কমেছে চড়া দরের হাঁকডাক হাটে বেড়েছে বেচাকেনা
প্রকাশ | ১৬ জুন ২০২৪, ০০:০০
সাখাওয়াত হোসেন
গত বছর কোরবানির পশুর হাটে যে গরু ৮০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে, সে একই সাইজের গরুর দাম একদিন আগেও সোয়া লাখ টাকা হেঁকেছেন গৃহস্থরা। তাদের সঙ্গে পালস্না দিয়ে দরকষাকষিতে আরও একধাপ এগিয়ে ছিলেন ছোট-বড় খামারি ও গরুর বেপারীরা। তবে শুক্রবার মধ্যরাতের পর রাজধানীর প্রায় প্রতিটি হাটেই গবাদি পশুর সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় বাজারদর এখন বেশখানিকটা কমেছে। এতে বিক্রেতাদের হাসিমাখা মুখ কিছুটা মলিন হলে ক্রেতাদের মাঝে কিছুটা হলেও স্বস্তি ফিরে এসেছে। বেচাকেনার গতি বাড়ায় খুশি হাট ইজারাদাররাও।
তবে ঈদের মাত্র এক-দুইদিন আগে যেভাবে ট্রাক-মিনি ট্রাক ও ট্রলার-নৌকায় ভরে হাজার হাজার গরু-ছাগল ও মহিষ-ভেড়া পালস্না দিয়ে ঢাকায় ঢুকছে তাতে সব পশু কোরবানির জন্য বিক্রি হবে কিনা তা নিয়েও সৃষ্টি হয়েছে শঙ্কা। অনেকের ধারণা, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে সংসার চালাতে হিমশিম অধিকাংশ মধ্যবিত্ত এবার ভাগে গরু কোরবানি দেবেন। আর স্বল্প আয়ের যেসব মানুষ আগে ভাগে কোরবানি দিতেন তাদের অনেকে এবার কোরবানি দেওয়া থেকে বিরত থাকতে
\হপারেন। তাই এবার রাজধানীতে কোরবানির পশুর চাহিদা বেশখানিকটা কমবে।
এদিকে ভারতীয় গরু আসা বন্ধ না হওয়ায় দেশি পশুর দাম চড়া থাকার যে সম্ভাবনা ছিল, তা-ও বেশখানিকটা কেটে গেছে। বেশ কিছুদিন ধরে ভারত ও মিয়ানমার থেকে বিপুলসংখ্যক গরু এসেছে। এতে শেষ সময়ে বাজারদর আরও নিম্নমুখী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করছেন হাট সংশ্লিষ্টরা।
সরেজমিন রাজধানী ঢাকার অস্থায়ী হাটগুলো ঘুরে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার থেকে আনুষ্ঠানিক বেচাকেনা শুরু হলেও এর আগেই বিপুলসংখ্যক বেপারী তাদের গবাদি পশু নিয়ে হাটে হাজির হয়েছেন। সুযোগ বুঝে কিছুটা চড়া দরেই দু'চারটে করে গরু-ছাগল-মহিষ বিক্রি করেছেন। তবে বৃহস্পতিবার আনুষ্ঠানিকভাবে বিক্রি শুরুর পর হাটে ক্রেতা সমাগম সেভাবে দেখা যায়নি। যারা এসেছেন তারাও দরকষাকষি করেই সময় পার করেছেন। এ সময় বিক্রেতারা বেশখানিকটা চড়া দর হেঁকেছেন। শুক্রবার ঢাকার হাটগুলোতে মানুষের ভিড় বাড়লেও বেচাকেনা সেভাবে বাড়েনি।
ক্রেতাদের অভিযোগ, চড়া দর হেঁকে বিক্রেতারা খুঁটি ধরে থাকায় অনেক ক্রেতাই কোরবানির পশু না কিনে শুক্রবার বাড়ি ফিরে গেছেন। তবে এদিন মধ্যরাতের দিকে দাম কিছুটা পড়তে শুরু করে। এরপর থেকেই মূলত বেচাকেনা বেড়েছে। যদিও শনিবার দুপুর পর্যন্ত ঢাকার হাটগুলো আশানুরূপভাবে জমে ওঠেনি।
