বিদু্যৎ ও জ্বালানি খাত

দক্ষিণ এশিয়ায় বাণিজ্যিক নেটওয়ার্ক তৈরির উদ্যোগ

ভারত-নেপালের পাশাপাশি বিদু্যৎ আমদানি হবে ভুটান ও মিয়ানমার থেকেও

প্রকাশ | ২৬ জুন ২০২৪, ০০:০০

রেজা মাহমুদ
দেশের ক্রমবর্ধমান চাহিদা বিবেচনায় প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে বিদু্যৎ ও জ্বালানির বাণিজ্যিক নেটওয়ার্ক বাড়াতে চায় সরকার। এরই ধারাবাহিকতায় ইতোমধ্যে ভারত থেকে বিদু্যৎ ও জ্বালানি আমদানি এবং পরিবহণ শুরু হয়েছে। চূড়ান্ত হয়েছে নেপাল থেকে জলবিদু্যৎ কেনার চুক্তি। এর বাইরে ভুটান ও মিয়ানমার থেকেও বিদু্যৎ আমদানি করতে চায় সরকার। দক্ষিণ এশিয়ার এই ৪ দেশের পাশাপাশি এ খাতে চীনা বিনিয়োগ ও জ্বালানি বিনিময় নেটওয়ার্ক তৈরির উদ্যোগও চলমান রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরেই দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো থেকে বিদু্যৎ আমদানিতে সরকার আগ্রহ দেখিয়ে আসছে। ভারত থেকে বিদু্যৎ ও জ্বালানি আমদানি শুরু হলেও অবকাঠামোগত কারণে অন্যান্য প্রতিবেশী দেশ থেকে বিদু্যৎ ক্রয় চুক্তি পিছিয়ে ছিল। অবশেষে ভারত হয়ে নেপাল থেকে জলবিদু্যৎ আমদানি চুক্তি করেছে বাংলাদেশ। এই চুক্তির আওতায় আপাতত ভারতের জাতীয় গ্রিড থেকে ৪০ মেগাওয়াট বিদু্যৎ আনা হবে। পরে তা আরও বাড়বে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এর বাইরেও বিদু্যৎ বিভাগ ভুটান ও মিয়ানমার থেকে বিদু্যৎ আনতে চায়। যদিও এই পরিকল্পনা অনেক পুরনো। প্রথম ২০১২ সালে মিয়ানমার থেকে বিদু্যৎ আমদানির কথা জানিয়েছিলেন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। এরপর ২০১৭ সালে একই পরিকল্পনার কথা জানায় প্রধানমন্ত্রীর বিদু্যৎ জ্বালানি ও খনিজসম্পদ উপদেষ্টা ড. তৌফিক এলাহী চৌধুরী। সর্বশেষ ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে বিদু্যৎ খাতে নেওয়া পরিকল্পনায় ভারত, নেপাল ও ভুটানের পাশাপাশি মিয়ানমার থেকে বিদু্যৎ আমদানি পরিকল্পনার কথা বলা হয়েছে। বর্তমানে ভারতের সঙ্গে স্থলসীমান্ত থাকায় আদানি পাওয়ারের প্রায় দেড় হাজার মেগাওয়াট কয়লাবিদু্যৎ আমদানি করা হচ্ছে। কিন্তু নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে কোনো স্থলসীমান্ত না থাকায় দুই দেশের আগ্রহ সত্ত্বেও এতদিন বিদু্যৎ আমদানি করা যায়নি। অবশেষে ভারতের অনুমোদন পাওয়ায় দেশটির জাতীয় গ্রিড থেকে নেপালের ৪০ মেগাওয়াট বিদু্যৎ আমদানি প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। একইভাবে ভারতের স্থলভাগ ব্যবহার করে ভুটান থেকে বিদু্যৎ আমদানি করতে চায় সরকার। সে ক্ষেত্রে ভারত-ভুটান ও বাংলাদেশের বর্ডার এলাকায় পাওয়ার ট্রান্সমিশন ট্রেড হাব তৈরি করতে হবে। ইতোমধ্যে ভারত সরকারের কাছে