শনিবার, ০২ নভেম্বর ২০২৪, ১৭ কার্তিক ১৪৩১
নিষিদ্ধের ২২ বছরেও বন্ধ হয়নি উৎপাদন

পরিবেশের পাঁজরে পলিথিনের থাবা

বীরেন মুখার্জী
  ২০ জুন ২০২৪, ০০:০০
পরিবেশের পাঁজরে পলিথিনের থাবা

পস্নাস্টিক পণ্য পরিবেশ এবং মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর হলেও দেশে এর উৎপাদন ও ব্যবহার অব্যাহতভাবে বাড়ছে। পস্নাস্টিকের সঙ্গে থাকা রাসায়নিকের বিষে মাটি, পানি, বায়ুসহ ধুঁকছে প্রকৃতি। গবেষণা বলছে, পস্নাস্টিকের দূষণে মাটি হারিয়ে ফেলছে উৎপাদন ক্ষমতা। পানিতে মিশে নদীর প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করছে, কমাচ্ছে পানির ধারণক্ষমতা। পস্নাস্টিক পোড়ানোর পর বাতাসে মিশছে এর রাসায়নিক। এমনকি খাদ্যপণ্যের সঙ্গে মানুষের পেটেও যাচ্ছে পস্নাস্টিকের বিষ। ঝুঁকি তৈরি করছে ক্যানসারসহ মারাত্মক অসংক্রামক রোগের। হুমকিতে পড়ছে জীববৈচিত্র্য।

বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে ২০০২ সালে বাংলাদেশে পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ করা হলেও বর্তমানে বৈধ পণ্যের মতোই পলিথিন ব্যাগ ও পস্নাস্টিকের তৈরি বিভিন্ন পণ্য ব্যবহার হচ্ছে। দেশের ৩ হাজার কারখানায় প্রতিদিন ১ কোটি ৪০ লাখ পলিথিন ব্যাগ উৎপাদিত হচ্ছে। দেশের ৮০ শতাংশ মানুষ প্রতিদিন পলিথিন ও পস্নাস্টিক সামগ্রী ব্যবহার করছেন। পস্নাস্টিকের থাবায় পরিবেশের পাঁজর ভাঙলেও এর লাগাম টানতে নেই কোনো উদ্যোগ। পরিবেশ আইনে পস্নাস্টিক পণ্যের উৎপাদন ও বাজারজাতকরণে জেল-জরিমানার বিধান থাকলেও এর প্রয়োগ নেই। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিধিগত সমস্যা আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে আছে।

বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, পস্নাস্টিক ও পলিথিন ব্যবহারের দিক থেকে বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষ দশে। এছাড়া ২০০৫ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে এর ব্যবহার তিনগুণের বেশি বেড়েছে। ঢাকায় একবার ব্যবহারের পর এগুলোর ৮০ শতাংশ মাটিতে ফেলা হয়। সেখান থেকে নালা ও খাল হয়ে নদীতে যায়। সর্বশেষ এগুলোর ঠাঁই হয় বঙ্গোপসাগরে। দেশের তিন প্রধান নদী পদ্মা, মেঘনা ও যমুনায় দিনে ৭৩ হাজার টন পস্নাস্টিক ও পলিথিন পড়ে।

এদিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে,

৭৩ শতাংশ মাছে রয়েছে মাইক্রোপস্নাস্টিক বা পস্নাস্টিকের ক্ষুদ্র কণা, যা স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। পস্নাস্টিক মাটি ও পানির ক্ষতি করে মানুষের বিপদ ডেকে আনছে।

গবেষণা অনুযায়ী, পরিবেশের পাঁজরে ভয়াবহ থাবা বসিয়েছে পস্নাস্টিক ব্যাগ বা পলিথিন ব্যাগ। পস্নাস্টিক বর্জ্যের মধ্যে পলিথিন সবচেয়ে ক্ষতিকর। পৃথিবীজুড়ে প্রতি মিনিটে ১০ লাখ পস্নাস্টিক ব্যাগ মানুষ ব্যবহারের পর ফেলে দেন। বিপুল পরিমাণ এই পস্নাস্টিক ব্যাগ তৈরিতে মোট খনিজ তেলের ৪ শতাংশ ব্যবহৃত হয় প্রতি বছর। পস্নাস্টিক ব্যাগ জৈব বিয়োজনশীল নয়। এক টন পাট থেকে তৈরি থলে বা বস্তা পুড়ালে বাতাসে ২ গিগা জুল তাপ এবং ১৫০ কিলোগ্রাম কার্বন ডাইঅক্সাইড ছড়িয়ে পড়ে। অন্যদিকে এক টন পস্নাস্টিক ব্যাগ পোড়ালে বাতাসে ৬৩ গিগা জুল তাপ ও ১৩৪০ টন কার্বন ডাইঅক্সাইড মিশে।

গবেষণার সঙ্গে যুক্ত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ফাহমিদা পারভীন বলেন, 'আমরা ১৮ প্রজাতির ৪৮টি মাছের ওপর পরীক্ষা চালাই। এর মধ্যে ১৫ প্রজাতির মাছের পরিপাকতন্ত্রে পস্নাস্টিকের ক্ষুদ্র কণার অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। পস্নাস্টিক বর্জ্য পানিতে ফেললে ফটোকেমিক্যালি ও বায়োলজিক্যালি ভেঙে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণায় পরিণত হয়। এগুলো পানিতে ফেললে মাছ খাবারের সঙ্গে খেয়ে ফেলে। এভাবে মাছের শরীরে হয়ে পস্নাস্টিক চলে যায় মানুষের দেহে। এতে ক্যানসারসহ নানা রোগ হতে পারে।'

পরিবেশের ভয়াবহ ক্ষতি বিবেচনায় বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে বাংলাদেশই সবার আগে পলিথিনকে আইন করে নিষিদ্ধ করেছিল। কিন্তু বর্তমানে বাজারে পলিথিনের আধিপত্য দেখলে বুঝার উপায় নেই যে, ২২ বছর আগে এই পলিথিনই দেশে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।

বর্তমান বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তনে এক সংকটাপন্ন সময় পার করছে। এমন উদ্বেগজনক পরিস্থিতির মধ্যেই এ খাতের ব্যবসায়ীরা সম্প্রতি সংবাদ সম্মেলন করে পস্নাস্টিক শিল্পের মৌলিক কাঁচামালের আমদানি শুল্ক ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩ শতাংশ করার দাবি জানান। ব্যবসায়ীদের ভাষ্য, পস্নাস্টিকের সব মৌলিক কাঁচামালই পেট্রোকেমিক্যালজাত পণ্য; যার শতভাগ আমদানি করতে হয়। আর গত দুই বছরে আন্তর্জাতিক বাজারে এসব কাঁচামালের মূল্য অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশীয় শিল্পের সুরক্ষার স্বার্থে মৌলিক কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক কমানো প্রয়োজন। ২০২২-২৩ সালের বাজেটে পস্নাস্টিকের কাঁচামাল আমদানির ওপর ৩ শতাংশ অগ্রিম কর আরোপ করা হয়।

বাংলাদেশ পস্নাস্টিক দ্রব্য প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিপিজিএমইএ) তথ্য বলছে, দেশে পস্নাস্টিক খাতে স্থানীয় বহু শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। নতুন নতুন বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর পরিবেশবিদরা বলছেন, যেখানে পস্নাস্টিক পণ্যের উৎপাদন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ, সেখানে এই শিল্পের বৃদ্ধি নিঃসন্দেহে উদ্বেগের অন্যতম কারণ।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীতে দিনে প্রায় ২ কোটি পলিথিনের ব্যাগ জমা হয়। একটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, ঢাকার লালবাগ, কামরাঙ্গীরচর এলাকায় পস্নাস্টিকের কারখানা আছে কয়েকশ'। লালবাগের চান্দিরঘাটের প্রায় পুরোটাই পস্নাস্টিক উৎপাদনের কারখানা। এখানে প্রকাশ্যে চলে নিষিদ্ধ এই পলিথিনের উৎপাদন ও বিক্রি। ঢাকার ৮০ শতাংশ ড্রেন পলিথিনে আবদ্ধ। জলাবদ্ধতায় অনেক সময় প্রাণহানির ঘটনাও ঘটছে। বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, বংশী, শীতলক্ষ্যা, ধলেশ্বরী নদী, বরিশালের কীর্তনখোলা নদী, চট্টগ্রামের কর্ণফুলী ও হালদা নদীর তলদেশে পলিথিনের পুরু স্তর পড়েছে। এ কারণে নদী দূষণের পাশাপাশি জীববৈচিত্র্যও ধ্বংস হচ্ছে। পলিথিনের প্রভাবে নদীর গভীরতা কমে যাচ্ছে। সেইসঙ্গে নদীতে কমছে মাছের সংখ্যাও।

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, দেশে বছরে ৮ লাখ ২১ হাজার ২৫০ টন পস্নাস্টিক বর্জ্য উৎপন্ন হয়। এর মাত্র ৪০ শতাংশ, অর্থাৎ ২ লাখ ২৮ হাজার টনের মতো রিসাইকেল বা পুনর্ব্যবহার হয়। সারা দেশের যে বর্জ্য উৎপন্ন হয়, তার ৩০ শতাংশের বেশি হয় রাজধানী ঢাকায়। দেশের প্রধান শহরটিতে বছরে প্রায় আড়াই লাখ টন, অর্থাৎ দিনে ৬৮১ টনের মতো বর্জ্য উৎপন্ন হয়। সারা দেশে দিনে এর পরিমাণ ২ হাজার ২৫০ টন।

জানা যায়, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে পরিবেশ অধিদপ্তরকে ২০২১ সালের মধ্যে এ ধরনের পস্নাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ করার আদেশ দেন হাইকোর্ট। এরপর সাড়ে তিন বছর কেটে গেলেও এ বিষয়ে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই।

