প্রিয়জনের সঙ্গে ঈদুল আজহার আনন্দ ভাগাভাগি করতে নাড়ির টানে বাড়ি ছুটছেন মানুষ। ঈদযাত্রার চতুর্থ দিন শনিবারও রাজধানীর বিভিন্ন বাস টার্মিনাল, ট্রেন স্টেশন ও লঞ্চ টার্মিনালে ছিল ঘরমুখো মানুষের উপচেপড়া ভিড়। ঈদের সময় ঘনিয়ে আসায় যাত্রীর চাপ বেড়েছে। আর যাত্রীর চাপ সামাল দিতে বেড়েছে গণপরিবহণের সংখ্যা। এতেই সড়ক মহাসড়কের বিভিন্ন অংশে কমেছে গাড়ির গতি। শনিবারও বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়কে যানবাহনের ধীরগতির পাশাপাশি কোথাও কোথাও যানজটের খবর পাওয়া গেছে। অতিরিক্ত যানবাহন ও টোল আদায়ে বিলম্বের কারণে শনিবার বঙ্গবন্ধু সেতু-ঢাকা মহাসড়কের টাঙ্গাইল অংশে পাঁচ কিলোমিটার যানজট এবং ১৩ কিলোমিটার অংশে ধীরগতিতে চলেছে যানবাহন।
এদিকে শনিবার ভোর থেকে ২
কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে শিডিউল অনুযায়ী গন্তব্যমুখী বিভিন্ন ট্রেন ছেড়ে গেলেও টিকিট কাউন্টারে লেগে ছিল দীর্ঘ লাইন। কমিউটার ট্রেন এবং আন্তঃনগর ট্রেনের স্ট্রান্ডিং টিকিট পেতে এ লাইন পার্কিং এরিয়ার পৌঁছে যায়। দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে হলেও ঈদ করতে বাড়ি ফিরতে চান যাত্রীরা। এ দিন সদরঘাট টার্মিনালে যাত্রী উপস্থিতি বেশি থাকলেও ভোগান্তিহীনভাবেই যাত্রা করেন যাত্রীরা। অন্যদিকে, নামি ও পরিচিত বাসের টিকিট শেষ হয়ে যাওয়ায় অনেকেই অনামি বাসের টিকিট কিনেছেন। সেক্ষেত্রে অনেক যাত্রীই দরদাম করে টিকিট কিনেছেন। শনিবারও বাস টার্মিনালগুলোতে উপচেপড়া ভিড় ছিল ঘরমুখো মানুষের।
শনিবার ঢাকা রেলওয়ে স্টেশনে দেখা যায় দীর্ঘ লাইন দাঁড়িয়ে হলেও ঈদ করতে বাড়ি যেতে চান যাত্রীরা। ঢাকা থেকে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ৮টি কমিউটার ট্রেন দেশের বিভিন্ন স্থানে নিয়মিত যাতায়াত করে। এসব ট্রেনের টিকিট যাত্রা শুরুর আগে বেসরকারি কাউন্টার থেকে দেওয়া হয়ে থাকে। অন্যদিকে বাংলাদেশ রেলওয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আন্তঃনগর ট্রেনের যাত্রা শুরুর ২ ঘণ্টা আগে ট্রেনের মোট আসনের ২৫ শতাংশ টিকিট স্ট্যান্ডিং হিসেবে বিক্রি করা হয়।
আন্তঃনগর ট্রেনের কাউন্টারের সামনে লাইনে দাঁড়ানো যাত্রীরা বলেন, বসার সিট না পেলেও তারা দাঁড়িয়ে হলেও বাড়ি যেতে চান। তবে তারা অনেকেই জানেন না আন্তঃনগর ট্রেনের শুধু শোভন শ্রেণির ২৫ শতাংশ টিকিট দেওয়া হবে। এতে অনেকে ফিরেও গেছেন টিকিট না পেয়ে।
তিতাস কমিউটার ট্রেনে ব্রাহ্মণবাড়িয়া যাবেন খলিলুর রহমান। তিনি বলেন, 'তিতাস ট্রেনের টিকিটের কোনো লিমিট নেই। এরা যতক্ষণ পারবে টিকিট বিক্রি করে যাবে।'
কর্ণফুলী কমিউটার (৪) ট্রেনটি ঢাকা রেলওয়ে স্টেশনের ২ নম্বর পস্ন্যাটফর্ম থেকে সকাল ৮টা ৪৫ মিনিটের ছেড়ে যাওয়ার কথা ছিল। তবে সেটি ছেড়ে যেতে পারেনি সঠিক সময়ে। ১০ মিনিট বিলম্ব নিয়ে ৮টা ৫৫ মিনিটে ট্রেনটি ঢাকা স্টেশন ত্যাগ করে।
