কোরবানিতে '১৫ লাখ টাকার ছাগল' বিক্রি নিয়ে লঙ্কাকান্ড
প্রকাশ | ২০ জুন ২০২৪, ০০:০০
বিবিসি বাংলা
বাংলাদেশের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এই মুহূর্তে যে আলোচনা তুঙ্গে, তা হলো রাজধানী ঢাকার 'এক এগ্রো ফার্ম থেকে কোরবানি উপলক্ষে ১৫ লাখ টাকায় একটি ছাগল কিনেছেন' একজন রাজস্ব কর্মকর্তার ছেলে।
যদিও এ বিষয়ে যে রাজস্ব কর্মকর্তার নাম বারবার উঠে আসছে, ওই ক্রেতা আসলেই তার ছেলে কিনা, সে বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট প্রমাণ বা বক্তব্য পায়নি বিবিসি।
তবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) জ্যেষ্ঠ তথ্য কর্মকর্তা সৈয়দ এ. মু'মেন এটুকু নিশ্চিত করেছেন যে, ওই নামে একজন কর্মকর্তা আছেন এনবিআরে। কিন্তু ছাগল কেনার সঙ্গে ওই কর্মকর্তার ছেলেই জড়িত কিনা, সে বিষয়ে তিনি কিছু জানাতে পারেননি।
এদিকে, ঢাকার মোহাম্মদপুরে অবস্থিত 'সাদিক এগ্রো' ফার্ম থেকে বলা হচ্ছে, আলোচিত তরুণ শুধুমাত্র এক লাখ টাকা দিয়ে ছাগলটি বুক করেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি পুরো টাকা পরিশোধ করে ছাগলটিকে খামার থেকে বাড়িতে নিয়ে যাননি এখনো।
শুধু তাই নয়, এই খামার থেকে আরও বলা হচ্ছে, যিনি ছাগলটি বুক করেছিলেন তারা খোঁজ নিয়ে দেখেছেন যে, তার বাবা জাতীয় রাজস্ব
বোর্ডের কোনো কর্মকর্তা নন। যদিও সাদিক এগ্রোর এই দাবির সত্যতা যাচাই করতে পারেনি বিবিসি।
তবে ক্রেতার বাবা যিনি-ই হোন না কেন- প্রশ্ন উঠছে যে, '১৫ লাখ টাকায় ছাগল কেনা' কি কোরবানির উদ্দেশ্য বা ধারণার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ?
ছাগলের দাম কেন লাখ টাকা?
যে ছাগলের দাম নিয়ে এত জল্পনা-কল্পনা, তা হলো পৃথিবীর সবচেয়ে বড় জাতের ছাগল, বলেছেন সাদিক এগ্রোর মালিক মোহাম্মদ ইমরান হোসেন। তিনি বলেন, এ জাতের নাম 'বিটল' এবং 'বাংলাদেশে এটি এ যাবৎকালের সবচেয়ে বড় ছাগল'।
আলোচিত ওই ধূসর বাদামি রঙের ছাগলটির ওজন ১৭৫ কিলোগ্রাম এবং উচ্চতা ৬২ ইঞ্চি। মি. হোসেন জানান, 'বিরল প্রজাতির এই ছাগল বাংলাদেশে এখন একটিই আছে।'
এটি আমদানি করা হয়েছিল কিনা জানতে চাইলে ইমরান হোসেন জানান, দুই মাস আগে ছাগলটি যশোরের একটি হাট থেকে ক্রয় করা হয়েছিল।
যশোরের হাটে এই ছাগল কীভাবে এলো? এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'আমরা তা জানি না। তবে এরকম ছাগল, বড় বড় গরু প্রাথমিক পর্যায়ে গ্রামেগঞ্জের হাটেই বিক্রি হয়। হাট থেকে কিনে এনে আমরা সেগুলো লালন-পালন করে বিক্রি করি। আমাদের কাছে যখন তথ্য আসছে, আমরা সঙ্গে সঙ্গে লোক পাঠিয়ে টাকা দিয়ে এটা কিনে নিয়ে আসছি। কারণ আমাদের কাছে ছাগলটাকে খুব ভালো লেগেছে।'
ইমরান হোসেনের দাবি, 'এই ছাগলটির ক্রয়মূল্যই পড়েছিল ১০ লাখ ৩৫ হাজার টাকা। তার সঙ্গে আনুষঙ্গিক আরও খরচ আছে।'
সেজন্যই এর দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল ১৫ লাখ টাকা। ছাগলের দাম বেশি হওয়ার আরেকটি কারণ হলো উন্নত জাত ও বংশমর্যাদা।
এখানে বংশমর্যাদার বিষয়টি ঠিক কী, তা জানতে চাইলে ইমরান হোসেন বলেন, ভালো বংশমর্যাদার ছাগল বা গরুর ক্ষেত্রে বিক্রির সময় ক্রেতার কাছে সার্টিফিকেট দেখানো হয়।
অবিক্রীত রয়ে গেছে সেই ছাগল?
