মিয়ানমারে প্রচন্ড গোলাগুলি নির্ঘুম রাত সীমান্তবাসীর

আকাশে বিমান, নাফ নদীতে যুদ্ধজাহাজ সাত দিন পর ট্রলার এলো সেন্টমার্টিন থেকে

প্রকাশ | ১৪ জুন ২০২৪, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মি ও সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে গত তিনদিন ধরে প্রচন্ড গোলাগুলি চলছে। দুপক্ষের মর্টার শেল ও ভারী গোলার বিকট শব্দে কেঁপে উঠছে কক্সবাজারের টেকনাফ, শাহপরীর দ্বীপ ও প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন। সে দেশের আকাশসীমায় উড়ছে যুদ্ধবিমান এবং নাফ নদীতে যুদ্ধজাহাজ দেখেছেন স্থানীয়রা। এতে ভয় ও আতঙ্কের মধ্যে আছেন দ্বীপের বাসিন্দারা। তারা নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন। শুধু তা-ই নয়, সীমান্ত থেকে বাংলাদেশের দিকে গুলি চালানোর কারণে এক সপ্তাহ ধরে টেকনাফ-সেন্টমার্টিনের নৌ যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। ফলে ওষুধ, খাবার ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সংকটে পড়েছেন দ্বীপের প্রায় ১০ হাজার বাসিন্দা। তবে টেকনাফ-সেন্টমার্টিন নৌ-রুটে চলাচলের বিকল্প রুট খোঁজা হচ্ছে বলে জানিয়েছে জেলা প্রশাসন। স্থানীয়রা জানান, কয়েকদিন ধরে টেকনাফ-সেন্টমার্টিন নৌরুটে চলাচলকারী নৌযান লক্ষ্য করে গুলি করার ঘটনায় আতঙ্কে রয়েছেন স্থানীয়রা। এ পরিস্থিতির মধ্যেই বেশ কিছুদিন গোলাগুলি বন্ধ থাকার পর বুধবার রাত থেকে সীমান্তে নতুন করে বিস্ফোরণের বিকট শব্দ শোনা যাচ্ছে। টেকনাফ উপজেলার সাবরাং ইউনিয়ন পরিষদের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য আব্দুস সালাম জানান, বুধবার রাত ১০টার পর থেকে ১টা পর্যন্ত তার ইউনিয়নের শাহপরীর দ্বীপসহ আশপাশের সীমান্ত এলাকায় থেমে থেমে বিকট বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। মিয়ানমার থেকে ভেসে আসা মর্টারশেল ও গোলাগুলির শব্দে সীমান্তের এপারে টেকনাফের বিভিন্ন এলাকা কেঁপে ওঠে। ভয়ে-আতঙ্কে টেকনাফ সীমান্তের অনেকে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন। ইউপি সদস্য আব্দুস সালাম বলেন, 'মিয়ানমারের ওপার থেকে ভেসে আসা বিস্ফোরণের বিকট শব্দে সীমান্ত লাগোয়া শাহপরীর দ্বীপ জেটিঘাট এলাকাসহ জালিয়াপাড়া, পশ্চিমপাড়া, উত্তরপাড়া ও আচারবনিয়ার আশপাশের বসতঘর ও স্থাপনা কেঁপে ওঠে। তখন সীমান্তের একেবারে কাছাকাছি যারা থাকেন, তাদের অনেকে বাড়িঘর ছেড়ে কিছুটা দূরে স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নেন।' তিনি বলেন, 'গত কয়েক দিন ধরে নাফ নদী ও বঙ্গোপসাগরের মোহনার মাঝামাঝি এলাকায় সেন্টমার্টিন দ্বীপে যাতায়াত করা নৌযান লক্ষ্য করে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের নাইক্ষ্যংদিয়া এলাকা থেকে গুলি ছোড়ার ঘটনা ঘটেছে। এতে হতাহতের কোনো ঘটনা না ঘটলেও আতঙ্কে নৌযান চলাচল বন্ধ রয়েছে। এ পরিস্থিতির মধ্যে মিয়ানমার থেকে নতুন করে আসা বিকট শব্দ সীমান্তের মানুষের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাও বাড়িয়েছে।' কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. ইয়ামিন হোসেন বলেন, 'নাফ নদীতে একটি বড় জাহাজ দেখা গেছে এবং বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যাওয়ার বিষয়টি অবহিত রয়েছি। আমরা সর্তক অবস্থানে রয়েছি।' সীমান্ত এলাকার লোকজন জানিয়েছেন, বুধবার দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত নাফ নদীর টেকনাফ সদর ইউনিয়নের মৌলভীপাড়ায় মিয়ানমারের কাছে জাহাজটি দেখা গিয়েছিল। এরপর বুধবার রাত ৯টা থেকে এপারে ভেসে আসতে থাকে বিস্ফোরণের বিকট শব্দ। টানা তিন ঘণ্টা ধরে সীমান্তের লোকজন ওই শব্দ শুনেছেন। এরপর থেমে থেমে রাতভর শোনা গেছে। তারা বলছেন, বৃহস্পতিবার ভোর ৪টা থেকে সকাল ৯টা পর্যন্ত আবারও বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। সকালের পর সেই 'বড় জাহাজটি' দক্ষিণ দিকে সরে গিয়ে বর্তমানে টেকনাফের নাফ নদী ও বঙ্গোপসাগরের নাইক্ষ্যংদিয়া পয়েন্টে অবস্থান করতে দেখা যাচ্ছে। আর সেই জাহাজ থেকে মিয়ানমারের স্থলভাগে থেমে থেমে গোলাগুলি ও মর্টার শেলের শব্দ অব্যাহত রয়েছে। টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আদনান চৌধুরী বিকালে সাংবাদিকদের বলেন, 'সাত দিন পর বৃহস্পতিবার দুপুর ১টার দিকে সেন্টমার্টিন দ্বীপের জেটি ঘাট থেকে তিনটি ট্রলারে করে তিন শতাধিক মানুষ বিকাল ৩টায় টেকনাফে পৌঁছান। তাদের নিরাপত্তা দিয়েছে বিজিবি ও কোস্ট গার্ড সদস্যরা।' তবে বৃহস্পতিবার বেলা আড়াইটা পর্যন্ত পণ্যবাহী কোনো ট্রলার সেন্টমার্টিনের উদ্দেশে ছাড়েনি বলে জানান তিনি। অন্য দিকে টেকনাফে গত এক সপ্তাহ ধরে আটকাপড়া অন্তত চার শতাধিক মানুষ সেন্টমার্টিনে ফেরার জন্য সাবরাং ইউনিয়নের মুন্ডার ডেইল এলাকার সাগর উপকূল পয়েন্টে ট্রলারের জন্য অপেক্ষায় রয়েছেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। স্থানীয়রা ধারণা করছেন, মংডু শহর ও আশাপাশের এলাকাগুলোতে দেশটির সরকারি বাহিনী ও বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির মধ্যে তীব্র লড়াই চলছে। এতে উভয়পক্ষ ভারী অস্ত্র ও গোলাবারুদ ব্যবহার করায় বিস্ফোরণের বিকট শব্দ শোনা যাচ্ছে। এ বিষয়ে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ শাহীন ইমরান বলেন, 'মিয়ানমারে অভ্যন্তরে চলমান যুদ্ধে প্রায়ই সীমান্তে বিকট শব্দ পাওয়া যায়। এতে চিন্তার কোনো কারণ নেই। তবে গুলিবর্ষণের কারণে নৌযান চলাচল বন্ধ হওয়ায় সেন্টমার্টিনে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সংকট দেখা দিয়েছে। এটি সমাধানে আমরা টেকনাফ-সেন্টমার্টিন নৌ-রুটের বিকল্প খুঁজছি। বিষয়টি খুব গুরুত্বসহকারে দেখছি।' সেন্টমার্টিন দ্বীপের বাসিন্দা নুরুল আলম বলেন, 'দ্বীপের পূর্বে চলমান যুদ্ধে মিয়ানমারের রাখাইন মংডুতে হাসসুরাতা ও মেরুলস্ন্যা গ্রামে ব্যাপক মর্টার শেলের শব্দ হচ্ছে। ওপারের বিকট শব্দে আমার বাড়ির উঠান কেঁপে উঠেছে। এ ছাড়া সে দেশের আকাশে যুদ্ধবিমানও দেখা গেছে। জলসীমায় সে দেশের জাহাজ দেখা যাচ্ছে। সেখান থেকে আমাদের ট্রলারেও গুলিবর্ষণ করা হয়েছে।' সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) প্যানেল চেয়ারম্যান আক্তার কামাল বলেন, 'সকাল থেকে মিয়ানমার সীমান্তে ব্যাপক গোলাগুলির বিকট শব্দ এপারে পাওয়া যাচ্ছে। তবে অন্য দিনের তুলনায় সেটি বেশি। বিশেষ করে মিয়ানমার গুলিবর্ষণের কারণে টেকনাফ-সেন্টমার্টিন রুটের নৌযান চলাচল বন্ধ রয়েছে। ফলে দ্বীপের প্রায় ১০ হাজার মানুষ দুর্দশার মধ্যে পড়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যের ব্যাপক সংকট দেখা দিয়েছে।' এ ব্যাপারে কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. ইয়ামিন হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, 'বর্তমান পরিস্থিতিতে বিকল্প পথ হিসেবে বঙ্গোপসাগর হয়ে সাবরাংয়ের মুন্ডাডেইল উপকূলে আসছে নৌযানগুলো। মূলত কক্সবাজার শহরের নুনিয়ারছড়া ঘাট থেকে বড় জাহাজে করে ব্যবসায়ীরা পণ্য নিয়ে যাবেন। এটা ব্যবসায়ী এবং জাহাজ মালিকরা মিলে করবেন। প্রশাসন নিরাপত্তার বিষয়টি দেখবেন। এ ছাড়া এখন বঙ্গোপসাগর হয়ে ট্রলারে যাত্রী আসা-যাওয়া করছে। ওখানে কিছু পণ্য নিয়ে যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। ফলে সেন্টমার্টিনে খাদ্য সংকট হবে না।' টেকনাফ-সেন্টমার্টিন নৌরুটে গুলিবর্ষণের পর বর্ডার গার্ড বাংলাদেশে (বিজিবি) সতর্ক অবস্থানে রয়েছে উলেস্নখ করে টেকনাফ-২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, 'সার্ভিস ট্রলারকে গুলিবর্ষণের ঘটনায় মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) কাছে প্রতিবাদলিপি পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে।' মিয়ানমারের বিজিপি, নাকি সেখানকার বিদ্রোহী কোনো গোষ্ঠী এই গুলি চালিয়েছে, সে ব্যাপারে এখনো নিশ্চিত করে কোনো তথ্য জানাতে পারেননি এই কর্মকর্তা।