এই পাওয়ার ট্রেড ট্রান্সমিশন লাইন ও হাব তৈরির জন্য অনুমোদন সহোযোগিতা চাওয়া হয়েছে। ভারত তাতে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে। যদি এই বিদু্যৎ আমদানিতে এই আবকাঠামো নির্মাণ করা যায় তাহলে ভুটান থেকে ৫শ' মেগাওয়াটের বেশি বিদু্যৎ আমদানি করা যাবে। সে ক্ষেত্রে বিদু্যতের ইউনিট প্রতি ব্যয় হতে পারে ৫ টাকা ৭০ পয়সা। যেখানে দেশে গড় বিদু্যৎ উৎপাদন ব্যয় ৮ টাকার বেশি। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) এনার্জি সিকিউরিটি শীর্ষক সমীক্ষা প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ভুটানের সরবরাহ করা বিদু্যতের ট্যারিফ পড়বে প্রতি কিলোওয়াট ঘণ্টা চার টাকা ৭০ পয়সা। তবে এ বিদু্যৎ ভারত হয়ে বাংলাদেশে আসবে তাই ভুটান ও ভারতকে ট্রান্সমিশন চার্জ দিতে হবে যথাক্রমে ১০ ও ৬১ পয়সা। আবার বাংলাদেশের ভেতরে বিদু্যৎ পরিবহণেও ট্রান্সমিশন চার্জ আছে। এতে ব্যয় হবে সাত পয়সা। আর ভুটান থেকে বাংলাদেশে বিদু্যৎ আসতে ট্রান্সমিশন লস ধরা হয়েছে এক দশমিক ৬৯ শতাংশ। এ ছাড়া সিস্টেম অপারেশন চার্জ দিতে হবে আরও চার পয়সা। সব মিলিয়ে প্রতি কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদু্যতের দাম পড়বে ৫ টাকা ৭০ পয়সা। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন ভারত, নেপাল ও ভুটান থেকে বিদু্যৎ আমদানির জন্য ১২০ কিলোমিটার ৪০০ কেভি ডাবল সার্কিট হাই ভোল্টেজের সঞ্চালন লাইন নির্মাণ করেছে সরকার। 'বড়পুকুরিয়া-বগুড়া-কালিয়াকৈর ৪০০ কেভি লাইন' প্রকল্পের আওতায় এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। প্রকল্পের মোট ব্যয় হয়েছে ৩ হাজার ৩২২ কোটি টাকা। এর মধ্যে ভারতীয় ঋণ ১ হাজার ৭৪৪ কোটি টাকা। এ ছাড়া প্রকল্পের আওতায় ৯ কিলোমিটার যমুনা রিভার ক্রসিং লাইন, কালিয়াকৈরে দুটি ৪০০ কেভি উপকেন্দ্র ও পার্বতীপুরে দুটি ২৩০ কেভি উপকেন্দ্র রয়েছে। ইতোমধ্যে এই লাইন ব্যবহার করে ভারতের আদানি পাওয়ারের বিদু্যৎ আমদানি করছে সরকার। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভুটানের বিদু্যৎ আমদানি করতে হলেও এই সক্ষমতা আরও বৃদ্ধির প্রয়োজন পড়বে। পাশাপাশি ভারতীয় অংশেও কিছু অবকাঠামো ও ট্রান্সমিশন লাইন নির্মাণের প্রয়োজন রয়েছে। যে কারণে নেপালের বিদু্যৎ সরাসরি বাংলাদেশে না এসে ভারতের জাতীয় গ্রিড হয়ে আসছে। এদিকে ভারতের মধ্য দিয়ে ভুটান থেকে জলবিদু্যৎ আমদানির বিষয়ে আগ্রহের কথা পুনর্ব্যক্ত করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সম্প্রতি ভুটানের প্রধানমন্ত্রী দাশো শেরিং তোবগে সাক্ষাতে তিনি এ আগ্রহের কথা জানান। প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'এজন্য একটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তির