ঢাকাসহ অন্যান্য মহানগরীতে কোরবানির পশুর হাট এখনো না বসলেও সারাদেশে স্থায়ী হাট, গবাদি পশুর খামার ও গৃহস্থের গোয়াল থেকে গরু-ছাগল-মহিষ কেনাবেচা বেশ আগেই শুরু হয়েছে। তবে গবাদি পশুর চড়া দাম নিয়ে ক্রেতারা হতাশ। আর বিক্রির মন্দায় হতাশ গৃহস্থ, খামারি ও বেপারীরা।
গবাদি পশু বিক্রেতাদের আশঙ্কা, উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে সংসার চালাতে হিমসিম খাওয়া বিপুলসংখ্যক মানুষ এবার কোরবানি দেওয়া থেকে বিরত থাকবে। গরু-মহিষ থেকে সরে এসে কেউ কেউ ছাগল-ভেড়া কিনবেন। অনেকে এককভাবে গরু না কিনে ৫/৭ জনে মিলে শেয়ারে কোরবানি দেবেন। ফলে কোরবানির জন্য দেশে প্রস্তুত বিপুলসংখ্যক পশু অবিক্রীত থাকবে। এর ওপর মিয়ানমার ও ভারত থেকে পাচার হয়ে আসা গবাদি পশু কোরবানির হাটে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করবে।
পশু পালন খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানান, গোখাদ্যের আকাশচুম্বি দাম এবং পশুপালন খরচ কয়েকগুণ বেড়ে যাওয়ায় গত বছর কোরবানির আগে যে গরু ৬০-৬৫ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে এবার ওই একই সাইজের গরু কমপক্ষে ৮০ হাজার টাকায় বিক্রি করতে হবে। ছাগল-ভেড়ার দাম গতবারের চেয়ে নূ্যনতম ২৫ শতাংশ বাড়িয়ে বিক্রি করতে না পারলে তারা লোকশানের মুখে পড়বেন। অথচ পাচার করা গরু-মহিষ বেশখানিকটা কম দামে বিক্রি হচ্ছে। ফলে দেশীয় গবাদি পশু বেচাবিক্রিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ঈদ ঘনিয়ে আসার সঙ্গে পালস্না দিয়ে এ সংকট আরও ভয়াবহ রূপ নেবে- এমন আশঙ্কা তাদের।
এদিকে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন মধ্যবিত্তরা। তাদের ভাষ্য, গো-খাদ্যের দাম বৃদ্ধির কারণ দেখিয়ে বিক্রেতারা গত বছরের চেয়ে এ বছর গরু-ছাগলের দাম ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ বেশি হাঁকছেন। মূল্যস্ফীতির বাজারে যা অনেকটাই যৌক্তিক। কিন্তু এ সময়ে তাদের আয় এক টাকাও বাড়েনি। বরং খাদ্যদ্রব্যসহ সব ধরনের পণ্য ও বিভিন্ন সেবার মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় তাদের সঞ্চয় কমেছে। অনেককে ধার করে সংসার চালাতে হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে চড়া দামে ভাগে গরু-মহিষ কিনে কোরবানি দেওয়াও তাদের পক্ষে দুস্কর হয়ে পড়েছে।
গবাদি পশু ব্যবসায়ীরা জানান, চাহিদার তুলনায় কোরবানির পশুর সরবরাহ বেশি থাকলেও গো-খাদ্যের দাম বৃদ্ধির প্রভাবে উৎপাদন খরচ বেড়েছে ৩০ শতাংশেরও বেশি। ফলে কোরবানির পশু কিনতে ক্রেতাদের ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তি খরচের চাপে পড়তে হবে।