সাদিক এগ্রো বিটল প্রজাতির ওই ছাগলটির দাম ১৫ লাখ টাকা চাইলেও তা ১২ লাখ টাকায় বিক্রির চুক্তি করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটি অবিক্রীতই রয়ে গেছে বলে দাবি করেন ইমরান হোসেন।
সাদিক এগ্রো'র ইমরান হোসেন বলেন, 'ওই ছেলেটা ছাগলটা ডেলিভারি নেয়নি। এক লাখ টাকা অ্যাডভান্স দিয়ে বুক করেছিল। এ মাসের ১২ তারিখে বাকি টাকা পরিশোধ করে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু এরপর আমরা যোগাযোগ করতে পারিনি, কারণ ওকে আর খুঁজে পাইনি।'
তাহলে, এখন কী ক্রেতার আগাম টাকা ফেরত দিয়ে দেওয়া হবে? তিনি বলেন, 'ওর সঙ্গে তো যোগাযোগই করতে পারছি না। ওর যদি কোনো ভ্যালিড রিজন থাকে, তাহলে অবশ্যই আমরা ওর অ্যাডভান্সের টাকা ফেরত দেব। কিন্তু যদি সেটা না থাকে এবং ও যদি আমাদের সঙ্গে দুষ্টুমি করার জন্য এটা করে থাকে, তাহলে এই টাকাটা ফোরফিট (বাজেয়াপ্ত) করে দেব আমরা। কারণ এই ছাগলটা তো আমাদের থেকে অনেকেই কিনতে চেয়েছিল। কিন্তু ও আমাদের থেকে বুক করছিল বলেই আমরা কারও কাছে সেটা বিক্রি করতে পারিনি।'
ফেসবুকে তুলকালাম
ঘটনার শুরু গত সপ্তাহে, যখন আলোচিত ছাগল সঙ্গে নিয়ে এক তরুণকে উচ্ছ্বসিত ভঙ্গিতে কথা বলতে দেখা যায়।
ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া এক ভিডিওতে ওই ক্রেতাকে অন ক্যামেরায় বলতে শোনা যায়, '১১ জুন এটি ধানমন্ডি ৮-এ ডেলিভারি দেওয়া হবে।'
ভাইরাল হওয়া সেই ভিডিওতে ওই তরুণকে বলতে দেখা যায়, 'এরকম একটি খাসি কেনা আমার স্বপ্ন ছিল। এরকম খাসি আমি সামনা-সামনি দেখিনি। আমার জীবনে প্রথম দেখা এটা। এটা আমার হবে, জানা ছিল না। আলস্নাহ নসিবে রাখছে, তাই হইছে। এর থেকে বেশি কিছু আর কী বলব।'
ভিডিও ভাইরাল হয়ে যাওয়ার পর নেটিজেনদের অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৫ লাখ টাকা দামের সেই ছাগলটির ক্রেতা একজন রাজস্ব কর্মকর্তার ছেলে।
এছাড়া, তরুণের বয়স তুলনামূলক কম। এত কম বয়সি একজন, এত চড়া দাম দিয়ে কীভাবে ছাগল কেনে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন নেটিজেনরা। তবে আলোচিত তরুণ কিংবা তার বাবার সঙ্গে বিবিসি কথা বলতে পারেনি।
ফেসবুকে ফারিবি চৌধুরী নামক একজন ব্যবহারকারী ওই ক্রেতার ছাগলটির সঙ্গে তোলা এক ছবি শেয়ার করে লিখেছেন, 'চেহারা দেখে মনে হচ্ছে ছেলেটির বয়স সর্বোচ্চ ২৫ বছর হবে। এ দেশের সরকারি চাকরিজীবীরা একেকজন বিল গেটস, ইলন মাস্ক, মুকেশ আম্বানি, গৌতম আদানি। সাধারণ সরকারি অফিসারদের ছেলের যদি এ অবস্থা হয়, বুঝেন..'
