ইজারার চুক্তি ভঙ্গ, যানজটে ভোগান্তি
আগেভাগেই রাজধানীতে হাট
প্রকাশ | ১২ জুন ২০২৪, ০০:০০
সাখাওয়াত হোসেন
ইজারা চুক্তি অনুযায়ী ঈদুল আজহার আগের চার দিন ও ঈদের দিন ঢাকা উত্তর-দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এলাকার ১৯টি অস্থায়ী হাটে কোরবানির পশু বিক্রি করা যাবে। এ হিসেবে বৃহস্পতিবার থেকে অস্থায়ী হাটগুলোতে গরু-ছাগল-মহিষ বেচাকেনা করার কথা। অথচ নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা না করে অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে শুক্রবার থেকেই হাটগুলোতে পশু উঠাতে শুরু করেছেন ইজারাদাররা। হাটের নির্ধারিত সীমানার বাইরেও আশপাশের জায়গা দখল করে গরু-ছাগল বেঁধে রাখা হচ্ছে। এতে রাজধানীর অস্থায়ী হাটকেন্দ্রিক প্রতিটি সড়কে সৃষ্টি হয়েছে তীব্র যানজট; বেড়েছে নানা ধরনের ভোগান্তি।
দুই সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তারা বলছেন, ইজারার শর্ত অনুযায়ী আগে থেকে হাটের প্রস্তুতি চলতে পারে। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের আগে হাট বসানোর সুযোগ নেই। তাদের দাবি, ১২ আগস্টের আগে পশুবাহী কোনো ট্রাক রাজধানীতে প্রবেশ করতে না দেওয়ার নিষেধাজ্ঞাও রয়েছে। চুক্তি ভেঙে কেউ নির্ধারিত সময়ের আগে হাটে গবাদি পশু উঠালে সংশ্লিষ্ট ইজারাদারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এমনকি ইজারা বাতিল করার ক্ষমতাও কর্তৃপক্ষের রয়েছে। তবে ঢাকার হাটে আগেভাগে পশু আসার কোনো অভিযোগও পাননি বলে দাবি করেন তারা।
যদিও ভুক্তভোগী নগরবাসীর পাশাপাশি ঢাকা মহানগর ট্রাফিক পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অনেকেই এ নিয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ
করেছেন। তাদের ভাষ্য, নির্ধারিত সময়ের আগে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের হাটগুলোতে কোরবানির পশু তোলা হচ্ছে কিনা তা দেখভাল করার দায়িত্ব যাদের, তারা ইজারাদারদের কাছ থেকে অবৈধ আর্থিক সুবিধা নিয়ে চোখ বুজে রয়েছেন। এ নিয়ে থানা পুলিশের কাছে অভিযোগ করেও কোনো লাভ হচ্ছে না। রোববার থেকে ঢাকার যানজট সামলাতে ট্রাফিক পুলিশ প্রাণান্ত চেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ হচ্ছে। যানজটসহ নানা ভোগান্তিতে নগরবাসী অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে।
সরেজমিন বিভিন্ন পশুর হাট ঘুরে দেখা গেছে, পবিত্র ঈদুল আজহা সামনে রেখে রাজধানীর বেশিরভাগ অস্থায়ী পশুর হাট পুরোপুরি প্রস্তুত। হাটগুলোর প্রবেশমুখে সুদৃশ্য তোরণ নির্মাণের পাশাপাশি বাঁশের খুঁটি ও তার দিয়ে ঘের তৈরি করা হয়েছে পশু রাখার জন্য। বেপারীদের থাকা ও নিরাপত্তার ব্যবস্থাসহ আনুষঙ্গিক সুবিধার ব্যবস্থাও করা হয়েছে। নিয়মানুযায়ী হাট বসানোর নির্ধারিত সময় হতে কয়েকদিন বাকি থাকলেও তর সয়নি ইজারাদারদের। দুই সিটি কর্পোরেশন এলাকার প্রায় সবকটিতেই বিক্রির জন্য পশু উঠানো হয়েছে। যদিও কোনো হাটেই এখনো বেচা-কেনা জমে উঠেনি।
এদিকে আগেভাগেই হাট বসানো নিয়ে ইজারাদাররা নানা খোঁড়া যুক্তি দেখাচ্ছেন। তাদের ভাষ্য, আগাম হাট না বসালে দূরদূরান্ত থেকে আসা পশুর বেপারীরা বিপাকে পড়বেন। একসঙ্গে বিভিন্ন জেলা থেকে পশু আসা শুরু করলে ঢাকা শহর অচল হয়ে যাবে। পশুগুলো সুশৃঙ্খলভাবে রাখাও মুশকিল হবে। মহাসড়কে যানজট হবে তীব্র। তাই সিটি করপোরেশ কর্তৃপক্ষ ও পুলিশ এ ব্যাপারে তাদের কিছুটা ছাড় দিচ্ছে।