পস্নাস্টিকের দূষণ বিষয়ে 'বেলা'র প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, '২০০৫ সালে দেশে বছরে জনপ্রতি পস্নাস্টিকের ব্যবহার ছিল ৩ কেজি। ২০২৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৩ কেজি। একটা পস্নাস্টিক বোতল ১ হাজার বছর, পলিব্যাগ ৪৫০ বছর ও পস্নাস্টিকের স্ট্র ৭০০ বছর টিকে থাকতে পারে। বিশ্বে প্রতি বছর ১ কোটি ২০ লাখ টন পস্নাস্টিক বিভিন্ন সমুদ্রে যাচ্ছে। পস্নাস্টিক দূষণের কারণে প্রতি বছর ১০ লাখ সামুদ্রিক পাখি ও ১ লাখ সামুদ্রিক প্রাণী মারা যাচ্ছে। এর মূল কারণ পস্নাস্টিকের দাম ও সহজলভ্যতা।'

তিনি বলেন, 'আমরা মনে করছি, পস্নাস্টিক সস্তা। কিন্তু লবণ, চিনি ও মাছের মধ্যে মাইক্রোপস্নাস্টিকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। আমার-আপনার পেটের ভেতরেও পস্নাস্টিক প্রবেশ করতে শুরু করেছে। মায়ের দুধেও পস্নাস্টিকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। কম দামের পস্নাস্টিকে সাময়িক লাভ হয়তো হচ্ছে, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতির পরিমাণই বেশি।'

ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা) সংগঠনের সদস্য সচিব শরীফ জামিল সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, 'বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এরই মধ্যে পলিথিন ও পস্নাস্টিক বর্জন করার ঘোষণা দিয়েছে। সমুদ্রের তলদেশ পলিথিন ও পস্নাস্টিকে ভরে গেছে। একটি পলিথিন মাটিতে পুঁতে রাখলে তা নষ্ট হতে সময় লাগে প্রায় ৪০০ বছর। এক কথায় পলিথিন ও পস্নাস্টিক আমাদের সামগ্রিক জীবন খেয়ে ফেলছে। পলিথিন নিষিদ্ধের আইন শুধু কাগজে-কলমে। এছাড়া পস্নাস্টিক এখন রিসাইকেল হচ্ছে, সেগুলোর মান ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। রিসাইকেল-বিষয়ক নীতিমালা হওয়া জরুরি।'

পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-১৯৯৫-এর ১৫ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি নিষিদ্ধ পলিথিন সামগ্রী উৎপাদন করে, তাহলে ১০ বছরের কারাদন্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা, এমনকি উভয় দন্ডে দন্ডিত হতে পারে। সেইসঙ্গে পলিথিন বাজারজাত করলে ছয় মাসের জেলসহ ১০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান করা হয়। যদিও আইনের সর্বোচ্চ ব্যবহারের নজির দেশে বাস্তবায়ন হয়নি।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনার অধ্যাপক এ কে এম সাইফুল ইসলাম সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, 'আমাদের দেশে পস্নাস্টিক নিয়ে কোনো সচেতনতা নেই, কর্মসূচিও নেই। কখনো কখনো দুই-এক দিনের কর্মসূচি বা অভিযান হয়। কিন্তু তারপর আবার যেমন আছে তেমনই চলতে থাকে।'

সম্প্রতি বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী একটি সংবাদ মাধ্যমে বলেন, 'নিঃসন্দেহে পলিথিন ও পস্নাস্টিক পরিবেশের জন্য মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে এনেছে। সমস্যা হচ্ছে, যে কাঁচামাল দিয়ে পলিথিন তৈরি হয়, তা অন্য শিল্পেও ব্যবহৃত হয়। ফলে চাইলেই আমরা পলিথিনের কাঁচামাল আমদানি বন্ধ করতে পারি না।'

'এক্ষেত্রে আইন ও বিধিগত কিছু সমস্যা আছে। রয়েছে জনবল সংকটও। অভিযান পরিচালনা করা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। আমরা পলিথিন ও ক্ষতিকর পস্নাস্টিক উৎপাদনকারীদের বিরুদ্ধে শিগগির অভিযান পরিচালনা করব। তবে এটা সত্যি যে, আমরা পরিবেশ রক্ষা বা সংরক্ষণে সফল হতে পারিনি। না পারার দায় স্বীকার করা একটি বড় অর্জন বলে আমি মনে করি' বলেও উলেস্নখ করেন তিনি।

এছাড়া গত ৪ জুন সচিবালয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, 'আমাদের ১০০ দিনের কর্মসূচিতে এক্সটেন্ডেন্ট প্রডিউসার রেসপনসিবিলিটির কথা আছে। অর্থাৎ, যারা পস্নাস্টিক পণ্য ব্যবহার করবে, আমরা তাদের দূষণের জন্য দায়ী করব। এ জন্য তাদের একটি অর্থনৈতিক মূল্য নির্ধারণ করে দেব। উৎপাদন ও নকশায় কীভাবে তারা পস্নাস্টিকের ব্যবহার কমিয়ে আনবে, সেটাও বলা হবে। ইপিআরের খসড়া বড় বড় কোম্পানি ও চেম্বারের কাছে পাঠিয়েছি। তাদের সঙ্গে আলোচনা চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে এসেছি। আমরা ধাপে ধাপে এগিয়ে যাচ্ছি।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে