চলতি বছরের শুরু থেকেই জ্বালানি সংকটে ভুগছে গোটা দেশ। গ্যাসের অভাবে বন্ধ হওয়ার পথে অসংখ্য শিল্প প্রতিষ্ঠান। উৎপাদন সীমিত করার পাশাপাশি জ্বালানির নিশ্চয়তা না পাওয়ায় কমেছে এ খাতে বিনিয়োগও। পর্যাপ্ত জ্বালানি না পাওয়ায় বন্ধ রয়েছে বিদু্যৎ কেন্দ্র, গুনতে হচ্ছে ক্যাপসিটি চার্জ। এ অবস্থায় সদ্য প্রস্তাবিত বাজেটে নতুন অর্থবছরে জ্বালানি খাতে কম বরাদ্দ সংশ্লিষ্ট খাত ও উদ্যোক্তাদের চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এদিকে শিল্প খাতের প্রধান জ্বালানি গ্যাসের সরবরাহ ক্রমাগতভাবে হ্রাস পাচ্ছে। সর্বশেষ ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) সরবরাহ বিঘ্নিত হওয়ায় চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ নেমেছে অর্ধেকে। অন্যদিকে বিদু্যতে গ্যাসের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়া শিল্পাঞ্চল ভেদে করা হচ্ছে গ্যাসের রেশনিং।
শিল্প উদ্যোক্তারা বলছেন, গত অর্থবছর জুড়েই শিল্পখাত গ্যাস সংকটে ভুগেছে। তাই সরকারের কাছে প্রত্যাশা ছিল নতুন অর্থবছরে কিছুটা হলে জ্বালানির সরবরাহ বাড়ানো হবে। কিন্তু বাজেটে এখাতে বরাদ্দ আরও কমানো হয়েছে। অন্যদিকে এলএনজি সরবরাহ পরিস্থিতি আরও অবনতি হয়েছে, কমেছে জাতীয় গ্রিডে নিজস্ব গ্যাসের সরবরাহ। সব মিলিয়ে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে শিল্প খাতের জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে।
প্রস্তাবিত বাজেটে জ্বালানি ও বিদু্যৎ খাতে ৩০ হাজার ৩১৭ কোটি টাকা বরাদ্দের কথা বলা হয়েছে। যা বিদায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ছিল ৩৪ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ নতুন অর্থবছরে ৪ হাজার ৫০২ কোটি টাকা বরাদ্দ কমেছে। এর মধ্যে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগে জন্য বরাদ্দ মাত্র ১ হাজার ৮৭ কোটি টাকা। অথচ ২০২২-২৩ অর্থবছরে জ্বালানি বিভাগের বরাদ্দ ছিল ১ হাজার ৭৯৮ কোটি টাকা। মূলত বিদু্যৎ খাতে নেওয়া বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে জ্বালানির থেকে বিদু্যতে বেশি বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
যদিও বিদ্যমান গ্যাস সংকট সমাধানে জ্বালানি খাতে বড় বরাদ্দের প্রত্যাশা
করেছিলেন শিল্পোদ্যোক্তা ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞারা। কিন্তু বিগত কয়েক বছরের মতোই কম বরাদ্দ পেয়েছে এ খাত।
এদিকে প্রাকৃতিক গ্যাসের ৪২ শতাংশই ব্যবহার হয় শিল্প ও শিল্পের ক্যাপটিক পাওয়ারে। কিন্তু ২০২২-২৩ অর্থবছরের তুলনায় বিদায়ী অর্থবছরে প্রায় ৬৮ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের সরবরাহ কমেছে। অন্যদিকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দিনে ৩,৮৮৩ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা প্রক্ষেপণ করা হলে গড়ে সরবরাহ হয়েছে ৬০ শতাংশের মতো। এমন বাস্তবতায় ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দিনে গ্যাসের চাহিদা প্রক্ষেপণ করা হয়ে ৩,৯৬৫ মিলিয়ন ঘনফুট এবং ২০২৫-২৬ অর্থবছরে ৪,১৭৬ মিলিয়ন ঘনফুট।
বিশ্লেষকরা বলছেন, যে হারে নিজস্ব গ্যাসের উৎপাদন কমছে তাতে এই পরিমাণ গ্যাসের চাহিদা পূরণে এলএনজি আমদানি বাড়তে হবে। এতে জ্বালানি আমদানি বাবদ সরকারের ব্যয় কয়েক গুণ বাড়বে। কিন্তু বিদ্যমান ডলার মূল্য ও রিজার্ভ পরিস্থিতি আমদানির অনুকূলে নেই। কমেছে বাজেটে বরাদ্দের পরিমাণও। বিশেষ করে নিজস্ব গ্যাস উত্তোলনে সরকারের যে মহাপরিকল্পনা রয়েছে তা পূরণে যে পরিমাণ অর্থের বরাদ্দ থাকা প্রয়োজন তা নেই, যা নতুন গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রমকেও প্রভাবিত করবে।
এদিকে আমদানি করেও গ্যাস সংকট নিরসন করতে পারছে না জ্বালানি বিভাগ। বিদায়ী অর্থবছরে স্পট ও দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় বিপুল পরিমাণ গ্যাস আমদানি করেও ট্রান্সমিশন লাইনের সীমাবদ্ধতা ও এলএনজি টার্মিনালগুলোর সক্ষমতা ঘাটতিতে চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস সরবরাহ করা যায়নি। এমনি সক্ষমতা শতভাগ গ্যাস সরবরাহ করা যায়নি বছরের বেশি সময়। কারণ দু'টি টার্মিনালের প্রতিটি তিন মাস করে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বন্ধ ছিল। এছাড়াও বিভিন্ন সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগেও বাধা গ্রস্থ হয়েছে গ্যাসের সরবরাহ।
এদিকে নতুন অর্থবছরে দিনে ৩,৯৬৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা ধরা হলেও জাতীয় গ্রীডে সরবরাহ রয়েছে ২,৩০০ থেকে ২,৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট। যার মধ্যে নিজস্ব গ্যাস ১৮শ' মিলিয়ন ঘনফুট ও আমদানিকৃত এলএনজির সরবরাহ সর্বোচ্চ ৫০০ মিলিয়ন ঘুনফুট। এদিকে বিদ্যমান এলএনজি টার্মিনাল দু'টির রিগ্যাসিফিকেশনের সক্ষমতা ৬শ' মিলয়ন ঘনফুট। ফলে আমাদনি বাড়িয়েও গ্যাসের সরবরাহ বৃদ্ধি আপাতত সুযোগ নেই।
তবে দেশের বিদ্যামান গ্যাসের সংকট বিবেচনায় এলএনজি টার্মিনাল বৃদ্ধি ও পাইপলাইনের পরিবহণ সক্ষমতা বাড়নোর জন্য বেশ কয়েকটি প্রকল্প চলমান রয়েছে। যার মধ্যে মহেশখালীতে তৃতীয় ভাসমান টার্মিনাল ও পটুয়াখালীতে চতুর্থ ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে। এছাড়াও মাতারবাড়িতে ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট সক্ষমতার ল্যান্ড বেইজড টার্মিনাল নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। কিন্তু এসব প্রকল্পের সুবিধা পেতে অন্তত দুই বছর অপেক্ষা করতে হবে। ফলে আমদানি করেও আপাতত সংকটের সমাধান পাচ্ছে না জ্বালানি বিভাগ।
অন্যদিকে বাজেটে বরাদ্দ কম থাকায় দেশি-বিদেশি সংস্থাগুলোর গ্যাস উত্তোলন ও অনুসন্ধান কার্যক্রম নিয়ে শঙ্কা রয়েছে বিশ্লেষকদের।
জ্বালানি বিশ্লেষক ড. এম তামিম বলেন, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ খাতে মাত্র ১ হাজার ৮৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু জ্বালানি বিভাগ ও পেট্রোবাংলার পরিকল্পনা দেখেছি তারা ২০২৬ সালের মধ্যে ৪৮টি কূপ খনন করবে। বাপেক্স একা কোনোভাবেই ৪৮টি কূপ খনন করতে পারবে না। তাই বিদেশি কোম্পানির সহায়তায় তা করতে হবে। বাপেক্স বছরে দু'টি থেকে তিনটি কূপ খনন করতে পারবে। আর কূপ খননের ধরনও ভিন্ন। কিছু কিছু কূপ আছে অনুসন্ধান কূপ, সেগুলো তুলনামূলকভাবে বেশি ব্যয়সাপেক্ষ। যেমন, কিছুদিন আগে বাপেক্স কৈলাসটিলা কূপ বের করেছে। বাপেক্স বলেছে, এখান থেকে ২০ মিলিয়ন ঘনফুট অতিরিক্ত গ্যাস পাওয়া যাবে। উৎপাদনশীল কূপের ব্যয়ও কম এবং সময়ও কম লাগে। এখন ১ হাজার ৮৭ কোটি টাকা কি পাইপলাইনের জন্য বরাদ্দ করা হলো? কারণ অনেক পাইপলাইন প্রতিস্থাপন করা দরকার। তিতাসের একটি বড় পরিকল্পনা রয়েছে, ঢাকা শহরের বিতরণ লাইন পরিবর্তন ও কমপ্রেসার স্টেশন বানানো। আসলে এ বরাদ্দগুলো অনুসন্ধান ও উৎপাদন বাড়ানোর জন্য হচ্ছে কিনা তা বিস্তারিত না দেখলে বলা মুশকিল।
অন্যদিকে ৪৮টি কূপ খননে কমপক্ষে ৩ থেকে ৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হবে। যদিও ২০২৫ ও ২০২৬ সালের বাজেট রয়েছে। বাজেট তো বছরভিত্তিক দেওয়া হয় এবং সেই বছরের কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী দেয়া হয়ে থাকে। তবে আমি মনে করি, জরুরি ভিত্তিতে উৎপাদন বাড়ানোর প্রচেষ্টা নেওয়া দরকার ছিল। সেটা নির্ভর করে পেট্রোবাংলার নিজস্ব চিন্তাভাবনা ও পরিকল্পনার ওপর। তবে মোটাদাগে আমার কাছে মনে হয়েছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ খাতে অনুসন্ধানের জন্য যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে তা অপ্রতুল। এক্ষেত্রে আমাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজ হচ্ছে না।