হাট সংশ্লিষ্টরা জানান, বর্তমানে ঢাকার হাটে কোরবানির পশু বেচা-বিক্রির যে গতি, তাতে এ ধারা অব্যাহত থাকলে বিপুলসংখ্যক গরু-মহিষ অবিক্রীত রয়ে যাবে। তবে শনিবার মধ্যরাতের পর থেকে বেচাবিক্রির গতি অনেকখানি বাড়বে। একই সঙ্গে কোরবানির পশুর দরও কমবে বলে আশা করেন তারা
শনিবার সকালে সরেজমিনে মেরাদিয়া হাট ঘুরে দেখা গেছে, হাটটিতে এখনো গরু আসছে। বিক্রেতাদের দাম হাঁকানোর ক্ষেত্রে গত দুই দিনের চেয়ে সতর্ক থাকতে দেখা গেছে। প্রত্যাশার কাছাকাছি দাম পেলেই পশু বিক্রি করে দিয়েছেন বেপারীরা।
কুষ্টিয়া থেকে ১৯টি গরু নিয়ে বৃহস্পতিবার বিকালে হাটে এসেছেন জয়নাল মিঞা। তিনি জানান, শুক্রবার পর্যন্ত মাত্র ৩টি গরু বিক্রি করেন। তবে শনিবার দুপুরে একসঙ্গে তিনটি গরু বিক্রি হয়। রোববার সকালের মধ্যে সব গরু বিক্রি করতে চান তিনি।
মেহেরপুর থেকে ১৩টি গরু নিয়ে আসা খামারি মিরাজুল হক জানান, এখন পর্যন্ত কোনো গরু বিক্রি করতে পারেননি। তার দেড়-দুই লাখ টাকার গরুর দাম ১ লাখ ২০ থেকে ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা পর্যন্ত উঠেছে। অথচ এ দামে গরু বিক্রি করলে তার কয়েক লাখ টাকা লোকসান হবে। তাই তিনি ভালো ক্রেতার অপেক্ষা করছেন। প্রতিটি গরুতে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা লাভ হলেই বিক্রি করে দেবেন বলে জানান এই খামারি।
গত বছরের মতো ৭ প্রতিবেশী মিলে এবারো এক গরু কোরবানি দেবেন শাহিন আলম। তাই সবাই মিলে কমলাপুর হাটে গরু কিনতে এসেছেন। অনেক যাচাই-বাছাই করে দুপুরের আগেই ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা দিয়ে একটি ষাঁড় গরু কিনেছেন। শাহিন জানান, বৃহস্পতিবারও এসব গরুর দাম বেপারীরা পৌনে ২ লাখ টাকা থেকে সোয়া দুই লাখ টাকা পর্যন্ত হেঁকেছেন। ওই ক্রেতার দাবি, গত বছর এই সাইজের গরু ১ লাখ ২০ হাজার টাকা দিয়ে কিনেছিলেন। গো-খাদ্যের দাম বাড়ায় গবাদি পশুর দাম এবার কিছুটা বাড়বে এটাই স্বাভাবিক বলে মনে করেন তিনি।
বেচাকেনা সম্পর্কে জানতে চাইলে কমলাপুর কোরবানির পশুর হাটের ইজারাদারের লোকজন জানান, বৃহস্পতি ও শুক্রবারের তুলনায় শনিবার সকাল থেকে বিক্রি বেশখানিকটা বেড়েছে। তবে শনিবার মধ্যরাত থেকে রোববার মধ্যরাত পর্যন্ত বেচাকেনা আরও ভালো হবে।
যাত্রাবাড়ি হাট ঘুরে দেখা গেছে, প্রচুর গরু উঠেছে হাটটিতে। এরপরও ট্রাক ভরে গরু আসছে। তাই উদ্বিগ্ন গৃহস্থরা অনেকে কিছুটা কম দামেই গরু ছেড়ে দিচ্ছেন। ক্রেতারাও সহজেই পছন্দের গরু কিনতে পারছেন। তবে কিছু খামারি ও বেপারী এখনো চড়া দরে গরু-ছাগল বিক্রির চেষ্টা করছেন।