প্রয়োজন এবং আমরা ইতোমধ্যে ভারতের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছি। ভুটানও বাংলাদেশে জলবিদু্যৎ রপ্তানির জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে'। এর বাইরে মিয়ানমার থেকে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার আওতায় ৫শ' মেগাওয়াট বিদু্যৎ আমদানির কথা ভাবছে সরকার। এবারের প্রস্তাবিত বাজেটে তা উলেস্নখ করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে বিদু্যৎ খাতে আঞ্চলিক, উপ-আঞ্চলিক ও দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা বৃদ্ধির মাধ্যমে ভারত, মিয়ানমার, নেপাল ও ভুটান থেকে বিদু্যৎ আমদানি করবে সরকার। এরই অংশ হিসেবে ভারতের ত্রিপুরা ও বাংলাদেশের ভেড়ামারায় দুটি আন্তঃদেশীয় গ্রিড স্থাপন করা হয়েছে। আদানি পাওয়ারের ১৬০০ মেগাওয়াট বিদু্যতের পাশাপাশি এই লাইন দিয়ে শিগগিরই বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানির ১৩২০ বিদু্যৎ আমদানি করা হবে। অর্থাৎ চলতি অর্থবছরের শেষদিকে ভারত থেকেই ৩ হাজার মেগাওয়াট বিদু্যৎ আমদানি করবে সরকার। এ বিষয়ে বিদু্যৎ বিভাগের সিনিয়র সচিব হাবিবুর রহমান যায়যায়দিনকে বলেন, 'আমরা রিজনাল পাওয়ার ট্রেড নেটওয়ার্ক শক্তিশালী করতে চাই। যেখানে ভারত, নেপাল ও ভুটানের পাশাপাশি চীন ও মিয়ানমার গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। বাংলাদেশসহ এই ৬ দেশের সরকারপ্রধান ও সংশ্লিষ্টরা এ নিয়ে কাজ করছেন। দীর্ঘমেয়াদে মিয়ানমারসহ এসব দেশ থেকে ৯ হাজার মেগাওয়াট বিদু্যৎ আমদানির কথা ভাবছি। কিন্তু মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে ক্রসবর্ডার শেয়ারিংয়ের মাধ্যমে যে বিদু্যৎ আমদানির পরিকল্পনা ছিল তা দেরি হচ্ছে। তা চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। হাবিবুর রহমান আরও বলেন, আমাদের অবকাঠামোগত কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে তাই এখনই সব দেশ থেকে বিদু্যৎ আমদানি করা যাচ্ছে না। তবে ভারতের সঙ্গে আলোচনা চলছে। ভারতের লাইন ব্যবহার করে বিদু্যৎ আমদানি করা গেলে সহজেই এসব দেশ থেকে বিদু্যৎ আনা সম্ভব। এর বাইরেও উপ-আঞ্চলিক ও আঞ্চলিক সহযোগিতা ফোরাম গঠন করা হয়েছে। বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশগুলো ছাড়াও ঝঅঅজঈ, ইইওঘ, ইওগঝঞঊঈ, ঝঅঝঊঈ টঘ-ঊঝঈঅচ ইত্যাদি ফোরামের সদস্য দেশগুলোর সঙ্গে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পাওয়ার ট্রেড নেটওয়ার্ক গড়তে কাজ করা হচ্ছে। বিশেষ করে বাংলাদেশ-ভারত-নেপাল ও বাংলাদেশ ভারত ভুটান এই দুই থ্রি পার্টিস ফোরাম এই বাণিজ্যিক পাওয়ার ট্রেড নেটওয়ার্ক উন্নয়নে একসঙ্গে কাজ করতে অঙ্গীকার বদ্ধ বলেও জানান তিনি।