ভারী বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। নতুন করে বৃষ্টি না হওয়ায় পানি কিছুটা কমতে শুরু করেছে। তবে বানভাসিদের সহসাই কাটছে না দুর্ভোগ। সিলেট ও সুনামগঞ্জ শহর এবং নিম্নাঞ্চল এলাকার রাস্তাঘাট এখনো পানিতে তলিয়ে আছে। কার্যত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে অনেক এলাকাই। কিন্তু শুক্রবার সকালে রোদ ওঠায় এ দুই জেলার বানভাসিদের মনে এনে দিয়েছে স্বস্তি।
এদিকে কুড়িগ্রামে দুধকুমার ও তিস্তাসহ অন্তত ১৬ নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। ফলে এ জেলার নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। চরম সংকটে পড়েছেন অন্তত ২০ হাজার পরিবার। অন্যদিকে বানের পানিতে ডুবে শেরপুরের ঝিনাইগাতী ও নেত্রকোনার কলমাকান্দায় শিশুসহ তিনজনের মৃতু্য হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বন্যা থেকে রক্ষা করতে পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শুক্রবার পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, 'বন্যাকবলিত এলাকা কিভাবে সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসা যায়, সে বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন। সার্বক্ষণিক তিনি বানভাসিদের খোঁজখবর রাখছেন।'
আমাদের সিলেট অফিস জানায়, পাঁচদিন পর শুক্রবারের রৌদ্রোজ্জ্বল সকাল স্বস্তি এনেছে মানুষের মনে। বৃহস্পতিবারের চেয়ে এ দিন জেলার বেশ কয়েকটি নদ-নদীর পানিও বিভিন্ন পয়েন্টে কমেছে।
সিলেট আবহাওয়া অধিদপ্তরের সহকারী আবহাওয়াবিদ শাহ মো. সজীব হোসাইন বলেন, 'বৃহস্পতিবার সকাল ৬টা থেকে শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত বৃষ্টি
হয়নি। ২৪ ঘণ্টায় জেলায় ২০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। 'তবে ২৪ ঘণ্টায় কোনো বৃষ্টিপাতের খবর পাওয়া যায়নি ভারতের চেরাপুঞ্জিতেও।'
বৃহস্পতিবার পর্যন্ত জেলা প্রশাসন থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, সিলেট সিটি করপোরেশনের ২৩টি ওয়ার্ডসহ জেলার ১৩টি উপজেলার ১৩০টি ইউনিয়ন পস্নাবিত হয়েছে। এতে বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছেন ৯ লাখ ৫৭ হাজার ৪৪৮ জন বাসিন্দা। এ অবস্থায় জেলার ১৩টি উপজেলায় ৬৯৮টি আশ্রয়কেন্দ্র চালু করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩৬১ আশ্রয়কেন্দ্রে ২১ হাজার ৭৮৬ জন মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন।
তবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তথ্য মতে, শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত দ্বিতীয় দফার বন্যায় ১০ লাখ ৪৩ হাজার ১৬১ জন মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছেন।
শুক্রবার বেলা ১১টায় পাউবো সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ জানান, শুক্রবার সকাল ৯টায় সুরমা নদীর পানি কানাইঘাট পয়েন্টে বিপৎসীমার ৬১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। বৃহস্পতিবার এই পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ৭৪ সেন্টিমিটার ওপরে ছিল। সুরমা নদীর পানি সিলেট পয়েন্টে শুক্রবার সকাল ৯টায় প্রবাহিত হচ্ছিল বিপৎসীমার ১৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে। আগের দিন এই পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ২৩ সেন্টিমিটার ওপরে ছিল। এছাড়া কুশিয়ারা নদীর পানি আমলশীদ পয়েন্টে শুক্রবার সকাল ৯টায় বিপৎসীমার ৫৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এই পয়েন্টে বৃহস্পতিবার পানি বিপৎসীমার ৮১ সেন্টিমিটার ওপরে ছিল। একইভাবে কুশিয়ারা নদীর পানি শেওলা পয়েন্টে শুক্রবার সকাল ৯টায় বিপৎসীমার ৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। বৃহস্পতিবার এই পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ৩০ সেন্টিমিটার ওপরে ছিল।
ওই নির্বাহী প্রকৌশলী আরও বলেন, 'শুক্রবার নতুন করে বৃষ্টি না হওয়ায় পানি কিছুটা কমতে শুরু করেছে। বৃষ্টিপাত আর পাহাড়ি ঢল না হলে পরিস্থিতির দ্রম্নত উন্নতি হবে।'
এদিকে সিলেটবাসীকে বন্যার কবল থেকে রক্ষা করতে সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শুক্রবার সকালে সিলেট নগরীর ক্বীণ ব্রিজ এলাকায় সুরমা নদী পরিদর্শনকালে পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক এমপি এ কথা বলেন।
তিনি আরও বলেন, আগামীতে সিলেট-সুনামগঞ্জের বন্যাকবলিত এলাকা কিভাবে সহনীয় পর্যায় নিয়ে আসতে পারি সে লক্ষে আমরা আলোচনা করেছি। ইতোমধ্যে সুরমা নদীর ১৫ কিলোমিটারের মধ্যে ১২ কিলোমিটার খনন কাজ সম্পন্ন হয়েছে। বন্যার পানি কমে গেলে বাকিটুকু খনন করা হবে। এছাড়াও সামগ্রিকভাবে সুরমা-কুশিয়ারা নদী খনন করব। সুনামগেঞ্জর ছোট বড় ২০টি নদী আমরা খনন করব। এ খনন কাজ করলে নদীতে উজান থেকে নেমে আসা পানির ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। এ লক্ষ্যে আমি স্থানীয় পাউবোকে নির্দেশনা দিয়েছি। উজান থেকে যে পরিমাণ পানি আসে তার ধারন করার ক্ষমতা তৈরি করার জন্য যেসব নদী ও খাল খনন করার দরকার সিলেটের প্রধান প্রকৌশলীকে নির্দেশনা দিয়েছি।
তিনি আরও বলেন, 'মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সিলেটের বন্যার খোঁজখবর রাখছেন। তিনি আমাকে সব সময় সজাগ থেকে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন। আমার আসার আগে এই সিলেটের ত্রাণ ও দুর্যোগ প্রতিমন্ত্রীকেও তিনি পাঠিয়েছেন। সার্বক্ষণিক তিনি সিলেটের খবর রাখছেন এবং সিলেটবাসীকে বন্যার কবল থেকে রক্ষা করার যা যা করণীয় তা করার নির্দেশনা প্রদান করেছেন।
এ সময় সিলেট-৩ আসনের সংসদ সদস্য হাবিবুর রহমান হাবিব, সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী, জেলা প্রশাসক শেখ রাসেল হাসান, সিলেট সিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ইফতেখার আহমেদ চৌধুরী, প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান, কাউন্সিলর, পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাস, সিলেট সিটির জনসংযোগ কর্মকর্তা সাজলু লস্কর প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, সুনামগঞ্জের বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। এতে স্বস্তি ফিরেছে ভাটির জেলার মানুষের মনে। তবে দুর্ভোগ কমেনি বন্যাকবলিতদের।
জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, সুনামগঞ্জ সদর, দোয়ারাবাজার, ছাতক, তাহিরপুরসহ সাত উপজেলার ৭৮ ইউনিয়নের ১ হাজার ১৮ গ্রাম ঢলের পানিতে তলিয়ে যায়। এমনকি পানিবন্দি হয়ে এখনো চরম কষ্টে জীবনযাপন করছেন জেলার সাড়ে ছয় লাখ মানুষ।
স্থানীয়রা জানান, বন্যার কারণে ভেসে যায় ঘরে থাকা ধান-চাল, গৃহপালিত পশু ও আসবাবপত্র। সেই সঙ্গে তলিয়ে গেছে পুকুরের মাছ ও ফসলি জমি। জেলা সদরের সঙ্গে এখনো সড়কপথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে তাহিরপুর উপজেলার। এছাড়া ছাতক, দোয়ারাবাজার, জগন্নাথপুরসহ কয়েকটি উপজেলার সঙ্গে দুর্গম এলাকার ৪০টিরও বেশি গ্রামের সরাসরি সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে।
তবে পাহাড়ি ঢল কম নামায় এরই মধ্যে পৌর শহরের তেঘরিয়া, আরপিননগর, বড়পাড়া, ওয়েজখালি, মলিস্নকপুর, ষোলোঘর, নতুনপাড়া, মধ্যবাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় বৃহস্পতিবার হাঁটুসমান পানি থাকলেও বর্তমানে এক থেকে দুই ইঞ্চি রয়েছে। অর্থাৎ ধীরে ধীরে পৌরশহর থেকেও পানি কমে যাওয়ায় স্বাভাবিক হচ্ছে যানবাহন চলাচল।
এদিকে ভোগান্তি থেকে রক্ষা পেতে পানিবন্দি মানুষরা আশ্রয়কেন্দ্রে গেলেও সেখানে পড়তে হয়েছে নতুন ঝামেলায়। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে এরই মধ্যে পর্যাপ্ত খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। এতে মানবেতর জীবনযাপন করছেন বন্যাকবলিতরা।
তারা জানান, সরকারিভাবে পর্যাপ্ত শুকনা খাবার পাওয়া যায়নি। সেই সঙ্গে আশ্রয়কেন্দ্রে এসেও প্রতিনিয়ত ভোগান্তি বাড়ছে।
ভোগান্তিতে পড়া বেতগঞ্জের মশিউর রহমান বলেন, পানিতে রাস্তাঘাট তলিয়ে গেছে। এখন ছেলেকে নিয়ে হাসপাতালে যেতে অনেক ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। বছর বছর বন্যার এমন ভোগান্তি কষ্টকর।
হাসননগরের পানিবন্দি সালেহ উদ্দিন বলেন, অনেক কষ্ট আছি। চারদিকে পানি। সন্তানসহ সবাই না খেয়ে আছি।
আশ্রয়কেন্দ্র আসা তানজিলা বলেন, ভেবেছিলাম হয়তো কষ্ট কিছু কম হবে। কিন্তু এখানে বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে।
পৌর শহরের বাসিন্দা আব্দুল লতিফ বলেন, শহর থেকে পানি কমায় ও রোদ ওঠায় মনে কিছুটা স্বস্তি এসেছে।
পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন হাওলাদার বলেন, চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টি কম হওয়ায় সুনামগঞ্জের নদীর পানি কমেছে। ফলে বন্যা পরিস্থিতি উন্নতি হয়েছে। এরই মধ্যে সুনামগঞ্জ সুরমা নদীর পানি বিপৎসীমার ৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে আরও তিন থেকে চারদিন লাগবে।
স্টাফ রিপোর্টার, মৌলভীবাজার জানান, জেলার কুশিয়ারা নদীতে আবারও পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। শুক্রবার সকাল ৯টায় পাউবো জানায়, কুশিয়ারা নদীর শেরপুর সেতু পয়েন্টে পানির বিপৎসীমা ধরা হয়েছে ৮.৫৫ সেন্টিমিটার। ভারতের ঢল ও গেল কয়েকদিনের লাগাতার বৃষ্টিতে বিপৎসীমা অতিক্রম করে নদীতে ৮.৭৯ সেন্টিমিটার পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। এদিকে মৌলভীবাজার শহরে দিয়ে ঘেঁষে যাওয়া মনু নদে গেল তিন দিন ধরে পানি বৃদ্ধি পেলেও শুক্রবার সকাল থেকে কমছে। মনু নদের শহরের চাঁদনীঘাট সেতুতে বর্তমানে পানির পরিমাণ ১১.৩০ সেন্টিমিটার।
এদিকে বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার কুশিয়ারা নদী পাড়ে গেলে দেখা যায়, তীরের মানুষের সবার ঘরে ঘরে হাঁটুসম পানি গিয়ে দাঁড়িয়েছে। বসতির মায়ায় পড়ে এসব পানিবন্দি মানুষ ঘরে খাটের ওপর বসে সময় পার করছেন। গবাদি পশুগুলো পাশের ওয়াপধা সড়কে নিয়ে রেখেছেন।
নদী পাড়ের ফতেপুর ইউনিয়নের শাহাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, স্কুলে প্রায় শতাধিক পানিবন্দি মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। স্ত্রী-সন্তানসহ সাত সদস্য নিয়ে ওই গ্রামের মিরাস মিয়া, জাসনা বেগম বলেন, চার দিন ধরে আশ্রয়কেন্দ্রে এসে অবস্থান করেছি। সামান্য চিড়া আর মুড়ি পেয়েছি। আমাদের সঙ্গে এখানে শিশু ও বয়োবৃদ্ধসহ শতাধিক মানুষ রয়েছেন। ক্ষুধার তাড়নায় সবাই কষ্ট পাচ্ছেন।
গ্রামের শাহাব উদ্দিন, আছকির মিয়া, ইলিয়াছ আহমদ (এলাইছ) আব্দুলস্নাহ ও কাউছার আহমদ বলেন, কুশিয়ারা পাড়ের ওই আশ্রয়কেন্দ্রে ত্রাণসামগ্রী বণ্টন না করায় শতাধিক মানুষ প্রায় না খেয়ে আছেন।
নদী পাড়ের উত্তরভাগ ইউনিয়নের সুনামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৪৫ জন মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। তারা জানান, মুড়ি আর চিড়া ছাড়া এখনো কিছুই পাওয়া যায়নি। তারা দ্রম্নত জেলা প্রশাসনসহ সরকারের তরফ থেকে ত্রাণসামগ্রী বিতরণের দাবি জানান। উত্তরভাগ ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ড সদস্য মাসুক মিয়া বলেন, সুনামপুর আশ্রয়কেন্দ্রে এখনো কেউ ত্রাণসামগ্রী নিয়ে আসেননি।
ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ড সদস্য মো. ওলিউর রহমান বলেন, তার ওয়ার্ডের কান্দিগাঁও ও রামপুরে দু'টি আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে। এখানে ৭০ জন পানিবন্দি বসবাস করছেন। তিনি বলেন, এখনো তার ওয়ার্ডে কোন ত্রাণসামগ্রী এসে পৌছায়নি।
এদিকে রাজনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুপ্রভাত চাকমা বলেন, 'কুশিয়ারা পাড়ের উত্তরভাগ ও ফতেপুর ইউনিয়নে ১১টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে।' ত্রাণসামগ্রী বণ্টনের বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, জরুরি একটি ফোন এসেছে, আপনাকে পরে ফোন দিচ্ছি।
এদিকে মৌলভীবাজার পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জাবেদ ইকবাল বলেন, কুশিয়ারায় শুক্রবারও পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। নদী পাড়ের ওয়াপধা বাঁধের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় আমরা বালির বস্তা রেখেছি, যাতে কাউয়াদিঘী হাওড়ে পানি প্রবেশ করতে না পারে। তিনি বলেন, মৌলভীবাজার শহর দিয়ে বয়ে যাওয়া মনূ নদের জুগীঢর এলাকার বাঁধে কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ থাকায় ৬ হাজার বালুর বস্তা ড্রাম্পিং করেছি। মনু নদে পানি কমে যাওয়ায় আতঙ্কও কমেছে।
কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি জানান, জেলার ব্রহ্মপুত্র, দুধকুমার, ধরলা, তিস্তাসহ ১৬ নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। ফলে নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে চর, দ্বীপচর ও নিম্নাঞ্চলের অন্তত ২০ হাজার পরিবার।