আন্তঃনগর ট্রেনের কাউন্টারের লাইনে দাঁড়িয়ে জামালপুরগামী যাত্রী নাহিদ হোসেন বলেন, '২৫ শতাংশ স্ট্যান্ডিং টিকিট দেয়। তবে অনেক সময় পাওয়া না পাওয়ার একটা বিষয় থাকে। এখন একটা স্ট্যান্ডিং টিকিট পেলেই হলো।'
শনিবার সকালে রাজধানীর গাবতলী বাস টার্মিনালে দেখা যায়, যারা অনলাইনে টিকিট কেটেছেন, তারা এসে সরাসরি যাত্রা করছেন। তবে যারা অনলাইনে টিকিট কাটেননি, তারা টার্মিনালে এসে খোঁজ করছেন টিকিটের। তবে যাত্রী চাহিদা বেশি থাকায় অধিকাংশ কাউন্টার চড়া দামে টিকিট বিক্রি করছে। কেউ কেউ সে দামে কিনতে পারলেও অনেকে পড়ছেন ভোগান্তিতে।
ঝিনাইদহ যাওয়ার জন্য পরিবারসহ টার্মিনালে এসেছেন সাগর আহমেদ। টিকিটের জন্য ঘুরেছেন বেশ কয়েকটি কাউন্টারে। কেউ বলছে টিকিট নেই, কেউ চাইছে বেশি ভাড়া, আবার কোথাও এক বাসে মিলছে না চারটি সিট।
সাগর আহমেদ বলেন, 'এক কাউন্টারে গেলাম সেখানে নাকি ৪টা টিকিট নেই। কিন্তু আমি তো পরিবারসহ যাব। আবার অন্য কাউন্টারে টিকিট পেলেও ভাড়া অনেক চাইছে। এখন অপেক্ষা করে দেখি অন্য বাসের টিকিট মেলে কিনা।'
কাউন্টারের লোকজন বলছেন, যাত্রীর তুলনায় বাস একটু কম। ফলে কোনো কোনো যাত্রীকে টিকিট দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তাছাড়া ঈদ উপলক্ষে ভাড়া একটু বেশি রাখা হচ্ছে। কারণ অধিকাংশ বাস ঢাকায় ফিরবে খালি অবস্থায়।
রাজবাড়ীর আমজাদ বলেন, 'রেগুলার যে ভাড়া, তার থেকে ২-৩শ' টাকা বেশি চাইছে। বাড়ি তো যাওয়া লাগবে, তাই দামাদামি করে টিকিট নিতে হয়েছে।'
দ্রম্নতি পরিবহণের কর্মচারী কামরুল বলেন, 'আমাদের টিকিট আছে, যাত্রীরা এসে কাটতে পারবেন। নির্ধারিত ভাড়া দিয়েই যাত্রীরা ভ্রমণ করতে পারবেন।'
এদিকে সিঁড়িতে রেলিং না দেওয়ায় ও নিয়ম না মেনে পল্টুনে লঞ্চ ভেড়ানোর চেষ্টা করায় শনিবার সদরঘাটে দু'টি লঞ্চকে জরিমানা করেছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহণ কর্তৃপক্ষ (বিআইডবিস্নউটিএ)।
বিআইডবিস্নউটিএ'র উপ-পরিচালক এহতেশামুল পারভেজ জানান, বিআইডবিস্নউটিএর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্র্রেট ঢাকা নদী বন্দরে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করেন। এ সময় এমভি গেস্নারী অব শ্রীনগর-৭ লঞ্চটির সিঁড়িতে রেলিং না দেওয়ায় ৩ হাজার টাকা এবং এমভি জামাল-৯ লঞ্চটি নিয়ম না মেনে বার্দিং করার চেষ্টা করলে এক হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। মোবাইল কোর্ট পরিচালনার সময় নৌ-পুলিশ, আনসার ও বিআইডবিস্নউটিএর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সার্বিক সহযোগিতা করেন।
বঙ্গবন্ধু সেতু-ঢাকা মহাসড়কে যানজট, ধীরগতি
স্টাফ রিপোর্টার, টাঙ্গাইল জানান, শনিবার যানবাহনের অতিরিক্ত চাপে বঙ্গবন্ধু সেতু-ঢাকা মহাসড়কের পাঁচ কিলোমিটারে যানজট ও ১৩ কিলোমিটারে ধীরগতিতে যানবাহন চলাচল করেছে। মহাসড়কে লক্কড়-ঝক্কড় মার্কা যান বিকল, সেতুর টোলপস্নাজায় টোল আদায় বন্ধ রাখায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
জানা যায়, শুক্রবার রাত ১২টার পর থেকে কিছু সময়ের জন্য টোলপস্নাজায় টোল আদায় বন্ধ রাখা হয় এবং দফায় দফায় লক্কড়-ঝক্কড় মার্কা যানবাহন বিকল হওয়ায় শনিবার সকাল সাড়ে ৮টা পর্যন্ত যানজটে ভোগান্তি পোহান যাত্রী ও চালকরা। টোল আদায় নিরবচ্ছিন্ন এবং মহাসড়ক থেকে বিকল যানবাহনগুলো সরিয়ে নেওয়ায় সকাল ৯টার পর বঙ্গবন্ধু সেতুর টোলপস্নাজা থেকে এলেঙ্গা পর্যন্ত পাঁচ কিলোমিটারে যানজট ও ১৩ কিলোমিটারে ধীরগতিতে যানবাহন চলাচল করছে।
পোশাক শ্রমিক সায়েম মিয়া জানান, শনিবার সকাল ৬টায় গাজীপুর থেকে রওনা হয়ে তিন ঘণ্টায় তিনি এলেঙ্গায় পৌঁছেছেন। সলস্না থেকে পুরোপুরি যানজট শুরু হয়েছে- বঙ্গবন্ধু সেতু পার হতে যে কতক্ষণ সময় লাগবে তা তিনি বলতে পারছেন না।
পুলিশ ও সেতু কর্তপক্ষ জানায়, শনিবার ভোরে সেতুর ওপর যানজটের চাপ বেড়ে যায়। এছাড়া মহাসড়ক ও সেতুতে কয়েক দফায় কয়েকটি গাড়ি বিকল হয়ে যায়। পরে বিকল হওয়া যানবাহনগুলো সরিয়ে নিতে কিছুটা সময় লেগে যায়। ফলে অতিরিক্ত গাড়ির চাপে যানজটের সৃষ্টি হয়।
এলেঙ্গা হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির ওসি মীর মো. সাজেদুর রহমান জানান, শনিবার ভোর থে?কে মহাসড়?কে প?রিবহণের ধীরগ?তি হয়। চালকদের বেপরোয়া গাড়ি চালানো ও বিকল যানের কারণে মহাসড়কে যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। যানজট নিরসনে কাজ করছে পুলিশ।
খোলা ট্রাকে ঝুঁকি ফিরছেন মানুষ
বাস ভাড়া বেশি নেওয়ায় প্রচন্ড রোদে খোলা ট্রাক, পিকআপভ্যান ও থ্রি-হুইলারের যাত্রী হয়েও বাড়ি যাচ্ছেন শিশু-বৃদ্ধ নারী ও পুরুষ। শনিবার দুপুরে বঙ্গবন্ধু সেতু-ঢাকা মহাসড়কের এলেঙ্গা বাসস্টেশন, রাবনা বাইপাস, আশেকপুর বাইপাস, জোকারচর, হাতিয়া ও সলস্না এলাকা ঘুরে এমন চিত্র দেখা যায়।
পাবনার সন্দেশ আলী নামে এক পিকআপভ্যানের যাত্রী জানান, ঢাকা থেকে বাসে দুই গুণেরও বেশি ভাড়া নেওয়া হচ্ছে। এজন্য বাধ্য হয়েই ৩০০ টাকা ভাড়ায় টাঙ্গাইলের রাবনা বাইপাস পর্যন্ত এসেছেন। পিকআপভ্যানটি আর যাবে না। এরপরের রাস্তাটুকুও তিনি খোলা ট্রাক বা সিএনজি চালিত অটোরিকশা বা পিকআপভ্যানে চেপে যাবেন।
এ বিষয়ে এলেঙ্গা হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ (ওসি) মীর সাজেদুর রহমান জানান, পিকআপভ্যান ও খোলা ট্রাকের ছাদে যেন যাত্রী না নেওয়া হয় সেজন্য তারা বাধা দিচ্ছেন। যারা কথা শুনছেন না তাদের বিরুদ্ধে মামলাও দেওয়া হচ্ছে। তাছাড়া সিএনজি চালিত অটোরিকশা বা থ্রি-হুইলার মহাসড়কে দেখতে পেলেই মামলা দেওয়া হচ্ছে।