তবে ইজারাদারদের এ বক্তব্য সঠিক নয় বলে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জোরালো দাবি করেছেন। এ ব্যাপারে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের সম্পত্তি বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, নিয়মানুযায়ী ঈদের চার দিন আগে হাটে বেচাকেনা শুরু করা যাবে। তবে নির্ধারিত এ সময়ের আগেই হাটে পশু উঠানোর খবর পাওয়া যাচ্ছে। তবে লোকবলের স্বল্পতার কারণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। গুরুতর কোনো অসঙ্গতি দেখা গেলে সেখানে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে বলে দাবি করেন ওই কর্মকর্তা।
মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৮টায় রাজধানীর রামপুরা ব্রিজে ঘণ্টাখানেক দাঁড়িয়ে থেকে দেখা গেছে, একের পর এক পশুবাহী ট্রাক মেরাদিয়া হাটের দিকে ঢুকছে। আবার কিছু ট্রাক কমলাপুর হাট কিংবা খিলগাঁও রেলগেট মৈত্রী সংঘ ক্লাবসংলগ্ন হাটে যাচ্ছে। এছাড়া মালিবাগের দিক থেকে আসা বেশকিছু ট্রাক যাচ্ছে ভাটারার সুতিভোলা খালের পাশের জায়গা ও খিলক্ষেতের ৪৩ নম্বর ওয়ার্ডের পশ্চিমপাড়ার খালি জায়গাসহ উত্তর সিটি করপোরেশনের অন্যান্য হাটে।
সকাল ১০টার দিকে রাজধানীর ধোলাইখাল ট্রাক টার্মিনাল, পোস্তগোলা শ্মশানঘাট ও দনিয়া কলেজ সংলগ্ন কোরবানির পশুর হাট ঘুরে দেখা যায়, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ট্রাকভর্তি গরু আসছে এসব হাটে। ব্যবসায়ীরা সেসব গরু ট্রাক থেকে নামিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে নিয়ে যাচ্ছেন। পোস্তাগোলায় নৌপথেও গরু আনা হচ্ছে।
বেপারীরা জানান, ১০ তারিখ থেকে হাটে গরু আনা যাবে বলে ইজারাদারদের লোকজন তাদের খবর দিয়েছেন। তাই ৯ তারিখ রাত থেকেই তারা গরু নিয়ে ঢাকার হাটের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছেন। এর পর থেকে গরু আনা আর থেমে নেই। ঢাকায় ঢোকার পথে ট্রাফিক ও থানা পুলিশ বাধা দিলেও 'বখশিশ' মিললেই তারা ট্রাক ছেড়ে দিচ্ছে।
তবে পুরান ঢাকার ধোলাইখাল ট্রাক টার্মিনাল সংলগ্ন পশুর হাটের ইজারাদার আশফাক আজিমের দাবি, তারা কোনো বেপারীকে ১০ তারিখ গরু আনার কথা বলেননি। কেননা এ পশুর হাটটি সড়কের ওপর এবং আশপাশের জায়গাজুড়ে, এজন্য চাইলেই সেখানে আগেভাগে গরু-ছাগল তোলার কোনো সুযোগ নেই। তবে কিছু বেপারী আগেভাগে গরু নিয়ে এসেছেন। তাদের ভিন্ন জায়গায় গরু রাখার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে।
রাজধানীর মেরাদিয়া হাটের ইজারাদারের লোকজন জানান, বেপারীরা ভালো জায়গা দখল করতে নির্ধারিত সময়ের আগেই হাটে চলে এসেছে পশু নিয়ে। এছাড়া কোরবানির জন্য চার-পাঁচদিন একেবারেই কম। আর বেপারীরা জানান, তাদের আসতে বলার পর তারা হাটে এসেছে। আগে আসলে মূল হাটে জায়গা পাওয়া যায়। এতে বেচা-বিক্রি ভালো হয়।
আগেভাগে গবাদি পশু নিয়ে হাটে আসার কারণ সম্পর্কে কুষ্টিয়ার বেপারী রমজান আলী জানান, ঈদের ৪ দিন আগে হাটে গরু তোলার নিয়ম তিনি জানেন। কিন্তু এ সময় ট্রাক ভাড়া বেশি দিতে হয়। এছাড়া হাটে ভালো জায়গা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। দীর্ঘ পথ ট্রাকে আসার কারণে গরুগুলো ক্লান্ত থাকে। এছাড়া আগেভাগে হাটে থাকলে দরদাম সম্পর্কেও কিছুটা বাড়তি খোঁজ-খবর নেওয়া যায়।
