মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনতে সরকার নানা উদ্যোগ নিলেও তা উল্টো বেড়েই চলছে। খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ায় সার্বিক মূল্যস্ফীতির তুলনায় খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি বেড়েছে আরও বেশি। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতার কারণেই তা নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে। এই মূল্যস্ফীতি এখন অর্থনীতির সূচকগুলোকে টেনে ধরছে। তাতে কষ্ট বাড়ছে সাধারণ মানুষের।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে সাধারণ মানুষের আয় বাড়ে না। যে কারণে মূল্যস্ফীতি বাড়লে সাধারণ মানুষকে বেশ ভোগান্তিতে পড়তে হয়। বিশেষ করে যারা গরিব তাদের জন্য এটা কষ্টদায়ক। মূল্যস্ফীতি সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ে হতদরিদ্রদের ওপর। বর্তমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে এ শ্রেণির মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। বিষয়টি সবার কাছে স্পষ্ট হলেও মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে সরকারের নীতি-নির্ধারকরা এখনো ভুল পথে হাঁটছে। যা পরিস্থিতিকে আরও ঘোলাটে করে তুলছে।
সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, টানা দুই বছরের উচ্চ মূল্যস্ফীতি ৯-১০-এর কাছাকাছি। মূল্যস্ফীতি কমাতে সরকার কিছু কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। যেমন সুদের হার বাড়িয়েছে। এবারের বাজেটে কিছু কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর শুল্ক কমানো হয়েছে। কিন্তু এরপরও মূল্যস্ফীতি কমছে না। এর পেছনে দুটো কারণ আছে। প্রথমটা হলো- দীর্ঘ সময় ধরে সঠিক পদক্ষেপগুলো নেওয়া হয়নি। বিশেষ করে মুদ্রানীতি ও সুদের হারের কথা বলা যায়। দীর্ঘ সময় ধরে সুদের হার ছয়-নয়ে স্থির করে রাখা হয়েছিল।
মূল্যস্ফীতি যখন ক্রমান্বয়ে বাড়ছিল, তখন যদি সুদের হারটা ফ্লেক্সিবল করা যেত, তাহলে কিছুটা হলেও মুদ্রানীতির কার্যকর ভূমিকা দেখা যেত। কিন্তু এ ব্যাপারে দীর্ঘ বিলম্বে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ফলে সুদের হার বাড়ানো হলেও সেটা মূল্যস্ফীতি কমাতে খুব বেশি সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারছে না। তার বড় কারণ হলো- এরই মধ্যে একটা বিশালসংখ্যক জনগোষ্ঠীর প্রকৃত আয় মূল্যস্ফীতির কারণে অনেক কমে গেছে। সুতরাং, সুদের হার বাড়ালে তারা তাদের চাহিদাকে আরও সংকুচিত করবে, সেই সুযোগ কমে গেছে। সুদের হার বাড়িয়ে চাহিদা সংকুচিত করার নীতিটা এক বা দেড় বছর আগে নেওয়া হলে সেটা কার্যকর হতে পারত। দেরিতে নেওয়ার এর কার্যকারিতা অনেকটাই কমে গেছে।
দ্বিতীয় কারণ হলো, রাজস্বনীতিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের করহার কমানোর উদ্যোগটা অনেক দেরিতে নেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি বাজার ব্যবস্থাপনায় বিভিন্ন ধরনের সিন্ডিকেটের কারসাজি কিংবা অন্য সব অসাধু উদ্যোগের ক্ষেত্রে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। সামগ্রিকভাবে মুদ্রানীতি, রাজস্বনীতি ও অভ্যন্তরীণ বাজার ব্যবস্থাপনা- এই তিন জায়গায় গত দুই বছরের সরকারের সাফল্য দেখাতে পারেনি। তাই আগামী এক বছরে খুব বেশি সাফল্য দেখাতে পারবে, সেটা আশা করার কোনো কারণ নেই। কারণ, এসব বিষয়ে যথাযথ উদ্যোগের প্রতিফলন নতুন বাজেটে নেই। সুতরাং, এক বছরের মধ্যে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, এ ব্যাপারে একদমই আশাবাদী হওয়ার সুযোগ কম। এছাড়া মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে যেসব উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, তার মধ্যেও সমন্বয় নেই, সে কারণে এ ধারা দীর্ঘায়িত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে বলে মনে করেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা।
এদিকে, বাজার ব্যবস্থাপনায় সরকারের নিয়ন্ত্রণের অভাব এবং বাজারে চাহিদা ও জোগান সম্পর্কিত তথ্যে স্বচ্ছতার অভাব থাকাকে দুষছেন বাজার পর্যবেক্ষকরা।
তাদের মতে, সরকার সমস্যাগুলো শনাক্ত করলেও এগুলো সমাধানে যে পূর্ণাঙ্গ অর্থনৈতিক কৌশল প্রণয়নের প্রয়োজন সে বিষয়ে কিছু করছে না। তারা কোনো কাঠামোগত সংস্কারে যাচ্ছে না। যা সরকারের বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা।
সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, পণ্যের জোগান যেখানে স্বাভাবিক, যেখানে যোগাযোগ ব্যবস্থা আগের চাইতে উন্নত, বাজার সুসংহত, সেখানে দাম বাড়ার একটাই কারণ তা হলো পুরোসরবরাহ ব্যবস্থা গুটিকয়েক ব্যক্তি নিয়ন্ত্রণ করছে। সেই স্বার্থান্বেষীগোষ্ঠী সরকারের ওপরে প্রভাব বিস্তার করে আছে।
সরকার ভুল ছকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করায় এর উল্টো ফল হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরাও। তাদের ভাষ্য, ভুল পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করাও যেমন কঠিন, তেমনি তাতে সুফল পাওয়ার সম্ভাবনাও কম থাকে। অথচ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সরকার মূল সংকটের সমাধান না করে এলোমেলো সিদ্ধান্ত নিয়ে তা বাস্তবায়নের চেষ্টা করছে। ফলে মূল্যস্ফীতি ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণে আসারও সম্ভাবনা একেবারেই ক্ষীণ।
এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, বাজার ব্যবস্থাপনা পুরোপুরি সিন্ডিকেটের হাতে চলে গেছে। এই সিন্ডিকেট ভাঙতে না পারলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসবে না। বরং আগামীতে মূল্যস্ফীতি আরও লাগামহীনভাবে বেড়ে যেতে পারে।
সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ও নাগরিক পস্ন্যাটফর্মের আহ্বায়ক দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, অর্থনীতিতে সমস্যার ত্রিযোগ ঘটেছে। সবার আগে অনিয়ন্ত্রিত মূল্যস্ফীতি। যা মানুষের জীবনমানকে সরাসরি আঘাত করছে। পৃথিবীতে অন্যান্য দেশে মূল্যস্ফীতির হ্রাস ঘটলেও তার সুফল বাংলাদেশ পাচ্ছে না।
এই অর্থনীতিবিদের ভাষ্য, দেশে মূল্যস্ফীতি এখনো ১০.১০ এর কাছাকাছি। যা মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস করছে। পিছিয়ে পড়া মানুষের ভোগ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের ওপর মূল্যস্ফীতি সরাসরি প্রভাব ফেলছে। এসব কারণে বাল্যবিবাহ বেড়ে যাচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সানেমের (সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং) নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, হয়তো মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে সরকার গুরুতর সমস্যা হিসেবে দেখছে না। দেখলে এরই মধ্যে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তার সঙ্গে আরও কিছু যোগ হতো। শুধু মুদ্রানীতি দিয়েই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ হবে না। দরকার রাজস্ব নীতি ও বাজার ব্যবস্থাপনাসহ সমন্বিত উদ্যোগ। তা কিন্তু দেখা যাচ্ছে না।
সময়মতো পদক্ষেপ না নেওয়ার উদাহরণ দিয়ে সেলিম রায়হান বলেন, মূল্যস্ফীতি কম থাকার সময় ডলারের তুলনায় টাকার অবমূল্যায়ন না করে করা হয়েছে এমন সময়, যখন দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি আছে। বিদু্যতের দাম বাড়ানো হয়েছে। ঢাকা ওয়াসা পানির দাম বাড়িয়েছে। নতুন করে বাড়ানো হয়েছে তেলের দাম। সব মিলিয়ে মনে হয় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নীতি সমন্বয়হীনতাও কম দায়ী নয়।
এদিকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আরও বেশকিছু ভুল সিদ্ধান্তকে চিহ্নিত করেছেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা। তাদের ভাষ্য, বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি সাধারণ নিয়মে হয়নি। তাই গতানুগতিক কৌশলে তা নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব। যেসব কারণে দেশে মূল্যস্ফীতি ঘটেছে, ওইসব কারণ চিহ্নিত করে সে সংকট মোকাবিলার পথ খুঁজে বের করা জরুরি বলে মনে করেন তারা।
এ প্রসঙ্গে সিরডাপের পরিচালক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. হেলাল উদ্দিন বলেন, চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকলে অথবা সরবরাহের তুলনায় চাহিদা বেড়ে গেলে মূল্যস্ফীতি হয়। কিন্তু বাংলাদেশে এখন যে মূল্যস্ফীতি তা সেই নিয়ম মেনে হয়নি। ডলার সংকট এবং আন্তর্জাতিক বাজারে আমদানি পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় এটা হয়েছে। আর দাম আন্তর্জাতিক বাজারে কমলেও তার প্রভাব এখানে পড়ে না। চাহিদা বাড়ার কারণে দাম বাড়লে টাকা সরবরাহ কমিয়ে দিলে দাম কমে। কিন্তু এখানে চাহিদা যে বেড়েছে তা নয়।
তার ভাষ্য, সুদের হার বাড়লে টাকার সরবরাহ কমে। এখন সেটা যদি ব্যাপক ভাবে করা হয় আর সরকার যদি ব্যাংক খাত থেকে ধার করে তাহলে ব্যক্তি খাত টাকা পাবে কোথায়? তাই বাস্তবে এই চিন্তা কোনো কার্যকর ফল বয়ে আনে না।
বিশিষ্ট এই অর্থনীতিবিদ মনে করেন, এভাবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা কঠিন। মূল্যস্ফীতির পিছনে অনেক কারণ আছে। এটা রাতারাতি কিছু করা সম্ভব নয়। সুদ বাড়িয়ে সেটা করতে হলে আর সব কিছুর উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে হবে। সেটা করলে আবার প্রবৃদ্ধি নিয়ে সমস্যা হবে। দেশে ডলার ক্রাইসিস আছে। সেটা সামাল দেয়ার পথ বের করা জরুরি।
এদিকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের ভুল সিদ্ধান্ত কারণে তা আরও লাগামহীন হয়ে উঠেছে বলে মনে করেন বিদু্যৎ-জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও শিল্প উদ্যোক্তারা। তাদের ভাষ্য, দেশে গত দুই বছরে বিদু্যৎ ও জ্বালানির দাম বেড়েছে দফায় দফায়। এর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব পড়েছে মূল্যস্ফীতিতে; খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূতসহ সব ধরনের পণ্য ও সেবার উৎপাদন খরচ বেড়েছে। উৎপাদন ব্যয় বাড়ায় দ্রব্যের দামও বেড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে সম্প্রতি আবার জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে। এছাড়া গ্যাসের দামও গ্রাহক পর্যায়ে গত দুই বছরে বাড়ানো হয়েছে দু'বার। আর শিল্প খাতে ক্যাপটিভে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম চলতি বছরে দুই দফা বাড়ানো হয়েছে। আবার বিদু্যতের দাম গত বছর বেড়েছে তিন দফা। এরপর চলতি বছরের মার্চে তা আরও এক দফা বাড়ানো হয়। বিদু্যৎ ও জ্বালানির দামের এ ঊর্ধ্বমুখিতা চলমান থাকলে কখনই উচ্চ মূল্যস্ফীতির লাগাম টানা যাবে না, বরং এ শোচনীয় অবস্থা আরও চড়াও হবে।
এরই মধ্যে বিদু্যৎ ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধিতে আবাসন ও শিল্প খাতে নানা সংকট দেখা দিয়েছে। যেহেতু দৈনন্দিন জীবন ও উৎপাদন ব্যবস্থা এ উপকরণের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, তাই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে বিদু্যৎ ও জ্বালানির দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখা জরুরি। এক্ষেত্রে সরকারকে আরও বিবেচক হওয়ার পরামর্শ দেন সংশ্লিষ্টরা।