শনিবার ঢাকার হাটগুলোতে ছোট সাইজের গরু বিক্রি হয়েছে ৬০ থেকে ৭৫ হাজার টাকা; মাঝারি সাইজের গরু ১ লাখ ২০ থেকে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। বড় গরু ২ লাখ থেকে ১০-১২ লাখ টাকাতেও বিক্রি হয়েছে।
পাবনা থেকে ২১টি গরু নিয়ে এ হাটে এসেছেন মনিরুল। এ পর্যন্ত ভালো দামে ৮টি গরু বিক্রি করেছেন। তার গরুগুলোর দাম ৭০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকার মধ্যে। ঈদের আগে বাকি গরুগুলোও বিক্রি হবে বলে আশা করেন তিনি।
পলিটেকনিট কলেজ হাটে মাঝারি ও বড় সাইজের ১১টি গরু নিয়ে খামারি মোকছেদ মিয়া বলেন, গত বছর তিনি ১৮টি গরু ঢাকায় এনেছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত ৫টি অবিক্রীত থেকে যায়। এসব গরু গ্রামে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে তাকে নানা ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। তাই এবার লাভ কিছুটা কম হলেও সব গরু বিক্রি করে বাড়ি ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
শনিবার সকাল থেকে বেলা আড়াইটা পর্যন্ত ঢাকার ৫টি অস্থায়ী পশুর হাট ঘুরে দেখা গেছে, সবখানেই ক্রেতাদের উপচেপড়া ভিড়। দরদাম করে অনেকেই গরু কিনছেন। ফাঁকাফাঁকি দরাদরি নেই বললেই চলে। তবে হাটের গরু ফাঁকা হওয়ার আগেই ট্রাক ভরে নতুন গরু আসছে। তাই বেচাকেনা কতটা হচ্ছে তা বোঝা যাচ্ছে না।
হাট সংশ্লিষ্টরা জানান, গত কয়েকদিন ক্রেতা-বিক্রেতাদের মধ্যে দরদামে বড় ফারাক দেখা গেলেও এখন তা অনেকটাই কমে এসেছে। বিক্রেতারা মাঝারি আকারের গরুতে টার্গেটকৃত দামের চেয়ে ২০-৩০ হাজার টাকা বেশি চাইছেন। দরাদরি শেষে স্বল্প সময়ের মধ্যেই টার্গেটকৃত দামে নেমে আসছেন। ক্রেতার পছন্দ হলে মূল্য ও হাসিল পরিশোধ করে খুশিমনে পশু নিয়ে বাড়ি ফিরছেন।
শনিবার দুপুরের দিকে ভাটারা হাট থেকে গরু কিনে মধ্য বাড্ডার বাসার দিকে ফেরা সোনালী ব্যাংক কর্মকর্তা আজমল হোসেন জানান, বুধবার থেকে তিনি দুই-তিনটি হাটে ঘুরেছেন। সবখানেই বেপারীরা বেশ চড়া দর হেঁকেছেন। তাই পশু কেনা হয়নি। কিন্তু শনিবার সকাল থেকে তাদের এ চড়া হাঁকডাক কমেছে। তাই পছন্দমত মাঝারি সাইজের গরু ১ লাখ ৪০ হাজার টাকায় কিনে নিয়েছেন। এই ব্যাংক কর্মকর্তার ধারণা, শেষ সময়ে দাম আরও কিছুটা পড়বে। ভারত ও মিয়ানমার থেকে যেভাবে পাচার করা গরু ঢাকায় ঢুকছে তাতে শেষ মুহূর্তে দেশি গরুর খামারিদের মাথায় হাত পড়তে পারে।
যশোরের গরুর খামারি নাজমুল হোসেন বলেন, ভারত-মিয়ানমার থেকে পাচার করা গরু দেশে ঢুকতে দেওয়া হবে না- সরকার এমন আশ্বাস দিলেও প্রতিশ্রম্নতি রক্ষা করতে পারেনি। হাজার হাজার পাচার করা গরু ঢাকার বিভিন্ন হাটে উঠেছে। এতে শেষ মুহূর্তে গবাদি পশুর দরে বড় ধরনের ধস নামতে পারে। তাই তিনি কোনো ঝুঁকি নিতে চান না। শনিবার সকাল থেকে ক্রেতা সমাগম বাড়ায় তিনি ১২টি গরু কাঙ্ক্ষিত দাম পেয়ে বিক্রি করে দিয়েছেন। বাকি গরু রোববার দুপুরের মধ্যে বিক্রি করে দেওয়ার টার্গেটে রয়েছেন।
