উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পাহাড়ধসে ১০ মৃতু্য
প্রকাশ | ২০ জুন ২০২৪, ০০:০০
ফারুক আহমদ, উখিয়া (কক্সবাজার)
ভারী বর্ষণে কক্সবাজারের উখিয়ার বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় ৮ রোহিঙ্গাসহ ১০ জনের মৃতু্য হয়েছে। নিহতদের মধ্যে এক স্কুলছাত্রসহ দু'জন স্থানীয় বাসিন্দা রয়েছেন। মঙ্গলবার মধ্যরাত থেকে বুধবার সকাল পর্যন্ত উখিয়ার ৮, ৯, ১০ ও ১৪ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটে বলে নিশ্চিত করেন শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মো. মিজানুর রহমান।
নিহতরা হলেন, উখিয়ার বালুখালীর ৮ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মো. আনোয়ারের ছেলে মো. হারেজ, ৯ নম্বর ক্যাম্পের আলী জহুরের ছেলে মো. হোসেন আহম্মেদ, একই ক্যাম্পের আলী জোহারের মেয়ে আনোয়ারা বেগম, জামালের ছেলে মো. সালমান, ১০ নম্বর বালুখালী ক্যাম্পের আবুল কালাম, মতিউর রহমানের মেয়ে সলিমা খাতুন, আবুল কালামের ছেলে আবু মেহের, শরিফ হোসেনের মেয়ে জানু বিবি। অপর বাংলাদেশির নাম-পরিচয় জানা যায়নি।
উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এম গফুর উদ্দিন চৌধুরী জানান, ১৪ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পাশে ৪ নম্বর ওয়ার্ডের চোরাখোলা গ্রামে মাটির দেয়াল চাপা পড়ে শাহ আলমের স্কুলপড়ুয়া পুত্র আবদুর রহিম (১২) মৃতু্য হয়েছে। সে থাইংখালী উচ্চ বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ৮ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক ও অতিরিক্ত ডিআইজি মো. আমির জাফর জানান, মঙ্গলবার থেকে উখিয়া ও টেকনাফ এলাকায় টানা বৃষ্টি হচ্ছে। বুধবার ভোরে উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের বালুখালীর কয়েকটি ক্যাম্পে পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটে। এতে রোহিঙ্গাদের বেশ কয়েকটি ঘর মাটি চাপা পড়ে যায়।
তিনি আরও জানান, খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিস, রেড ক্রিসেন্ট, এপিবিএন পুলিশসহ সিপিপি দলের সদস্যরা ঘটনাস্থলে উদ্ধার তৎপরতা চালিয়েছে। নিহতদের লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য কক্সবাজার সদর হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়েছে।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. শামসুদ্দৌজা জানান, উদ্ধার তৎপরতার পাশাপাশি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ি এলাকায় বসবাসরত রোহিঙ্গাদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের উপ-পরিচালক অতীশ চাকমা জানান, রাত তিনটার দিকে বালুখালী ৯ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্প পাহাড়ধসে ২ জন মৃতু্য হয়। ফায়ার সার্ভিসের টিম তাদের উদ্ধার করে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করে। ঠিক ওই সময় ভোর ৬টায় পাহাড়ধসে আরও ২ জন রোহিঙ্গার মৃতু্য হয়েছে। এছাড়া ১০ নম্বর ক্যাম্পে ১ জন, ১৪ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ১ জন, ৮ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ২ জনসহ ৮ জন রোহিঙ্গা মৃতু্যবরণ করেন। নিহতদের মধ্যে একজন নারীও রয়েছে।
উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শামীম হোসেন জানান, পাহাড়ধসে মৃতু্য হওয়া ব্যক্তিদের সুরতাহাল রিপোর্ট তৈরি শেষে ময়নাতদন্তের জন্য কক্সবাজার সদর হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়েছে।
পাহাড়ে বসবাসকারীদের সরতে মাইকিং