শুক্রবার সকালে স্থানীয় পাউবো জানায়, ধরলা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে শিমুলবাড়ী পয়েন্টে বিপৎসীমার ১৫ সেন্টিমিটার ও কাউনিয়া পয়েন্টে তিস্তার পানি বেড়ে ৫০ সেন্টিমিটার বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
নদ-নদীর তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল ও চরাঞ্চলের প্রায় ২০ হাজারেরও বেশি পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ভেঙে পড়েছে এসব এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা। নিমজ্জিত রয়েছে গ্রামীণ কাঁচা-পাকা সড়ক। নিম্নাঞ্চলের বসতভিটায় পানি প্রবেশ করায় দুর্ভোগে পড়েছে মানুষজন। এছাড়াও তলিয়ে গেছে মৌসুমি ফসলের ক্ষেত।
তবে ব্রহ্মপুত্র ও দুধকুমার নদের পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলেও তা এখনো বিপৎসীমার সামান্য নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
সদরের পাঁচগাছী ইউনিয়নের ভেলুর বাজার এলাকার কৃষক শফিকুল ইসলাম বলেন, হঠাৎ ধরলা নদীর পানি বাড়ার কারণে আমার এলাকার সব ক্ষেত তলিয়ে গেছে। দুই বিঘা জমির পটোল তলিয়ে গেছে। পানিটা আর কয়েকদিন পরে আসলে আরও কিছু টাকার পটোল বিক্রি করতে পারতাম। এখন গাছগুলো সব মরে যাবে।
কুড়িগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, নদ-নদীর পানি বৃদ্ধির কারণে জেলায় ৪৫৩ হেক্টর জমির বিভিন্ন ফসল নিমজ্জিত হয়েছে।
সূত্র জানায়, বন্যা মোকাবিলায় ১৩ লাখ টাকা, চাল ২৫১ মেট্রিক টন, ২৫০ বান্ডিল ঢেউটিন, নৌকা ও আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
কুড়িগ্রাম পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী রাকিবুল হাসান জানান, 'কুড়িগ্রামের নদ-নদীর পানি বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে।'
রংপুর প্রতিনিধি জানান, জেলার কাউনিয়া পয়েন্টে তিস্তা নদীর পানি শুক্রবার সকাল ৬টায় বিপৎসীমার ৫০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। সকাল ৯টায় আরও ২ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে এখন ৫২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়।
পানি বৃদ্ধির ফলে নদীর তীরবর্তী ও চরাঞ্চলের কমপক্ষে ১০টি গ্রামে প্রবল বেগে পানি প্রবেশ করেছে। ইতোমধ্যে চরাঞ্চলের ১১টি গ্রাম তলিয়ে যাওয়ায় প্রায় ২০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বন্যার পানিতে শত শত হেক্টর জমিতে থাকা বাদাম ও মরিচের ক্ষেত তলিয়ে গেছে।
এলাকাগুলো হলো বালাপাড়া ও টেপামধুপুর ইউনিয়নের হরিচরণ শর্মা, আজমখাঁ, হযরত খাঁ, বিশ্বনাথের চর, চরগনাই, ঢুষমারা, চর রাজিব, গোপিঙ্গা, গদাই, পাঞ্জরভাঙ্গা, তালুক শাহবাজপুর। প্রবল বেগে পানি প্রবেশ করায় হাজার হাজার মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে পাউবোর বিভিন্ন বাঁধে আশ্রয় নিয়েছেন।
টেপামধুপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম জানিয়েছেন, তিস্তা নদীর পানি এবার কাউনিয়া উপজেলায় রেকর্ড পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতি মুহূর্তেই পানি বাড়ছে। ফলে তিস্তা নদীর তীরবর্তী অঞ্চল ও চরাঞ্চলের গ্রামগুলোতে প্রবল বেগে পানি ঢুকে বাড়িঘর পস্নাবিত হচ্ছে। এরই মধ্যে অর্ধশতাধিক ছাগল, ভেড়া প্রবল স্রোতে ভেসে গেছে। সেই সঙ্গে বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে।
কাউনিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মহিদুল হক জানিয়েছেন, পানিবন্দি মানুষের সহায়তার জন্য সব ধরনের সামগ্রী আছে। আমরা দ্রম্নতই তাদের মাঝে শুকনো খাবারসহ অন্য খাদ্যসামগ্রী বিতরণের ব্যবস্থা নিচ্ছি।
ঝিনাইগাতী (শেরপুর) প্রতিনিধি জানান, জেলার ঝিনাইগাতী উপজেলায় শুক্রবার বন্যার উন্নতি হলেও নিম্নাঞ্চলে পানিতে ডুবে দু'জনের মৃতু্য হয়েছে। এ দিন সকাল থেকে আকাশে রোদ দেখা দেওয়ার ফলে উজান থেকে পানি নেমে ভাটি এলাকায় মহারশি ও শমেসস্বরী নদীর পানিতে নিন্মঅঞ্চল পস্নাবিত হয়েছে। গত মঙ্গলবার একদিনে প্রচুর বৃষ্টিপাত ও ভারতের মেঘালয় রাজ্য থেকে বয়ে আসা পানিতে নিমিষেই নদী ভরাট হয়ে বন্যায় পরিণত হয়ে যায় নদীর তীরবর্তী এলাকা। পাহাড়ি ঢলের পানিতে ভাটি এলাকাসহ নিম্নাঞ্চলের মানুষেরা পানিবন্দি হয়ে পড়েন। বন্যার স্রোতে উপজেলার দিঘিরপাড় পালপাড়া ও আব্দুলস্নাহর বাড়ির শেষ সীমানায় বাঁধ ভেঙে যাওয়ার ফলে পানি প্রবেশ করে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হয়েছে।
উপজেলার, বাঘেরভিটা, কান্দলী, কালীনগর, সারিকালীনগর, বগাডবি, পাগলারমুখ, বনগাঁও, চতল, সূরিহারা সহ কয়েকটি এলাকায় পানি প্রবেশ করে। শুক্রবার জুমা নামাজের পর বেলা আড়াইটার দিকে ৫ বন্ধু মিলে ধানশাইল ইউনিয়নের দক্ষিণ কান্দলী গ্রামে নৌকাযোগে বন্যা দেখতে যায়। মাঝপথে গিয়ে থই থই পানিতে নৌকা ডুবে যায়। এ সময় ওই গ্রামের সোহরাব আলীর ছেলে রংপুর মেডিকেল কলেজের অধ্যয়নরত ডা. মিল্টন মিয়া (২৫) ও সাদা মিয়ার ছেলে আমানুলস্না (১৭) পানিতে পড়ে মারা যান। বাকি তিনজন বন্ধুকে এলাকাবাসী উদ্ধার করে শেরপুর সদর হাসপাতালে নিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা দেন।
কলমাকান্দা (নেত্রকোনা) প্রতিনিধি জানান, উপজেলায় বন্যার পানিতে ডুবে এক মাদ্রাসা শিক্ষার্থী মারা গেছে।
শুক্রবার বেলা ১১টার দিকে উপজেলার নাজিরপুর ইউনিয়নের রাতকান্দা গ্রামে এ ঘটনা ঘটে বলে কলমাকান্দা থানার ওসি লুৎফুল হক জানান।
শিক্ষার্থী রিফাত হোসেন (১১) ওই গ্রামের আবু কালামের ছেলে। গাজীপুরে একটি মাদ্রাসায় হেফজ বিভাগে পড়াশোনা করত।
ওসি বলেন, 'রিফাত তার পরিবারের সঙ্গে গাজীপুরে থাকত। প্রায় ২০ দিন আগে বাবা-মায়ের সঙ্গে সে গ্রামের বাড়িতে আসে। ঈদের আনন্দে প্রতিবেশী শিশুদের সঙ্গে গোসল করতে বাড়ি থেকে বের হয় রিফাত। পরে তারা বাড়ির সামনে পালপাড়া-হরিপুর গ্রামীণ পাকা সড়কে যায়। তখন ওই সড়কে বন্যার পানির তোড়ে ভেসে যায় রিফাত। সাঁতার না জানায় সে পানি থেকে ওঠে আসতে পারেনি।'
পরে অন্য শিশুদের চিৎকারে স্থানীয়রা রিফাতকে উদ্ধার করে কলমাকান্দা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেস্নক্সে নিলে সেখানে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন বলে জানান এ পুলিশ কর্মকর্তা।
ওসি লুৎফুল হক বলেন, এ ঘটনায় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের প্রক্রিয়া চলছে।