শনিবার সরেজমিনে মেরাদিয়া, কমলাপুর, শাহজাহানপুর ও গাবতলী হাটে গিয়ে দেখা গেছে, দেশে পালা অস্ট্রেলিয়ান, ফ্রিজিয়ান কিংবা সিন্ধি জাতের ক্রসিং মোটাতাজা গরুর সামনে উৎসুক লোকজনের ভিড় থাকলেও এসব গরু বিক্রি কম হচ্ছে। সে তুলনায় দেশি ছোট ও মাঝারি আকারের গরু অনেক বেশি বিক্রি হচ্ছে। এসব গরুর দামও এখন সহনীয় পর্যায়ে এসে ঠেকেছে। একদিন আগেও যারা গরুর চড়া দর হেঁকে খুঁটি গেড়ে বসেছিলেন, তাদের সুরও অনেকটা নরম হয়ে এসেছে। ফাঁকাফাঁকি দাম না চেয়ে বাজারের সঙ্গে তাল রেখে তারাও তাদের গরুর দাম সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে এনেছেন। বিশেষ করে যারা বিশাল আকৃতির গরুগুলোর আকাশচুম্বী দাম হেঁকেছেন যেসব গরুর বেপারি এতদিন বাঁক ধরে ছিলেন, তারাও যেন এখন বাস্তব অবস্থা ঠাওর করতে পারছেন। অনেকেই এরইমধ্যে বুঝে গেছেন, এভাবে গো ধরে বসে থাকলে এসব গরু এবার বাড়িতেই ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে। তাই এ ধরনের গরু যারা এবার হাটে এনেছেন তারা অনেকটা উৎকণ্ঠায় সময় পার করছেন।
ভাটারা হাটের হাসিল ঘরের সামনে কথা হয় মধ্য বাড্ডা পোস্ট অফিস গলির বাসিন্দা আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে। তিনি জানান, যে গরুটি তিনি ৮৫ হাজার টাকা দিয়ে কিনেছেন, অন্য সময় এটির দাম সর্বোচ্চ ৭৫ হাজার টাকা। তবে কোরবানির সময় এ দাম স্বাভাবিক। কিছুটা রুগ্ণ হলেও এ গরুতে অন্তত সোয়া দুই মণ মাংস পাওয়া যাবে।
তিনি আরও জানান, অনেকে বলছেন আর একদিন অপেক্ষা করলে আরও কম দামে গরু কেনা যাবে। তবে সেটা ঠিক বা ভুলও হতে পারে। যেহেতু আলস্নাহর সন্তুষ্টির জন্য কোরবানি দেওয়ার মনস্থ করেছেন, তাই নিশ্চিত থাকতে কিছুটা বেশি দিয়ে হলেও পছন্দের গরুটি কিনেছেন।
রাজধানীর শাহজাহানপুর হাট ঘুরে দেখা যায়, ক্রেতারা কোনো দালালের খপ্পড়ে না পড়ে সরাসরি কৃষক ও খামারিদের কাছ থেকে চাহিদা অনুযায়ী দেশি ছোট ও মাঝারি আকারের কোরবানির পশু কিনছেন। হাটে ভারতীয় গরু না উঠায় বিক্রেতারা অনেকটা স্বস্তিতে রয়েছেন। এ হাটে বিপুলসংখ্যক গরু আসায় বেপারীরা চড়া দাম হেঁকে গরু ধরে রাখতে ভয় পাচ্ছেন।
এ হাটে গরু কিনতে আসা বাসাবর বাসিন্দা আমিনুল ইসলাম জানান, হাটে বিপুলসংখ্যক দেশি গরু উঠেছে, দামও অনেকটা সহনীয়। বিক্রেতারা আগের মতো ফাঁকাফাঁকি দাম চাওয়া ছেড়ে দিয়ে সামান্য কিছু লাভ হাতে ধরে গরু বেচার চেষ্টা করছেন। হাটে দালালদের দৌরাত্ম্য না থাকায় বরাবর তিনি এ হাট থেকেই গরু কেনেন বলে জানান আমিনুল।