টানা বৃষ্টি ও উজানের ঢল
বন্যায় ২০ লাখ মানুষ পানিবন্দি
সিলেট বোর্ডের এইচএসসি পরীক্ষা স্থগিত সুনামগঞ্জে ডুবেছে ঘরবাড়ি, বিপাকে শিশু ও বৃদ্ধরা বানের পানিতে ডুবে মৃতু্য তিনজনের বানভাসিদের খাদ্যের অভাব
প্রকাশ | ২১ জুন ২০২৪, ০০:০০
যাযাদি ডেস্ক
টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যায় প্রায় ২০ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এরই মধ্যে সিলেটে ৯ লাখ, সুনামগঞ্জে ছয়, মৌলভীবাজারে তিন ও হবিগঞ্জে এক লক্ষাধিক বানভাসি মানবেতর জীবনযাপন করছেন। বিশেষ করে বিপাকে পড়েছেন বৃদ্ধ ও শিশুরা। যারা আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করছেন, তাদেরও পর্যাপ্ত খাবার মিলছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। যদিও এসব কেন্দ্রে খাবার সরবরাহ চলমান রয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। এছাড়া গৃহপালিত পশু-পাখি নিয়ে চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে মানুষকে। ইতোমধ্যে বানের পানিতে ডুবে শিশুসহ তিনজনের মৃতু্য হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে দুই দফায় বন্যাকবলিত অঞ্চল সিলেটে এইচএসসি পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। দুর্গতদের পাশে রয়েছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা।
আমাদের সিলেট অফিস জানায়, চেরাপুঞ্জিতে ২৪ ঘণ্টায় মাত্র ১১০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। অথচ গত টানা পাঁচ দিনে চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টি হয়েছে ১৬০০ মিলিমিটার। বৃষ্টি কমায় সিলেটে কোথাও পানি কমেছে আর কোথাও বেড়েছে। কুশিয়ারা ছাড়া সবক'টি নদ-নদীর পানিই কমছে বলেও জানা গেছে। তবে সুরমা নদী সিলেট পয়েন্টে বিপৎসীমার ২৯ সেন্টিমিটার ওপরে ও কানাইঘাট পয়েন্টে এখনো ৮০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এখনো শঙ্কামুক্ত নন সিলেটের বানভাসিরা।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) জানিয়েছে, ১২ ঘণ্টায় সুরমা, সারি, গোয়াইন, ডাউকি নদীর পানি কমেছে। তবে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে বয়ে চলছে সুরমা। এ অঞ্চলেও মানবেতর জীবনযাপন করছেন লাখ লাখ বানভাসি। অনেকে ঠাঁই নিয়েছেন আশ্রয়কেন্দ্রে। আশ্রিতদের অভিযোগ, তারা সেখানে পর্যাপ্ত খাবার পাচ্ছেন না।
সিলেট সদর উপজেলার শহরতলির নিম্নাঞ্চল ভেসে গেছে বানের জলে। এসব এলাকার বাজার, দোকানপাট, বাসাবাড়ি ও অলিগলি তলিয়ে গেছে পানিতে। সড়কে বসেছে ভাসমান বাজার। বাসায় পানি ওঠায় দুর্ভোগে পড়েছেন টুকেরবাজার এলাকার মানুষ।
এদিকে চেরাপুঞ্জিতে ২৪ ঘণ্টায় ভারী বৃষ্টি না হওয়ায় কমতে শুরু করেছে নগরীর নিম্নাঞ্চলের পানি। তবে সুরমা তীরবর্তী কলাপাড়া, শেখঘাট, কুশিঘাট, কালীঘাট, ছড়ারপার, মাছিমপুর, মেন্দিবাগ ও উপশহরের বাসাবাড়ির পানি কমছে ধীরগতিতে। এতে পানিবন্দি মানুষ অসহায় হয়ে পড়েছেন। এই কয়েক দিনে কয়েক দফা জলাবদ্ধতায় আক্রান্ত হয়েছেন সুরমার জনপদের মানুষ।
সিলেট নগরীর বিভিন্ন বন্যাকবলিত কয়েকটি এলাকা পরিদর্শন করেছেন দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মো. মহিববুর রহমান এমপি। বুধবার নগরীর মিরাবাজার কিশোরী মোহন বালক বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্রে ত্রাণ
বিতরণ করেন তিনি।
সিলেট নগরীর বন্যা পরিস্থিতি দেখে তাৎক্ষণিক নগদ ১০ লাখ টাকা, ১০০ মেট্রিক টন চাল ও ২ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার ত্রাণ সহায়তা প্রদান করেন প্রতিমন্ত্রী মো. মহিববুর রহমান এমপি। এর আগে তিনি কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার নিম্নাঞ্চল পরিদর্শন করেন।
অপরদিকে সিলেটের গোয়াইনঘাট এলাকায় বন্যাকবলিত মানুষের নিয়মিত খাবার বিতরণ করছে জেলা পুলিশ ও উপজেলা প্রশাসন, জানালেন গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. তৌহিদুল ইসলাম।
পাউবো সিলেট জোনের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ বলেন, ভারতের চেরাপুঞ্জিতে টানা পাঁচ দিন অতি ভারী বৃষ্টি হওয়ায় সিলেটে বন্যা দেখা দিয়েছে। ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টি কম হওয়ায় ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে পানি। তবে সারি ও ডাউকি নদী ছাড়া সুরমা-কুশিয়ারার পানি এখনো বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
সিলেট আবহাওয়া অফিসের আবহাওয়াবিদ শাহ মো সজীব হোসাইন জানান, সিলেটে হালকা রোদের পাশাপাশি মাঝারি ও ভারী বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে।
বৃহস্পতিবার জেলা প্রশাসন থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, সিলেটে ৯ লাখ ৫৭ হাজার ৪৪৮ জন মানুষ পানিবন্দি রয়েছেন। সিলেট জেলা ও নগর মিলিয়ে ৬৯৮টি আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে ২১ হাজার ৭৮৬ জন পানিবন্দি মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন।
