আগামী অর্থবছরের (২০২৪-২৫) প্রস্তাবিত বাজেটে প্রবৃদ্ধি, বিনিয়োগ, মূল্যস্ফীতি, বিনিময় হার ও বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভের মতো সামষ্টিক অর্থনীতির সূচকগুলোর মধ্যে সামঞ্জস্য নেই বলে মনে করে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। একই সঙ্গে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফেরাতে বাজেটে বেঁধে দেওয়া আর্থিক কাঠামো তথা আয় ও ব্যয়ের লক্ষ্যগুলো বাস্তবতার সঙ্গে মিল রেখে ধরা হয়নি বলেও মনে করে অলাভজনক এই গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি।
বুধবার রাজধানীর গুলশানে হোটেল লেকশোয়ে আয়োজিত 'সিপিডি বাজেট সংলাপ ২০২৪' শীর্ষক এক অনুষ্ঠানে সিপিডির পক্ষ থেকে এমন মতামত তুলে ধরেন আয়োজক সংস্থার নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে কর্মসংস্থান বাড়িয়ে মানুষের আয় নিশ্চিত করা, মূল্যস্ফীতির অভিঘাত থেকে দরিদ্র মানুষকে সুরক্ষা দিতে কর সুবিধার পাশাপাশি আর্থিক ও খাদ্য সহায়তা ও মানবসম্পদ উন্নয়নে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক অবকাঠামো খাতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ প্রস্তাবিত বাজেটে নেই বলে দাবি করেন তিনি।
সিপিডির ট্রাস্টি বোর্ডের ট্রেজারার সৈয়দ মঞ্জুর এলাহীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান, গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান অর্থনীতিবিদ ড. হোসেন জিলস্নুর রহমান, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী, দৈনিক বণিক বার্তার সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করে ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, 'গত দুই বছর ধরে সামষ্টিক
অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকের পতনের পরিপ্রেক্ষিতে নতুন অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির চাপ কমানো ও বিদেশি মুদ্রার স্থিতি ধরে রাখার চেষ্টার বিষয়টিকে প্রাধান্যের শীর্ষে রাখার কথা থাকলেও প্রস্তাবিত বাজেটে তা দেখা যায়নি।'
তিনি বলেন, 'আগামী অর্থবছরের বাজেটে বেঁধে দেওয়া ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য অর্জন করতে হলে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ জিডিপির ২৭ দশমিক ৬ শতাংশে উন্নীত করতে হবে। অথচ চলতি অর্থবছরে ব্যক্তি বিনিয়োগ জিডিপির ২৭ দশমিক ৪ শতাংশ লক্ষ্য ধরা হলেও তা ২৩ দশমিক ৫ শতাংশে কমিয়ে আনা হয়েছে।'
গত এক দশকের বেশি সময় ধরেই ব্যক্তি বিনিয়োগ জিডিপির ২৩-২৪ শতাংশের মধ্যে আটকে আছে জানিয়ে তিনি বলেন, 'এক বছরে বিনিয়োগ এতটা কীভাবে বাড়বে বোধগম্য নয়। চলতি অর্থবছরে ব্যক্তি খাতে ঋণপ্রবাহে ১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য থাকলেও তা ১০ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। আগামী অর্থবছরে তা আরও কমিয়ে ধরা হয়েছে ৯ শতাংশে।'
ঋণপ্রবাহ কমিয়ে বিনিয়োগ বাড়ানো সম্ভব হবে না বলেও তিনি মনে করেন।
তিনি আরও বলেন, 'গত দুই বছরের বেশি সময় ধরে ১০ শতাংশের কাছাকাছি থেকে মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনাও সম্ভব হবে না। এই মূল্যস্ফীতি কমাতে মুদ্রা সরবরাহে সংকোচনমূলক উদ্যোগ নেওয়া হলেও ফিসক্যাল পলিসিতে এর প্রতিফলন নেই। আবার বাজার ব্যবস্থাপনার উন্নয়নেও কোনো পদক্ষেপ ঘোষণা করা হয়নি বাজেটে, মন্তব্য করে ফাহমিদা বলেন, সব মিলে মূল্যস্ফীতি নামিয়ে আনা দুরূহ হবে।'
এ সময় তিনি আরও বলেন, 'রপ্তানি ও রেমিট্যান্স মন্দার মধ্যেই বিদেশি মুদ্রার গ্রস রিজার্ভের পরিমাণ ২৪ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার থেকে বাড়িয়ে আগামী অর্থবছরে ৩২ বিলিয়নে উন্নতি করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। অন্যদিকে ডলারের বিনিময় হার ১১৭ দশমিক ৭ টাকা থেকে ১১৪ টাকায় নামিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। টাকার মান শক্তিশালী করা হলে রপ্তানি, রেমিট্যান্স ও রিজার্ভে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলেও তিনি মনে করেন।'
আগামী অর্থবছরে ৫ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আহরণের লক্ষ্য পূরণও অসম্ভব হবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, 'চলতি অর্থবছরের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আগামী বছর আদায়ের লক্ষ্য ১৩ দশমিক ২ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। চলতি অর্থবছরের সংশোধিত লক্ষ্য ৪ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা থেকে বছর শেষে আদায় হতে পারে ৪ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা। এ হিসাবে আগামী অর্থবছরে এবারের প্রকৃত আদায় থেকে প্রায় ২৭ শতাংশ বাড়াতে হবে রাজস্ব আহরণে।'
বাজেটে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, স্থানীয় সরকার ও পলস্নী উন্নয়ন, বিদু্যৎ, যোগাযোগ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলা হলেও স্থানীয় সরকার, পলস্নী উন্নয়ন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে প্রকৃত বরাদ্দে খুব একটা উন্নতি হয়নি বলে মন্তব্য করেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক।
তিনি বলেন, 'রূপপুর পারমাণবিক বিদু্যৎ কেন্দ্রের ব্যয় যোগ করে একসঙ্গে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে বড় বরাদ্দ দেখানো হয়েছে। সামাজিক অবকাঠামো খাত বাজেটে পর্যাপ্ত গুরুত্ব পায়নি। তিনি বলেন, শিক্ষায় মোট বাজেটের ১১ দশমিক ৮৫ শতাংশ প্রস্তাব করা হয়েছে, যা জিডিপির ১ দশমিক ৬৯ শতাংশ।'
২০১৬ সালেও শিক্ষায় জিডিপির ১ দশমিক ৭৯ শতাংশ বরাদ্দ ছিল জানিয়ে তিনি বলেন, 'দশকের পর দশক ধরে বাজেটে শিক্ষায় পর্যাপ্ত বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে না। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় আগামী অর্থবছরে জিডিপির ৩ দশমিক ৫ শতাংশ শিক্ষায় বরাদ্দ দেওয়ার কথা ছিল বলেও তিনি জানান।'
এলডিসিভুক্ত ৩৮ দেশের মধ্যে শিক্ষায় বরাদ্দে বাংলাদেশ নিচের দিক থেকে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে, যদিও মাথাপিছু আয়ে এ সব দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
ফাহমিদা খাতুন বলেন, 'বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ এলডিসিভুক্ত দেশগুলোর গড়ের চেয়ে অনেক নিচে রয়েছে। এ খাতে এবার জিডিপির মাত্র শূন্য দশমিক ৭৪ শতাংশ ও বাজেটের ৫ দশমিক ২ শতাংশ বরাদ্দ প্রস্তাব করা হয়েছে, যা আগের বছরের চেয়ে কম। এছাড়া স্বাস্থ্য খাতে সরকারের ব্যয় চাহিদার অনেক কম থাকায় মোট চিকিৎসা ব্যয়ের ৭৫ শতাংশের বেশি জনগণের পকেট থেকে চলে যাচ্ছে।'
মূল্যস্ফীতির অভিঘাত থেকে সাধারণ মানুষকে রক্ষায় বাজেটের উদ্যোগগুলোকে একেবারেই নগণ্য আখ্যা দিয়ে এ অর্থনীতিবিদ বলেন, 'সামাজিক নিরাপত্তায় খাদ্য খাতের বেশ কয়েকটি কর্মসূচিতে বরাদ্দ কমানো হয়েছে। এর ফলে সরকারের মূল খাদ্য বিষয়ক কর্মসূচিতে বরাদ্দ শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ কমেছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, এ সময়ে এটাই বেশি বাড়ানোর দরকার ছিল।'
বাজেটে প্রকৃত বাস্তবতা মানা হয়নি বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
আলোচনায় অংশ নিয়ে সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বলেন, 'এই মুহূর্তে বাংলাদেশের জনগণ সূক্ষ্ণ সুশাসন, গণতন্ত্র চায় না। তারা চায় আরও বেশি প্রকল্প, আরও ভালো পানি, আরও ভালো রাস্তা, আরও বেশি স্কুল। গ্রামের দরিদ্র শ্রেণির ভোটাররা টিউবওয়েল, ল্যাট্রিন চায়, ছেলে-মেয়েদের জন্য উপবৃত্তি চায়। এই যখন বাস্তবতা, তখন বিরোধী দলের ভাইয়েরা বলছেন, দেশে গণতন্ত্র নাই, সে কারণে আপনারা আসতে পারছে না, এটা বলে আপনারা জাতির প্রতি দায়িত্ব অবহেলা করছেন।'
বর্তমান সরকারের উন্নয়নের রহস্য ধারাবাহিকতা, আর্থ-সামাজিক ও নীতির স্থিতিশীলতা- এমন মন্তব্য করে এমএ মান্নান বলেন, 'আমাদের জনগণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তারা উন্নয়নের পথে হাঁটবে। এটা আমাদের স্বাধীনতার মূলমন্ত্র, ঘোষণা। আমরা স্বাধীন ও সম্মানিত অর্থনীতির দেশ হতে চাই।'
সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, 'ক্ষমতার রাজনীতির বাইরে রাজনৈতিক দল জনগণকে সঙ্গে নিয়ে ভালো চর্চা করবে- এটাই নিয়ম। আমরা যে ন্যায্যতা চাই, আধুনিকতা চাই, অসাম্প্রদায়িকতা চাই... সেগুলো অর্জন করা সম্ভব হবে। এজন্য সবাইকে একত্রে কাজ করতে হবে। আওয়ামী লীগ মাঠে আছে, কখনো ছাড়ে নাই, ভবিষ্যতেও ছাড়বে না। রাজনৈতিক নেতা নয়, একজন বয়োজ্যেষ্ঠ নাগরিক হিসেবে বলব, সময় হয়েছে, আসুন, বসুন। সব কিছু সমাধান সম্ভব।'
মূল্যস্ফীতি নিয়ে সমালোচনার জবাবে এমএন মান্নান বলেন, 'আমাদের মূল্যস্ফীতি আছে। তবে এটা ক্রিপিং-ক্রিপিং মানে পায়ে পায়ে হাঁটছে। এটা যদি সবল হতো, তার ফল হতো অচিন্তনীয়। এই যে দমন করে রাখা এটা আমাদের অর্থনীতির শক্তি, আমার নয়। মূল্যস্ফীতি প্রবৃদ্ধিরই একটি ফল। একটা ছাড়া অন্যটা হয় না। মূল্যস্ফীতি যেমন হচ্ছে, তেমনি বেতন বৃদ্ধিও হচ্ছে। তার মানে ছোবলটা একটু কমছে। কার্ড, সাশ্রয়ী মূল্যে ও কাজের বিনিময়ে খাদ্য দিয়ে প্রায় ৩০ শতাংশ নিম্ন আয়ের মানুষকে টার্গেট করে সহায়তা দিচ্ছি। আমাদের মধ্য ও উচ্চবিত্তরা হয়তো সরাসরি এসব অনুভব করতে পারছে না, তবে পরোক্ষভাবে করছেন। যদি নিম্ন আয়ের মানুষদের টার্গেট করে ব্যবস্থা না নিতাম, তাহলে মূল্যস্ফীতি ১৫-১৬ শতাংশ হয়ে যেত। তার থেকে আমরা রক্ষা পেয়েছি সরকারের উদ্যোগের কারণে। প্রবৃদ্ধি চাইলে মূল্যস্ফীতি সইতে হবে। একসময় এটা কমে আসবে, এই ঝুঁকি আমাদের নিতে হবে। বড় অর্থনীতিগুলো এভাবে এগিয়েছে।'