এমপি আনার হত্যাকান্ড

আ'লীগ নেতা মিন্টু আটক নজরদারিতে কয়েকজন

নেপথ্যে রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব

প্রকাশ | ১২ জুন ২০২৪, ০০:০০

গাফফার খান চৌধুরী
সাইদুল করিম মিন্টু
রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের জেরেই হত্যাকান্ডের শিকার হতে পারেন ঝিনাইদহ-৪ আসনের আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার। তবে সব বিষয় পরিষ্কার হবে হত্যাকান্ডের মাস্টারমাইন্ড হিসেবে আলোচনায় আসা আনারের ঘনিষ্ঠ বাল্যবন্ধু পলাতক আখতারুজ্জামান শাহীনকে হেফাজতে পাওয়ার পর। নানা হিসাব-নিকাশ ও যৌক্তিক কারণে আনার হত্যাকান্ডের নেপথ্যে রাজনীতির চেয়ে ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বই তদন্তে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। এদিকে আনার হত্যার ঘটনায় ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টুকে আটক করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগ। মঙ্গলবার বিকালে রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকা থেকে তাকে আটক করা হয়। এছাড়া তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, হত্যাকান্ডের ঘটনায় ঝিনাইদহের বেশ কিছু রাজনৈতিক নেতা গোয়েন্দা নজরদারিতে রয়েছেন বলেও তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন শীর্ষ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের সূত্র ধরেও আনার হত্যার ঘটনা ঘটতে পারে। বিষয়টি বিচিত্র না। এক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও নিজ দলের প্রতিপক্ষও জড়িত থাকতে পারে। এমন সুযোগের সৎ ব্যবহার করতে পারে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষও। তবে তদন্তে এসব কারণে আনার হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটার তেমন কোনো সুস্পষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি। হত্যাকান্ডের মাস্টারমাইন্ড হিসেবে আলোচনায় এসেছে আখতারুজ্জামান শাহীনের নাম। সূত্রটি জানিয়েছে, বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক পলাতক শাহীন নিহত আনারের ঘনিষ্ঠ বাল্যবন্ধু। নিহত আনারের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসেবে শাহীনের কোনো সংশ্লিষ্টতার তথ্য পাওয়া যায়নি। শাহীন ব্যক্তিগতভাবে প্রচুর অর্থবিত্তের মালিক। অর্থবিত্তের জন্য শাহীন আনারকে হত্যা করায়নি, সেটি মোটামুটি নিশ্চিত। তাহলে কেন, কী কারণে শাহীন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করে এমপি আনারকে হত্যা করল- সেটি জানার বিষয়। শাহীনের জড়িত থাকার পেছনে ব্যক্তিগত কোনো দ্বন্দ্ব থাকতে পারে। অথবা অতীতে আনারের সঙ্গে শাহীনের এমন কোনো কর্মকান্ড ঘটেছে, সেই জেদ থেকেই অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে শাহীন আনারকে হত্যা করিয়েছে। সূত্রটি বলছে, হত্যায় ব্যয় হওয়া ৫ কোটি টাকার যে প্রসঙ্গ এসেছে, সেই টাকাও শাহীনই দিয়েছে বলে এখন পর্যন্ত জানা গেছে। একজন সিটিং ক্ষমতাসীন দলের এমপিকে বিদেশে হত্যা করলে তার পরিণতি কী হবে, সেটিও নিশ্চয়ই শাহীন জানে। জেনেশুনে-বুঝে এমন একটি হত্যাকান্ডের সঙ্গে কেন শাহীন জড়িয়ে পড়ল, সেটিই এখন জানার বিষয়। সূত্রটি বলছে, আনার হত্যার প্রকৃত রহস্য পুরোপুরি পরিষ্কার হবে শাহীনকে হেফাজতে পাওয়ার পর। যতক্ষণ পর্যন্ত শাহীনকে হেফাজতে পাওয়া না যাবে, ততক্ষণ পর্যন্ত আনার হত্যাকান্ডের আসল তথ্য পাওয়া বা উদঘাটন করা বেশ কঠিন ও কষ্টসাধ্য ব্যাপার হতে পারে। আশা করা হচ্ছে, আনার হত্যার মাস্টারমাইন্ড শাহীনকে পাওয়া যাবে। তাকে পেলেই হত্যার প্রকৃত রহস্য উদঘাটিত হবে। দুই দেশের মধ্যে আনার হত্যার তদন্তের তথ্য নিয়মিত আদান-প্রদান হচ্ছে। তবে আনার হত্যার রহস্য উদঘাটন সময়সাপেক্ষ হতে পারে। এদিকে সোমবার আনার হত্যার ঘটনায় তদন্তকারী কর্মকর্তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম মাহবুবুল হক ৭ দিনের রিমান্ডে থাকা ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক কাজী কামাল আহমেদ ওরফে গ্যাস বাবু হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেওয়া চরমপন্থি নেতা আমানুলস্নাহ সাঈদ ওরফে শিমুল ভুঁইয়া, তার ভাতিজা তানভীর ভুঁইয়া ও শিলাস্তি রহমানের জব্দ হওয়া মোবাইল ফোনের ফরেনসিক পরীক্ষার অনুমতি দেন। আদালতে তদন্তকারী সংস্থা ডিবির আবেদনে বলা হয়েছে, এমপি আনার হত্যার পর শিমুল ভুঁইয়া, গ্যাস বাবু, তানভীর ভুঁইয়া ও শিলাস্তি রহমানের মধ্যে হোয়াটসঅ্যাপে বিভিন্ন রকম তথ্য আদান-প্রদান করেছেন। এছাড়া আসামিদের মোবাইলে থাকা ছবি, ভিডিওসহ অপহরণ ও খুনসংক্রান্ত কোনো তথ্য মুছে ফেলা হয়েছে কি না, সেটি জানা প্রয়োজন। অন্যদিকে শাহীনের গুলশানের ভাড়া বাসা থেকে ২টি গাড়ি জব্দ হয়েছে। যার একটি সাদা রঙের প্রাডো জিপ। অপরটি মাইক্রোবাস। এদিকে সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার হত্যার ঘটনায় ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টুকে আটক করেছে ডিবি। মঙ্গলবার বিকালে রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকা থেকে তাকে আটক করা হয়। ডিবি সূত্র জানায়, আক্তারুজ্জামান শাহীনের সঙ্গে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের যোগাযোগ ছিল। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়েছে। এ বিষয়ে ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. শফিকুল ইসলাম অপু জানান, প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে জেলা আওয়ামী লীগের একটি অনুষ্ঠান ছিল মঙ্গলবার। সেই অনুষ্ঠানে মিন্টুর উপস্থিত থাকার কথা ছিল, কিন্তু তিনি অনুষ্ঠানে আসেননি। তাকে আটকের বিষয়টি বিভিন্ন মাধ্যমে শুনেছি, তবে আমি এখনো নিশ্চিত না। এদিকে মঙ্গলবার বিকালে ঢাকার মিন্টো রোডে নিজ কার্যালয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, এমপি আনারকে হত্যার পর আসামিরা কার কার কাছে নানা তথ্য, ছবি, ভিডিও শেয়ার করেছেন সেটি জানার চেষ্টা চলছে। ছবি দিয়ে কেউ আর্থিক বা অন্য কোনোভাবে লাভবান হয়েছে কি না বা কাদের মাধ্যমে লাভবান হয়েছেন, সেসব বিষয়ে তদন্ত চলছে। তারই ধারাবাহিকতায় ঝিনাইদহ আওয়ামী লীগের বেশ কিছু নেতাকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে। একজনকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। বাংলাদেশ ও ভারত মিলে পারস্পারিক যোগাযোগ এবং তথ্য আদান-প্রদানের মাধ্যমে মামলার তদন্ত চলছে। দুই দেশেরই উদ্দেশ্য আনার হত্যার প্রকৃত রহস্য উদঘাটন করা। দুই দেশই সে লক্ষ্যে কাজ করছে। মঙ্গলবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ অডিটরিয়ামে হাইওয়ে পুলিশের ১৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, আনার চোরাচালানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। ঝিনাইদহ সন্ত্রাসপূর্ণ এলাকা। ওখানে সত্যিকারে কী হয়েছে, সেটা জানার চেষ্টা চলছে। তদন্তের ধারাবাহিকতায় আরও অনেকেই গ্রেপ্তার হতে পারে। তবে তারা কারা বা কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত কি না তা তদন্তের স্বার্থে এ মুহূর্তে প্রকাশ করা যাচ্ছে না।