নীল অ্যাগ্রো ফার্মের স্বত্বাধিকারী রিপন তরফদার নিয়াম বলেন, তিন মণ ওজনের একটি গরু গত বছর বিক্রি করেছি ৭০-৮০ হাজার টাকায়। এবার সেটা ১ লাখ টাকায় বিক্রি করলেও লোকশান গুনতে হবে। তবে বাজারে বেশি দামে গরু কতটা বিক্রি হবে তা নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন তিনি। এই খামারির ভাষ্য, খাবারের দামের প্রভাব এবার কোরবানির হাটে পড়বে। মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ যারা গত বছর মাঝারি সাইজের গরু কোরবানি দিয়েছেন তারা এবার সাধ্যের সঙ্গে সমন্বয় করতে গিয়ে ছোট গরু কেনার দিকে ঝুঁকবেন। ফলে কোরবানির পশুর হাটে ছোট গরুর চাহিদা সবচেয়ে বেশি হবে।
রাজশাহী, বগুড়া, পাবনা, কুষ্টিয়া, রংপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রামসহ কয়েকটি জেলার খামারিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মাস তিনেক আগেও প্রতি বস্তা (৪০ কেজি) ভুসির মূল্য ছিল ১৩০০-১৪০০ টাকা। এখন ভুসি কিনতে হচ্ছে ১৮০০-১৯০০ টাকায়। খৈলের প্রতি বস্তার (৪০ কেজি) বাজারদর আগে ছিল ১৫০০-১৬০০ টাকা। এখন খৈলের বস্তার দাম ২০০০-২২০০ টাকা। এছাড়া ধানের কুড়ার দাম দ্বিগুণ হওয়ায় এখন খামারিদের প্রতি বস্তা কিনতে হচ্ছে ৬৫০-৭০০ টাকায়।
বাংলাদেশ ডেইরি ফারমারস অ্যাসোসিয়েশন বলছে, গবাদি পশুর উৎপাদনে প্রায় ৬৬ শতাংশ ব্যয় হয় গো-খাদ্যে। এক বছরের ব্যবধানে গো-খাদ্য ও খাদ্য উপাদানের দাম বেড়েছে গড়ে ৪৬ শতাংশ যা গরু লালনপালনের মোট খরচের ৩০ শতাংশ। সে হিসেবে খামারি ও গৃহস্থরা দামের ক্ষেত্রে যদি এই ৩০ শতাংশ খরচও সমন্বয় করতে পারেন তবে তারা কিছুটা হলেও লাভ করতে পারবেন।
খামারিদের দাবি, প্রাণী খাদ্যের উৎপাদন খরচ এমনভাবে বাড়িয়েছে পশুর দাম না বাড়িয়ে কোনো উপায় নেই। তবে বাড়তি দামে বিক্রি করলেও গত বছরের তুলনায় লাভ কমে যাবে। আবার বাড়তি দামের কারণে বিক্রি কমে যাওয়ারও শঙ্কা রয়েছে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা অনেকেই মনে করেন গবাদি পশুর দাম বাড়লেও কোরবানি কমার শঙ্কা নেই। ধর্মপ্রাণ মুসলমান যারা প্রতি বছর কোরবানি দেন তারা এবারও কিছুটা চড়া দামেই গবাদি পশু কিনবেন। এ প্রস্তুতি সবাই আগেভাগেই নিয়ে রেখেছেন। তবে ভারত ও মিয়ানমার থেকে বিপুলসংখ্যক গরু-মহিষ পাচার হয়ে দেশে ঢুকলে কোরবানির হাটে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এদিকে দেশের বিভিন্ন এলাকার খামারিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মাঝারি ও ছোট গরু বিক্রিতে মন্দা থাকলেও বিশাল আকৃতির গরু বিক্রি অনেকটাই আগের মতো রয়েছে। বিত্তশালীরা বাড়তি দামে কোরবানির পশু কিনতে সেভাবে দ্বিধা করছেন না।
সাতক্ষীরার মুন ডেইরি অ্যান্ড ক্যাটল ফার্মের ম্যানেজার শহিদুল ইসলাম জানান, তাদের খামারের ছোট-বড় ও মাঝারি ৭২টি গরুর মধ্যে ৫ মণ ওজনের ১৩টি গরু এরই মধ্যে বিক্রি করেছেন। মাঝারি ১২টি এবং ছোট ৩১টি গরু বিক্রি করেছেন। গত বছরের তুলনায় ৩০-৩৫ শতাংশ বেশি দামে বিক্রি করলেও লাভের অংকের আগের চেয়ে অর্ধেক কমে গেছে। আগের মতো ছোট গরুতে ১৫-২০ হাজার টাকা এবং মাঝারি গরুতে ৩০-৩৫ হাজার টাকা এবার একেবারেই অসম্ভব বলে মনে করেন তিনি।
কুষ্টিয়ার সায়হাম ডেইরি ফার্মের মালিক নাজমুল আলম বলেন, গত বছর লাভ আশানুরূপ না হলেও খামারের সব গরু বিক্রি করতে পেরেছিলেন। তবে এবার ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশ গরু বিক্রি করতে পারবেন কিনা তা নিয়ে তিনি সন্দিহান। এই খামারির ভাষ্য, গো-খাদ্যের জন্য গবাদি পশুর দাম যতটা বেড়েছে সে হিসেবে সাধারণ মানুষের আয় বাড়েনি। ফলে স্বাভাবিকভাবেই এবারে ক্রেতা সংকট থাকবে।
অন্যদিকে এরই মধ্যে দেশের গ্রামগঞ্জের গৃহস্থের গোয়াল, জেলা শহরের হাট ও খামার থেকে বেপারীরা যে গবাদি পশু কিনেছেন তা গত বছরের চেয়ে বেশ খানিকটা চড়া দরে নিতে হয়েছে বলে তারা জানিয়েছেন। খামারি ও গৃহস্থরা বেশি দামে গরু-ছাগল বিক্রির কথা স্বীকার করেছেন।
মুন্সীগঞ্জের আল-আমিন ডেইরি ফার্মের স্বত্বাধিকারী আলতাফ হোসেন জানান, গত বছর মাঝারি সাইজের যে গরু ৭৫ থেকে ৮০ হাজার টাকায় বিক্রি করেছেন এবার একই ধরনের ৪৩টি গরু প্রতিটি লাখ টাকা কিংবা তার চেয়ে কিছু বেশি টাকায় বেপারীরা কিনে নিয়ে গেছেন। ঈদ ঘনিয়ে আসার সঙ্গে দাম আরও কিছুটা চড়বে বলে মনে করেন তিনি।
এদিকে বেপারী ও খামারিদের অনেকের ধারণা, এ বছর ছোট গরু ও ছাগলের চাহিদা কয়েক গুণ বাড়বে। ফলে এ ধরনের পশু উদ্বৃত্ত তো থাকবেই না বরং সংকট দেখা দেবে। বড় আকারের গরু মোটামুটি বিক্রি হলেও মাঝারি আকারের বেশি গরু অবিক্রীত থাকবে। তাদের ভাষ্য, আগে যারা মাঝারি আকারের পশু কোরবানি দিতেন, আর্থিক সংকট ও গবাদি পশুর দাম বাড়ায় তারা এবার ছোট গরু কিনতে বাধ্য হবেন। আর স্বল্প সামর্থ্যের যেসব মানুষ আগে ছোট গরু কিনতেন, তারা কয়েকজনে বড় গরু কিনে ভাগে কোরবানি দেওয়ার চেষ্টা করবেন। তবে শেষ মুহূর্তে এ ছক পাল্টে যেতে পারে বলেও মনে করেন অনেকে।
বড় খামারিদের অনেকের আশঙ্কা, ছোট খামারিরা আত্মীয়স্বজন ও বিভিন্ন সমিতির কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে কোরবানির জন্য পশু পালন করেন। নির্ধারিত সময়ে তাদের ঋণ পরিশোধ করার চাপ থাকে। তাই তারা কিছুটা লোকশানে হলেও গরু বিক্রি করে দিতে বাধ্য হবেন। এতে শেষ মুহূর্তে বাজার এলোমেলো হয়ে যেতে পারে।
এছাড়া যেভাবে পাচার করা গরু-মহিষ দেশে ঢুকছে তাতেও দেশীয় গরুর খামারিদের বড় ধরনের সর্বনাশ হওয়ার আশঙ্কা করছেন তারা।