এদিকে টানা ভারী বর্ষণে কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলায় ছয় হাজারের বেশি মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। পানিতে তলিয়ে গেছে ফসলি জমি ও চিংড়ির ঘের। প্রাণহানি রোধে পাহাড়ি ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের সরে যেতে মাইকিং করছে উপজেলা প্রশাসন।
মঙ্গলবার সন্ধ্যা থেকে বুধবার সকাল থেকে ভারী বর্ষণের কারণে টেকনাফ উপজেলায় পাহাড়ি ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের অন্যত্র সরে যেতে বলা হচ্ছে।
উপজেলার হ্নীলা ইউনিয়নের মৌলভীবাজার, ওয়াব্রাং, চৌধুরীপাড়া, রঙ্গিখালী লামারপাড়া, চৌধুরীপাড়া, সাবরাং ইউনিয়নের পতে আলীপাড়া, বাহারছাড়াপাড়া, কুড়া বুইজ্জ্যাপাড়া, মুন্ডার ডেইলপাড়া গ্রামের আড়াই হাজার পরিবারের পাঁচ হাজারের বেশি মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। পাশাপাশি টেকনাফ পৌরসভার ১২টি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ধসের ঝুঁকিতে রয়েছে ২০ হাজার মানুষ। ভারী বৃষ্টিতে পাহাড়ধসে এসব মানুষের প্রাণহানির আশঙ্কা করা হচ্ছে।
পুরাতন পলস্নানপাড়া পাহাড়ের তীরে বসবাসকারী মো. জোবাইর বলেন, 'টানা বৃষ্টির কারণে ভয়ে আছি। এ সময়ে নির্ঘুম রাত কাটে। অন্য সময় তেমন একটা ভয় কাজ করে না। তাছাড়া দুপুর থেকে এখান থেকে সরে যেতে মাইকিং করা হচ্ছে।'
ভারী বর্ষণে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন রঙ্গিখালী লামারপাড়ার বাসিন্দার নুর বাহার। তিনি বলেন, 'বাড়িতে পানি ঢুকেছে, ফলে ঘরের সব কিছু পানিতে তলিয়ে গেছে। সকাল থেকে শুধু ছনা মুড়ি খেয়ে দিন পার করছি। কেউ আমাদের খোঁজ নিতে আসেনি। আমাদের আশপাশের ৩৫টি পরিবার রয়েছে। সবার ঘরবাড়ি ডুবে গেছে। মূলত স্স্নুইসগেটের কারণে আমরা সবাই পানিবন্দি।'
হ্নীলার বাসিন্দা মোহাম্মদ শেখ রাসেল বলেন, 'ভারী বৃষ্টিতে আমাদের অনেক গ্রাম তলিয়ে গেছে। এতে হাজারো মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এসব মানুষের কষ্টের শেষ নেই। তবে প্রশাসনের পক্ষ থেকে আগে থেকে কোনও সতর্ক বার্তা দেওয়া হয়নি ভারী বৃষ্টির বিষয়ে।'
হ্নীলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রাশেদ মোহাম্মদ আলী বলেন, 'ভারী বর্ষণে আমার এলাকার চারটি গ্রামের তিন হাজারের বেশি মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। মূলত সীমান্ত সড়কের স্স্নুইসগেট থেকে বৃষ্টির পানি পর্যাপ্ত পরিমাণে বের হতে না পারায় এসব এলাকা পানিবন্দি হয়ে পড়ে। আমরা তাদের খোঁজ নিচ্ছি।'
সাবরাং ইউনিয়ন পরিষদের ১ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মো. সেলিম বলেন, 'ভারী বর্ষণের কারণে আমার এলাকায় প্রায় ১৫০ পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ড্রেন-খাল দখলের কারণে পানি চলাচলের জায়গা বন্ধ হয়ে পড়েছে। যার কারণে এসব মানুষের এই করুণ দশা।'
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আদনান চৌধুরী বলেন, 'ভারী বর্ষণে কয়েকটি গ্রামের মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। আমরা তাদের খোঁজ নিচ্ছি। পাশাপাশি অতি ভারী বৃষ্টির কারণে পাহাড়ধসের সম্ভাবনা রয়েছে। তাই সকাল থেকে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারীদের অন্যত্র সরে যেতে বলা হচ্ছে। তারা আশ্রয়কেন্দ্র চলে গেলে পাহাড়ধসে প্রাণহানি থেকে রক্ষা পাবে। এ ছাড়া পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারী জান-মাল রক্ষায় সিপিপি সদস্যরা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। পাশাপাশি আশ্রয়কেন্দ্রগুলো প্রস্তুত রেখেছি।'