ফেসবুকে এই বক্তব্যটি অন্তত কয়েকশ' আইডি ও পেইজ থেকে পোস্ট ও শেয়ার করা হয়েছে।
শরৎ চৌধুরী নামক আরেকজন ফেসবুকে লিখেছেন, 'আপনারা হয়ত ভুলে গেছেন, তবে আমি ভুলিনি। যখন দেখি কর্মকর্তার সন্তান লাখ দশেকেরও ওপরে টাকা দিয়ে ছাগল কিনছে, আমি তখন দেখতে পাই সেই রকম কর্মকর্তারাই বেইলি রোডে মানুষ পোড়ানোর সিস্টেমের নানান সার্টিফিকেট দিয়ে এসেছেন।'
সাদিক এগ্রো'র বক্তব্য
চলমান বিতর্কের মধ্যে সাদিক এগ্রো'র মালিক মোহাম্মদ ইমরান হোসেন দাবি করেছেন, 'আমি যতটুকু জানি, যে ছেলেটা আমার কাছ থেকে ছাগল কিনেছে, তার বাবা বিদেশে থাকেন।'
তিনি বলেন, 'আমার কাছ থেকে কোনো রাজস্ব কর্মকর্তা ছাগল কেনেনি, একটি তরুণ ছেলে কিনেছে। এখন ওর বাবা কে, সেটি তো আমি বলতে পারি না। তবে এটা নিয়ে যখন নিউজ হলো, তখন আমরা আউট অব কিউরিওসিটি থেকে, নট আউট অব রেসপন্সিবিলিটি, খোঁজ নিয়ে দেখলাম যে রাজস্ব কর্মকর্তার কথা বলা হচ্ছে, তিনি ছাগলটির ক্রেতার বাবা নন। '
তবে তিনি 'আসলে নিশ্চিত নন' বলে উলেস্নখ করে বলেন, 'একজন গ্রাহক যখন আমাদের কাছে কিনতে আসেন, তখন তার ফ্যামিলি হিস্ট্রি জানার অধিকার নাই আমাদের।'
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, এমনকি গণমাধ্যমেও বিভিন্ন মহল থেকে বলা হচ্ছে যে, ছাগলের এই অস্বাভাবিক দাম বাজারে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করছে। কিন্তু ইমরান হোসেন বলেন, 'এ আলোচনা একেবারেই অযৌক্তিক এবং ভিত্তিহীন।'
তিনি জানান, কোরবানি উপলক্ষে এবার তিনি ১২০০ ছাগল ও ২১০০ গরু খামারে তুলেছিলেন। এত ছাগলের মাঝে কেবল একটির দাম ছিল ১৫ লাখ টাকা। বাকি ছাগলগুলোর দাম ১৫-২০ হাজার টাকা, যা মূলত 'আমজনতার ছাগল।'
আর গরুর ক্ষেত্রে মাত্র একটি গরুর দাম ছিল এক কোটি টাকা। বাকি যে গরুগুলো, সেগুলোর দাম ছিল ৭০-৮০ হাজার বা দেড় লাখ টাকা।
ইমরান হোসেন বলেন, 'কিন্তু এগুলো নিয়েও আলোচনা হচ্ছে না। আমার কাছে দামি যে পশু আছে, সেগুলো তো পার্সেন্টেজেই আসে না।'
তিনি জানান, গত বছর তিনি ৪০০ কেজির নিচের গরু কেজিপ্রতি ৫২৫ টাকা করে বিক্রি করেছেন। এ বছর তারা চার শতাংশ কমিয়ে ৫০০ টাকা কেজিতে বিক্রি করেছেন। যেগুলো আমজনতার গরু-ছাগল, সেগুলোর দাম চার শতাংশ কমিয়ে দিয়ে যেগুলো বিরল, তার দাম যদি ১০-২০ শতাংশ বেশি রাখি- তাহলে মানুষের কেন সমস্যা হবে?
তার প্রশ্ন, 'দামি গরুতে প্রফিট করে আমজনতার গরুতে কমপেন্সেট করায় খারাপ কিছু দেখি না। তাহলে আমি দাম বাড়ানোর কারিগর হিসেবে কীভাবে চিহ্নিত হলাম?'
এত দামি পশু কোরবানির ধারণার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ?