জেলা প্রশাসন বলছে, সবচেয়ে বেশি মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে রয়েছেন কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার। উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নের ১১৩টি গ্রামের ৯৫ হাজার ৫০০ জন মানুষ বন্যায় আক্রান্ত হয়েছেন এবং আশ্রয়কেন্দ্রে রয়েছেন ৭ হাজার ৩০৩ জন। উপজেলার বঙ্গবন্ধু মহাসড়ক বাদে বাকি সব সড়ক পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে। যার কারণে উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকার মানুষজন নৌকা ছাড়া বাড়ি থেকে বের হতে পারছেন না।
বৃহস্পতিবার পানি একটু কমেছে জানিয়ে সিলেট সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা সাজলু লস্কর বলেন, নগরীর ৪২টি ওয়ার্ডের মধ্যে ২৮টি ওয়ার্ডের ১ লাখ মানুষ পানিবন্দি রয়েছেন। নগরীতে ৮০টি আশ্রয়কেন্দ্রের মধ্যে মধ্যে ২২টি কেন্দ্রে মানুষজন উঠেছেন। সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর নির্দেশনায় আশ্রয়কেন্দ্র ছাড়াও বন্যাকবলিত এলাকায় রান্নাকরা ও শুকনা খাবার, বিশুদ্ধ পানি, ওষুধসহ প্রয়োজনীয় সামগ্রী বিতরণ করা হচ্ছে। এছাড়া বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢল অব্যাহত থাকায় সিটি কর্তৃপক্ষ সার্বক্ষণিক বন্যা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে রাখছে।
সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোহাম্মদ মোবারক হোসেন বলেন, 'সিলেটের বন্যা পরিস্থিতির এখন অবস্থা হলো- কোথাও পানি কমেছে; আবার কোথাও বেড়েছে। তবে কুশিয়ারা নদীর একটি পয়েন্ট ছাড়া অন্য নদ-নদীর পানির লেভেল আগের থেকে নেমেছে। বন্যার্ত এলাকায় প্রশাসনের ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত রয়েছে। জেলা প্রশাসন বন্যা পরিস্থিতির ওপর সতর্ক দৃষ্টি রাখছে।'
আমাদের কানাইঘাট (সিলেট) প্রতিনিধি জানান, বন্যাকবলিত এলাকার লোকজনদের সরকারি ত্রাণসামগ্রী সার্বক্ষণিকভাবে পৌঁছে দেওয়ার জন্য উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৯টি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও পৌর মেয়রকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সরকারি ২৪টি আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নেওয়া ১ হাজার ১৬২ জন মানুষের মাঝে এক বেলা খাবার নিশ্চিত করার জন্য চাল, ডাল, আলু, তৈল, মসলা পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি শুকনো খাবার, পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট, খাবার স্যালাইন বিতরণ করা হচ্ছে। তবে প্রয়োজনের তুলনায় সরকারি ত্রাণসামগ্রী কম বলে বানভাসি মানুষ জানিয়েছেন।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফারজানা নাসরিন বলেন, উপজেলার প্রায় ৭ হাজার ৬৪৯টি পরিবার এখনো পানিবন্দি রয়েছেন। প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রতিটি ইউনিয়নে দু'টি করে নৌকার মাধ্যমে পানিবন্দি এলাকার লোকজনের নিরাপদ স্থানে ও আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসা হচ্ছে। ১২টি মেডিকেল টিম রয়েছে। প্রতিটি ইউনিয়নে সরকারি ট্যাগ অফিসার নিয়োজিত আছেন এবং জনপ্রতিনিধিদের সার্বক্ষণিকভাবে পানিবন্দি লোকজনের খোঁজখবর নেওয়াসহ তাদের আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে সম্প্রতি বন্যায় বরাদ্দ পাওয়া ত্রাণসামগ্রী প্রতিটি আশ্রয়কেন্দ্র ও পানিবন্দি এলাকায় বিতরণ করা হচ্ছে। পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে ভাঙনকবলিত ডাইক মেরামতের কাজ শুরু হবে।
এদিকে গোয়াইনঘাট প্রতিনিধি জানান, বুধবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে গোয়াইনঘাট উপজেলায় কাপনা নদীতে নৌকা ডুবে নিখোঁজ যুবকের মরদেহ উদ্ধার করা হয় বলে গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইএনও) মো. তৌহিদুল ইসলাম জানান। মৃত ব্যক্তি হলেন- উপজেলার ফতেহপুর ইউনিয়নের ফতেহপুর গ্রামের শিব্বির আহমদের ছেলে মোহাম্মদ সাদাত হোসেন।
ইউএনও বলেন, 'সাদাতকে উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য সিলেটে এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।'
অন্যদিকে বন্যার কারণে সিলেট মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের উচ্চমাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষা ৮ জুলাই পর্যন্ত স্থগিত করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
দুপুরে আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি এবং ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
তিনি বলেন, সিলেট বিভাগের বিভিন্ন জেলায় বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ। সেখানে বহু স্কুল-কলেজ ডুবে গেছে। আবার ঘরবাড়ি ডুবে যাওয়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার মতো পরিস্থিতিতেও নেই শিক্ষার্থীরা। সার্বিক দিক বিবেচনায় ৮ জুলাই পর্যন্ত পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে।