'পশুবাহী ট্রাক থেকে চাঁদা নেওয়া হলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে'- মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রীর এ হুঁশিয়ারির পর গরুর খামারি ও গৃহস্থরা আশায় বুক বাঁধলেও তাদের সে প্রত্যাশা ভেঙে পড়তে সময় লাগেনি। বিভাগীয় শহরগুলোতে কোরবানির পশু আনা নেওয়া শুরুর পর তারা বুঝতে পেরেছে- 'চোর না শোনে ধর্মের কাহিনী।' ট্রাকচালক ও বেপারীরা বলছেন, আগের মতো প্রতিটি রুটে গবাদি পশুবাহী ট্রাক থামিয়ে টাকা নেওয়া না হলেও বিপুল সংখ্যক স্পটে থেমে নেই চাঁদাবাজি।
বিশেষ করে সীমান্ত এলাকা থেকে আসা পশুবাহী ট্রাকগুলো পথে-ঘাটে ব্যাপক চাঁদাবাজির শিকার হচ্ছে। বিভিন্ন রুটে ১০ থেকে ১৫টি পয়েন্টে চাঁদাবাজ চক্র গরুপ্রতি দেড় থেকে দুই হাজার টাকা চাঁদা আদায় করছে। তাদের দাবিকৃত চাঁদা দেওয়া না হলে এসব গবাদিপশু ভারত কিংবা মিয়ানমার থেকে পাচার করা- এমন অভিযোগ তুলে হয়রানি করা হচ্ছে।
গরু ব্যবসায়ীরা জানান, পশুবাহী প্রতিটি ট্রাক কক্সবাজার থেকে ঢাকায় যেতে অন্তত ৮টি পয়েন্টে ১২ থেকে ১৬ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হচ্ছে। মিয়ানমার থেকে এসব গরু পাচার করে আনা হয়েছে- এমন অভিযোগ তুলে মামলার ভয় দেখিয়ে চাঁদা আদায় করা হয় বলে বেপারীরা অভিযোগ করেছেন।
পোশাক পরিহিত হাইওয়ে পুলিশ চাঁদা না তুললেও তাদের সোর্স পরিচয় দিয়ে নিয়মিত চাঁদা তোলা হচ্ছে জানিয়ে চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার বেপারী আবদুল মতিন বলেন, বিষয়টি ওপেন সিক্রেট হলেও হাইওয়ে পুলিশ এ নিয়ে কিছু বলছে না। এতে চাঁদাবাজির সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
ঢাকার শাহজাহানপুর হাটে এক ট্রাক গরু নিয়ে আসা এক ব্যবসায়ী জানান, শুধু কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্তই নয়, চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা পর্যন্ত আসতেও ১২টি পয়েন্টে চাঁদা দিতে হয়েছে। প্রতিটি পয়েন্টে ট্রাকপ্রতি ১ থেকে দেড় হাজার টাকা চাঁদা দিয়ে তাকে ঢাকায় গরু আনতে হয়েছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।
একই হাটে চট্টগ্রাম থেকে দুই ট্রাক গরু নিয়ে আসা কালু বেপারীও একই অভিযোগ করেন। তার ভাষ্য, চাঁদা আদায় নিয়ে তেমন কোনো লুকোচুরি নেই। অথচ প্রশাসনের কাছে এর খবর নেই। এটি একেবারেই খোঁড়া যুক্তি।
এদিকে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কোরবানির পশু ঢাকায় আনার সময় অন্তত ১৬টি পয়েন্টে চাঁদা দিতে হচ্ছে।
খুলনা, নেত্রকোনা, রংপুরসহ অন্যান্য জেলা থেকে গরু বোঝাই ট্রাক চট্টগ্রামে আসার পথে ডজনখানেক স্পটে পুলিশ চাঁদা নিচ্ছে বলেও গরু ব্যবসায়ী ও ট্রাক চালকদের কাছ থেকে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এছাড়া ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী, পরিবহণ শ্রমিক ও স্থানীয় সন্ত্রাসীরাও সংঘবদ্ধভাবে পশুবাহী ট্রাক থেকে চাঁদা আদায় করছে বলে বেপারীরা দাবি করেছেন। তাদের ভাষ্য, যে কোনো এলাকা থেকে গরু ঢাকা-চট্টগ্রাম কিংবা অন্য কোনো বিভাগীয় শহরে আনা-নেওয়ার পথে গরুপ্রতি ৩ থেকে ৫ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়। যা তারা ব্যবসায়িক খরচ হিসেবে ধরেই নিয়েছে। চাঁদার এ টাকা গরুর দামের সঙ্গে যোগ করে বেপারীরা গরু বিক্রি করায় উচ্চমূল্যের এ বাজারে ক্রেতাদের ঘাড়ে তা বড় বোঝা হয়ে দাঁড়াবে বলে মনে করেন তারা।
যশোরের মণিরামপুরের গরুর বেপারী জাহেদ মিয়া জানান, যশোরের বৃহৎ পশুর হাট সাতমাইলসহ বিভিন্ন হাট থেকে ঢাকার বিভিন্ন হাট পর্যন্ত কোরবানির পশু পৌঁছাতে অন্তত ১৭টি স্পটে চাঁদা দিতে হচ্ছে। এর মধ্যে যশোরের বাগআঁচড়া, নাভারণ, ঝিকরগাছা, চাঁচড়া, খাজুরা, মাগুরা, মধুখালী, রাজবাড়ী, ফরিদপুর, গোয়ালন্দঘাট, মানিকগঞ্জ ও সাভারের স্পটগুলোতে ট্রাকপ্রতি নূ্যনতম দেড় হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়। অন্য স্পটগুলোতে নূ্যনতম ৫শ' টাকা চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। তবে কোনো ট্রাকে ভারতীয় গরু রয়েছে এমন সন্দেহ হলে এ চাঁদার পরিমাণ কয়েকগুণ বেড়ে যায়। এ ক্ষেত্রে মামলার ভয় দেখিয়ে বড় স্পটগুলোতে ৩ থেকে ৪ হাজার এবং ছোট স্পটগুলোতে ২ থেকে ৩ হাজার টাকা চাঁদা আদায় করা হয় বলে অভিযোগ করেন ওই গরু বেপারী।
যশোরের চাঁচড়া এলাকা থেকে তিন ট্রাক গরু নিয়ে মেরাদিয়া হাটে আসা গরু ব্যবসায়ী আব্দুল মতিন জানান, বিভিন্ন পয়েন্টে ট্রাকপ্রতি মোট ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়েছে। তার একটি ট্রাক বিশাল আকৃতির একটি সাদা গরুকে ভারতীয় সিন্ধি গরু বলে দাবি করে কয়েকটি স্পটে মামলার ভয় দেখিয়ে অতিরিক্ত ২ থেকে ৩ হাজার টাকা চাঁদা নেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।
যদিও একই হাটে এক ট্রাক গরু নিয়ে আসা ঝিনাইদহের বেপারী মোতালিব হোসেনের দাবি, তিনি মাত্র ৪টি পয়েন্টে ২ হাজার টাকা করে মোট ৮ হাজার টাকা চাঁদা দিয়েছেন। তবে এর বাইরে শ্রমিক সংগঠনের কথা বলে দুই স্পটে এক হাজার টাকা চাঁদা নেওয়া হয়েছে। মোতালিবের ভাষ্য, আগের মতো প্রকাশ্যে চাঁদাবাজি নেই। পথে-ঘাটে পশুবাহী ট্রাক আটকানোও হচ্ছে না। তবে বিভিন্ন স্পট থেকে পুলিশের সোর্স ও সন্ত্রাসীরা ট্রাকে উঠে এ চাঁদা আদায় করছে। চাঁদা দিতে অস্বীকার করলে ইটপাটকেল মেরে ট্রাকের গস্নাস ভেঙে দেওয়াসহ নানা ধরনের ক্ষতি করার হুমকি দেওয়া হচ্ছে বলেও জানান বেপারী মোতালিব।
মেহেরপুর থেকে রাজধানীর কমলাপুর হাট দুই ট্রাকে ৩০টি গরু নিয়ে আসা সোলাইমান বেপারী জানান, চাঁদা দিতে অস্বীকার করায় তাদের একটি ট্রাকের চাকা পাংচার করে দেওয়া হয়। ঘটনাস্থলের কাছে হাইওয়ে পুলিশ টহলরত থাকলেও তারা বিষয়টি দেখেও না দেখার ভান করেছে।
এদিকে মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের নামে টোকেন দিয়ে চাঁদা আদায়েরও প্রমাণ পাওয়া গেছে। সাতক্ষীরা থেকে যাত্রাবাড়ী হাটে গরু নিয়ে আসা খামারি সোহানুর রহমান জানান, ফরিদপুর মোটর শ্রমিক ইউনিয়নসহ বেশ কয়েকটি শ্রমিক সংগঠন রিসিট দিয়ে তার কাছ থেকে মোট ১১শ' টাকা চাঁদা নিয়েছে। এই খামারি এ ধরনের দুটি রিসিটও এ প্রতিবেদককে দেখান। তবে এ রিসিটের ফটোকপি কিংবা মোবাইল দিয়ে ছবি তুলতে দিতেও তিনি রাজি হননি।
ওই খামারির ভাষ্য, এ রুটে তাকে আরও গরু আনতে হবে। রিসিটে যেহেতু ট্রাকের নাম্বার লেখা রয়েছে, তাই পরে তাকে চিহ্নিত করে হয়রানি করতে পারে।
গরুর বেপারি, খামারি ও গৃহস্থদের ভাষ্য, ফেরিঘাট, হাইওয়ে, স্থানীয় সড়ক ও বিভিন্ন হাটে ঢোকার মুখে তাদের যে টাকা চাঁদা দিতে হয়, তা দেওয়া না লাগলে প্রতিটি ছোট গরু ৫ থেকে ৭ হাজার টাকা, মাঝারি গরু ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা এবং বড় গরু ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা কমে বিক্রি করতে পারতেন। এতে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়েই লাভবান হতো।
শহিদুল আলম নামের একজন খামারি এ প্রসঙ্গে বলেন, গো-খাদ্যের উচ্চমূল্য ও প্রতিপালন খরচ বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে এমনিতেই এবার চড়া দরে গরু-ছাগল-মহিষ বিক্রি করতে হবে। এর উপর চাঁদার টাকা যুক্ত হওয়ায় তা ক্রেতার উপর বাড়তি চাপ পড়বে। যার নেতিবাচক প্রভাব কোরবানির পশু বিক্রিতে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
নড়াইল থেকে গরু নিয়ে রাজধানীর ভাটারা হাটে আসা মন্টু মিয়া জানান, জেলার তুলারামপুর, হাওয়াইখালী, লক্ষ্ণীপাশার মোলস্নারমাঠসহ কয়েকটি স্পটে চাঁদা আদায়ের বিষয়টি ওপেন সিক্রেট। বিষয়টি অনেকে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের গোপনে অবহিত করেছেন। কিন্তু এতে কোনো লাভ হয়নি। বরং এ নিয়ে বেশ কয়েকজনকে হয়রানির শিকার হতে হয়েছে।
এদিকে দৌলতদিয়া ফেরিঘাটে কোরবানির পশুবাহী গাড়ি থেকে চাঁদা আদায়ের অভিযোগ পাওয়া গেছে। গরু ব্যবসায়ীরা জানান, গবাদি পশুবাহী ট্রাকে থাকা রাখালসহ অন্যদের কাছ থেকে ভাড়া না নেওয়ার নিয়ম থাকলেও তাদের কাছ থেকে টাকা নেওয়া হচ্ছে। এছাড়া ফেরি কাউন্টার থেকে পশুবাহী ট্রাকের অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে। যদিও ফেরি কর্তৃপক্ষ তা স্বীকার করেনি।
দৌলতদিয়া ঘাট বিআইডবিস্নউটিসির ম্যানেজার সালাউদ্দিন গণমাধ্যমকে জানান, গরুর ট্রাকে থাকা রাখালসহ অন্যদের ভাড়া নেওয়ার নিয়ম নেই। পশুবাহী ট্রাক থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করাও অবৈধ। এ ধরনের কোনো অভিযোগ পাওয়া গেলে তা তদন্ত সাপেক্ষে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের কোনো ধরনের ছাড় দেওয়া হবে না।