নওগাঁর বেপারী ওমর খালেদ বলেন, এবার একটু আগেই চলে এসেছি। কারণ কয়েক দিন পর ঘরমুখো মানুষের ঢল নামলে রাস্তায় যানজট শুরু হবে। এ যানজটের কারণে গরু দীর্ঘক্ষণ গাড়িতে থাকতে হয়। এতে গরু অসুস্থ হওয়াসহ নানান সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। এছাড়া প্রথম দিকে ক্রেতা ভালো পাওয়া যায়। দাম যা চাওয়া যায় তাই মিলে।
রাজধানীর শনির আখড়ায় (দনিয়া কলেজ মাঠ) ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ঘেঁষে বসানো হাটে আগেভাগেই গবাদি পশু তোলায় ওই সড়কে বাড়তি চাপ সৃষ্টি হয়েছে। পাশাপাশি দেখা দিয়েছে সড়ক দুর্ঘটনার আশঙ্কাও।
এদিকে নির্ধারিত সময়ের আগেই হাটে গরু উঠার কথা স্বীকার করেছেন ইজারাদার মো. কামরুজ্জামান। তিনি বলেন, হাটে গরু ওঠানোর নিয়ম পাঁচ দিন আগে। এর আগেই বেপারীরা গরু নিয়ে আসা শুরু করেছেন। তবে সড়কের ওপরে গরু যাতে যেতে না পারে, সেভাবেই বাঁশ দিয়ে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
তবে ঢাকা দক্ষিণ সিটির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা কাইজার মোহাম্মদ ফারাবী জানান, 'আমাদের কার্যাদেশ এখনো দেওয়া হয়নি। কোথায় পশু বসবে, এখনো জায়গা বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি।'
অন্যদিকে আগেভাগে কোরবানির পশুবাহী ট্রাক ঢাকায় ঢুকতে শুরু করায় যানজট সামাল দিতে নাভিশ্বাস উঠছে বলে জানান বাড্ডা সড়কে দায়িত্বরত একজন ট্রাফিক কনস্টেবল। তার ভাষ্য, গত তিন দিন ধরে রাতদিন পশুবাহী ট্রাক আসছে। এতে হাটকেন্দ্রিক সড়কগুলোতে যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। যার প্রভাব আশপাশের রাস্তাগুলোতেও পড়ছে।
হাট সংলগ্ন এলাকার স্থানীয়রা বলছেন, দীর্ঘ সময় ধরে হাটের প্রস্তুতি নেওয়া ও নির্ধারিত সময়ের আগেই হাটে পশু চলে আসায় যানজট সৃষ্টিসহ নানা ভোগান্তি হচ্ছে। ইজারাদাররা সবাই প্রভাবশালী ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী হওয়ায় এ নিয়ে কেউ কোনো কথা বলতে পারেন না। থানা পুলিশ ও সিটি করপোরেশনে এ ব্যাপারে অভিযোগ দিয়ে বরাবরই কোনো ফল পাওয়া যায় না বলে অভিযোগ করেন তারা।
তবে ইজারাদারদের দাবি, বর্ষা মৌসুমে হাট বসানোর কারণে একটু বাড়তি প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে। এছাড়া আগে হাট প্রস্তুত না করলে ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখা যায় না। তবে আগে হাট বসানোর কারণে স্থানীয় বাসিন্দাদের যাতে কোনো দুর্ভোগে পড়তে না হয় সেদিকে তারা খেয়াল রাখছেন।
এদিকে হাটের নির্ধারিত সীমানা ছাড়িয়ে আশপাশের আবাসিক এলাকার বিভিন্ন রাস্তা দখল করে কোরবানির পশু বিক্রির প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে বলেও অভিযোগ তুলেছেন অনেকেই। মেরাদিয়া হাট সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দা হাবিবুর রহমান জানান, গত বছরও তার বাসার সামনের রাস্তা দখল করে গরু-ছাগল বিক্রি করা হয়েছে। অথচ এ রাস্তা হাটের নির্ধারিত সীমানার অনেক বাইরে। এবারও একই ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি।