোহার খাঁচার ওপর দিয়ে ক্রলিং করে কারাগারের প্রাচীরের কাছে যান তারা এবং একইভাবে কাপড় জোড়া দিয়ে রশি তৈরি করে প্রাচীর টপকে যান। এরপর পাশের করতোয়া নদীর ওপর যে ব্রিজ ছিল, সেটি দিয়ে পাশের চাষিবাজারে পৌঁছে যান।
১৫ মিনিটের মধ্যেই ধরা
কয়েদি পালিয়ে যাওয়ার বিষয়টি জানাজানি হলে তাৎক্ষণিক শহরের বিভিন্ন স্থানে অভিযান পরিচালনা শুরু হয়। আসামিরা বাইরে গিয়ে খুব বেশি সময় মুক্ত থাকতে পারেননি। পুলিশ মাত্র ১৫ মিনিটের মধ্যেই তাদের গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়। রাতের পালায় যারা দায়িত্বে ছিলেন, তাদেরসহ অন্যদেরও নামানো হয় অভিযানে।
এদিন রাতের পালায় দায়িত্ব পালন করছিলেন বগুড়া সদর ফাঁড়ির এসআই খোরশেদ আলম। জেলা পুলিশ সুপারের নির্দেশে অভিযান চালিয়ে তার দল চারজনকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়।
পুলিশ জানায়, বুধবার ভোররাত ৩-৫৫ মিনিটে কারাগারের জাফলং ভবনের কনডেম সেলের চার আসামি কারাগার থেকে পালিয়ে গেলেও মাত্র ১৫ মিনিটের মধ্যে পুলিশ তাদের আটক করতে সক্ষম হয়।
আসামিদের গ্রেপ্তারে বগুড়া পুলিশের যে কটি দল কাজ শুরু করে, তাদের একটি নেতৃত্বে ছিলেন এসআই খোরশেদ আলম।
তিনি বুধবার দুপুরে সংবাদমাধ্যমকে বলেন, 'চার আসামি পালানোর পরই পুলিশ সুপার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী স্যার বিষয়টি ডিউটিরত সব টিম, সদরের ওসি, ডিবিকে জানান গ্রেপ্তার অভিযানে নামতে। তাদের সঙ্গে অতিরিক্ত টিম নামানোরও নির্দেশ দেন পুলিশ সুপার। ওই নির্দেশনা পেয়ে আমার ফোর্স নিয়ে আসামিদের খুঁজতে থাকি।'
এসআই খোরশেদ আলম বলেন, 'সাধারণভাবে চিন্তা করে দেখলাম, পালিয়ে যাওয়া আসামিরা কখনো সদর সড়ক ব্যবহার করবে না। জেলখানা যেহেতু করতোয়া নদীর ধারে এবং এখন করতোয়া নদীও খনন হয়েছে। তাই নদীর দুই পাড় দিয়ে যাতায়াতের একটা সুযোগ হয়েছে। আসামিরা নদীর নিচু পাড় ব্যবহার করতে পারে।'
এসআই বলেন, 'আমি ও আমার ফোর্স নির্দেশ পাওয়ার পর জেলখানা থেকে প্রায় এক কিলোমিটার উত্তরে ফতেহ আলী বাজারের পাশে করতোয়া নদীর ধারে যাই। সেখানে গিয়ে দেখি চারজন এক সঙ্গে নদীর পাশ থেকে চেলোপাড়া চাষিবাজারে হেঁটে উঠছেন। তখনই আমার সন্দেহ হয়। কারণ, আমাদের জানানো হয়েছে, চারজন পালিয়েছে। এরাও তো চারজন। তখন আমি ও টিমের অন্যরা দ্রম্নত সেখানে গিয়ে তাদের ঘিরে ফেলি। তাদের নানা প্রশ্ন করি, কিন্তু তারা কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি।'
তিনি বলেন, 'তখন তাদের দেহ তলস্নাশি করে জেলখানার একটি কাগজ পাই। এতে আমরা নিশ্চিত হই, এরাই সেই আসামি, যারা জেল থেকে পালিয়েছে। তখন বিষয়টি আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাই এবং তাদের সবাইকে থানায় নিয়ে আসি।'
উর্ধ্বতনদের জেলখানা পরিদর্শন
এ ঘটনায় অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক কর্নেল শেখ সুজাউর রহমান, বগুড়া জেলা প্রশাসক মো. সাইফুল ইসলাম, পুলিশ সুপার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী, গণপূর্তের নির্বাহী প্রকৌশলী,র্ যাবের কোম্পানি কমান্ডারসহ সংশ্লিষ্টরা জেলখানা পরিদর্শন করেছেন।
অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক কর্নেল শেখ সুজাউর রহমান পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের বলেন, 'তদন্ত শেষে বিধিমোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কারাগারের নিরাপত্তাব্যবস্থা আরও জোরদার করতে হবে।'
তদন্ত কমিটি গঠন
বগুড়া জেলা প্রশাসক মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, 'ইতোমধ্যে আমরা জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। এতে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে প্রধান করে কমিটিতে পুলিশ থেকে একজন, ফায়ার সার্ভিস থেকে একজন, গণপূর্তের একজন,র্ যাবের একজন এবং জেলখানার একজন প্রতিনিধি আছেন। তাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, কারাগারে নিরাপত্তার কোনো ঘাটতি আছে কিনা। তদন্তের প্রতিবেদন পেলেই আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবহিত করব। এ ছাড়াও ডিআইজ প্রিজন থেকেও একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে।'
কয়েদি জাকারিয়া কাহালুর মেয়রের ছেলে
পালানো ফাঁসির চার কয়েদির মধ্যে একজন মো. জাকারিয়া; তিনি কাহালু পৌর মেয়র আব্দুল মান্নানের ছেলে।
কাহালু থানার ওসি সেলিম রেজা সংবাদমাধ্যমকে বলেন, 'ওই সময় আমি ছিলাম না। যতটুকু জানি, ২০১২ সালের ৫ এপ্রিল কাহালুর রোস্তম চাপড় গ্রামের রফিকুল ইসলামের স্কুলপড়ুয়া ছেলে নাঈমুল ইসলাম নাঈম (১৩) হত্যাকান্ডের দায়ে মৃতু্যদন্ডে দন্ডিত হন জাকারিয়া।'
নাঈম হত্যা মামলার বরাতে পুলিশ জানায়, নাঈমকে আসামি জাকারিয়া ও তার সহযোগীরা মিলে অপহরণ করেন। পরে তার মুক্তিপণ বাবদ পাঁচ লাখ টাকা দাবি করা হয় পরিবারের কাছে। টাকা না পেয়ে শিশুটিকে ইটভাটায় পুড়িয়ে হত্যা করা হয়।
এ ঘটনায় মামলার পর ২০১৭ সালের ২৫ জানুয়ারি বগুড়ার প্রথম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক হাফিজুর রহমান রায় ঘোষণা করেন। রায়ে জাকারিয়া ও তার সহযোগী ডালিমকে মৃতু্যদন্ড দেওয়া হয়।
এ বিষয়ে জাকারিয়ার বাবা কাহালু পৌরসভার মেয়র ও উপজেলা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আব্দুল মান্নানের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।