তবে স্বভাবতই প্রশ্ন উঠছে যে, ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এত দামি পশু কোরবানি দেওয়া কোরবানির মূল ধারণার সঙ্গে কি সামঞ্জস্যপূর্ণ?
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের গবেষণা বিভাগের মুফতি মাওলানা মোহাম্মদ আব্দুলস্নাহ জানান, এটি আইনগত ও নৈতিক বিবেচনার ওপর নির্ভর করবে। মাসলা মতে, কারও যদি সামর্থ্য থাকে, তবে সে ১৫ লাখ টাকা দিয়ে ছাগল, কিংবা এক কোটি টাকা দিয়ে গরু কোরবানি দিতে পারেন। এটা আইনের কথা।
এখন যিনি এত টাকা খরচ করে কোরবানি দিচ্ছেন, সেই টাকার উৎস বা বৈধতা যাচাই-বাছাই করা গোয়েন্দাদের কাজ মন্তব্য করে তিনি বলেন 'কিন্তু নৈতিকতা বিবেচনায়, এভাবে করা উচিত না। কারণ এক-দুই লাখ টাকা দিয়ে একটি পশু কোরবানি দিলে আপনার নূ্যনতম ওয়াজিব পালিত হয়ে যাচ্ছে। বাকি টাকাটা সমাজের গরিব-দুঃখী মানুষ যারা আছে, রাষ্ট্রের কত হাজার হাজার মানুষ না খেয়ে থাকে, ফুটপাতে থাকে, ওই টাকাটা ওদের জন্য ইনভেস্ট করলে আরও বেশি সওয়াব পাবেন।'
যদিও ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ওই একই বিভাগের মুহাদ্দিস ড. ওয়ালীয়ুর রহমান খান মনে করেন, ঘুষের টাকা ও দুর্নীতির টাকা ছাড়া এত দাম দিয়ে পশু কেনা সম্ভব না এবং সেটি বিবেচনা করলে এটি কোরবানির মূল ধারণার সঙ্গে 'সাংঘর্ষিক ও অন্যায়।'
রাজস্ব বিভাগের কি কিছু করণীয় আছে?
এমন পরিস্থিতিতে এনবিআর কী কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে? এ বিষয়ে এনবিআর'র সাবেক চেয়ারম্যান ড. মুহাম্মদ আবদুল মজিদ বলেন, 'রাজস্ব বিভাগ পারে। কিন্তু তার পরিবেশগত ও পদ্ধতিগত সীমাবদ্ধতা আছে। যদি প্রমাণ হয় যে, অমুকের ছেলে এটা করেছে, তাহলে তারা এটা টুকে নিতে পারে এবং তার আয়করের ফাইল দেখতে পারে যে, সেখানে এই আয়ের বিষয়ে কিছু বলা আছে কিনা। তার একটা ব্যাখ্যা চাইতে পারে বা অডিট করতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সেটি কে করবে? কতক্ষণ করবে? কাকে দিয়ে করাবে? তারা নিজেরাই যদি অন্যায়-অনিয়মের বিষয়ে যুক্ত থাকে, করাপট থাকে, তারা তখন এ বিষয়ে কাজ করতে পারে না। সীমাবদ্ধতা এখানেই।'
তবে এত দাম দিয়ে ছাগল কেনার সাহস সম্বন্ধে তিনি বিস্মিত হন। তিনি বলেন, '১৫ লাখ টাকা দিয়ে একটা ছাগল কেনা অসামঞ্জ্যপূর্ণ মনে হয়। কিন্তু এটা ঠিক যে কারও কারও এত টাকা হয়ে গেছে যে, এটা ঠিক করা যাচ্ছে না। এনবিআর কর্মকর্তা বা যারই ছেলে হোক, খাসি কিনতেছে এত টাকা দিয়ে, এটা সমাজে বৈষম্য সৃষ্টি করল। টাকা দিয়ে দাম বাড়িয়ে দিল জিনিসটার।'
তিনি মনে করেন, কারও অঢেল সম্পদের খবর জানার পর দুদক ও এনবিআর'র উচিত তাদের ফাইলগুলো দেখা। তিনি বলেন, 'কিন্তু বর্তমান সংস্কৃতিতে কার ঘাড়ে কয়টা মাথা আছে যে, ওই ব্যক্তিদের ফাইল নিয়ে প্রশ্ন করবে বা দেখবে?'