অর্থবছর ২০২৪-২০২৫

কঠিন সময়ে চ্যালেঞ্জের বাজেট

প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা উচ্চাবিলাসী বাজেট বাস্তবায়ন চ্যালেঞ্জিং করের বোঝা বাড়বে

প্রকাশ | ০৭ জুন ২০২৪, ০০:০০

এম সাইফুল
সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৃহস্পতিবার অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীকে সঙ্গে নিয়ে জাতীয় সংসদে ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের বাজেট অধিবেশনে যোগ দেন -স্টার মেইল

আসন্ন ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। অর্থমন্ত্রী হিসেবে এটি তার প্রথম বাজেট। বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে মূল্যস্ফীতির বড় চাপের মধ্যে অর্থমন্ত্রী এই বাজেট প্রস্তাব উত্থাপন করেন। বর্তমানে যেখানে মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশ, সেই পরিস্থিতিতে আগামী অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশ থাকবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন অর্থমন্ত্রী। চলতি অর্থবছরের বাজেটেও মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা সাড়ে ৬ শতাংশ ছিল। মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার পাশাপাশি আগামী অর্থবছরের জিডিপির প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ ধরা হয়েছে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা সাড়ে ৭ শতাংশ ধরা হয়, পরবর্তী সময়ে তা কমিয়ে করা হয় সাড়ে ৬ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি কমিয়ে বড় প্রবৃদ্ধির আশাবাদ ব্যক্ত করে অর্থমন্ত্রী যে বাজেট প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন সেখানে অনুদান ছাড়া ঘাটতি ধরা হয়েছে ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। অনুদানসহ সামগ্রিক ঘাটতি ধরা হয়েছে ২ লাখ ৫১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। এছাড়া ৪ হাজার ৪০০ কোটি টাকা অনুদান পাওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধারা হয়েছে। এই ঘাটতি মেটাতে বৈদেশিক ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ লাখ ২৭ হাজার ২০০ কোটি টাকা। বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করা হবে ৩৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এতে নিট বৈদেশিক ঋণ দাঁড়াবে ৯০ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। আর অভ্যন্তরীণ ঋণ নেওয়া হবে ১ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে নেওয়া হবে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি যার ৭২ হাজার ৬৮২ কোটি টাকা দীর্ঘমেয়াদি ঋণ এবং ৬৪ হাজার ৮১৮ কোটি টাকা স্বল্পমেয়াদি ঋণ। ব্যাংকবহির্ভূত ঋণ নেওয়া হবে ২৩ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। সঞ্চয়পত্র বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে ১৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। প্রস্তাবিত বাজেটে ঋণের সুদ পরিশোধের ব্যয় ধরা হয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ ৯৩ হাজার কোটি টাকা। আর বৈদেশিক ঋণের সুদ ২০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এবার রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) লক্ষ্যমাত্রা ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। এনবিআর বহির্ভূত কর ধরা হয়েছে ১৫ হাজার কোটি টাকা। আর কর ব্যতীত প্রাপ্তির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪৬ হাজার কোটি টাকা। প্রস্তাবিত বাজেটে পরিচালন ব্যয় ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৬ হাজার ৯৭১ কোটি টাকা। পরিচালন ব্যয়ের মধ্যে আবর্তক ব্যয় ৪ লাখ ৬৮ হাজার ৯৮৩ কোটি টাকা। আর দেশি-বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধ ১ লাখ ১৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এবার মূলধন ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৭ হাজার ৯৮৯ কোটি টাকা। প্রস্তাবিত বাজেটে উন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ৮১ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা। এর মধ্যে স্কিমে ব্যয় হবে ৫ হাজার ৯৪৩ কোটি টাকা। এডিপি বহির্ভূত বিশেষ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৭ হাজার ৬২৭ কোটি টাকা। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে ব্যয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। আর কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি (এডিপি বহির্ভূত) ও স্থানান্তরে ২ হাজার ৮৮৪ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। নতুন অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী স্বীকার করেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে দেশের অর্থনীতি বর্তমানে কিছুটা চাপের সম্মুখীন হলেও প্রাজ্ঞ ও সঠিক নীতিকৌশল বাস্তবায়নের ফলে জিডিপি প্রবৃদ্ধির গতিধারা অব্যাহত রয়েছে। ২০০৯-১০ অর্থবছর থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের গড় প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬ দশমিক ৭১ শতাংশ যা বিশ্বের সব দেশের মধ্যে অন্যতম সর্বোচ্চ। কোভিড-১৯ অতিমারির আগের বছরে অর্থাৎ ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে হ এ সংক্রান্ত খবর পৃষ্ঠা :২, ১৯ ও ২০ রেকর্ড ৭ দশমিক ৮৮ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছিল। রাশিয়া-ইউক্রেন সংকট এবং অন্যান্য বৈশ্বিক অস্থিরতার ফলে সৃষ্ট সব প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বাংলাদেশ ২০২১-২২ অর্থবছরে ৭ দশমিক ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এছাড়া ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫ দশমিক ৭৮ শতাংশ আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ব্যাংক খাত থেকে সরকার ঋণ নেবে এক লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের চেয়ে যা ৫ হাজার ১০৫ কোটি টাকা বেশি। চলতি অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছিল এক লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা। বিদু্যৎ ও জ্বালানি খাতের গুরুত্ব বিবেচনায় আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এ খাতে মোট ৩০ হাজার ৩১৭ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে বিদু্যৎ খাতে ২৯ হাজার ২৩০ কোটি টাকা এবং জ্বালানি ও খনিজসম্পদ খাতে ১ হাজার ৮৭ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এর আগে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য বরাদ্দ বিদু্যৎ ও জ্বালানি খাতে বরাদ্দ রাখা হয় ৩৪ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা। সে হিসেবে আগামী অর্থবছরে এ খাতে মোট ৪ হাজার ৫০২ কোটি টাকা কম বরাদ্দ প্রস্তাব করা হয়েছে। যদিও সংশোধিত বাজেটে বরাদ্দ কমিয়ে ২৮ হাজার ৩১৮ কোটি টাকা করা হয়। প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্যঝুঁকি মোকাবিলায় জরুরি সময়ের জন্য বিশেষভাবে দুই হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। স্বাস্থ্যঝুঁকি মোকাবিলার জন্য কোভিড অতিমারির সময় থেকে সরকার বিশেষ বরাদ্দ দিয়ে আসছে। এ বছরও আমরা এখাতে দুই হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়ার প্রস্তাব করেন অর্থমন্ত্রী। এছাড়া প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ খাতের জন্য ৪১ হাজার ৪০৭ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে যা মোট প্রস্তাবিত বাজেটের পাঁচ দশমিক দুই শতাংশ। অর্থমন্ত্রী বলেন, স্বাস্থ্যসেবা এবং স্বাস্থ্যশিক্ষা ও পরিবার কল্যাণের অব্যাহত অগ্রগতি বজায় রাখার নিমিত্তে আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৪১ হাজার ৪০৭ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করছি যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ছিল ৩৮ হাজার ৫১ কোটি টাকা। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে যোগাযোগ অবকাঠামো উন্নয়নে ৮০ হাজার ৪৯৮ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। এর আগে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এ খাতে ৮৫ হাজার ১৯১ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল। অর্থাৎ এ খাতে এবার বরাদ্দ কমেছে। অর্থমন্ত্রী বলেন, ১৫ বছরে আমাদের অর্থনীতির আকার উলেস্নখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পাওয়ায় বহির্বিশ্বের সঙ্গে বিমানযোগে যাত্রী ও পণ্য পরিবহণের পরিমাণও বৃদ্ধি পেয়েছে। অভ্যন্তরীণ চলাচলের ক্ষেত্রেও পেস্ননের ব্যবহার বেড়েছে। তাই পেস্নন ও আনুষঙ্গিক সেবাকে আধুনিক এবং বিশ্বমানে উন্নীত করার জন্য আমরা বেশ কিছু কার্যক্রম হাতে নিয়েছি। পেস্ননের নিরাপদ উড্ডয়ন-অবতরণ সুবিধা বৃদ্ধির নিমিত্ত হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, কক্সবাজার বিমানবন্দর ও ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিদ্যমান রানওয়ে ও টেক্সিওয়ে উন্নত এবং দীর্ঘ করা হয়েছে। আগামী অর্থবছর বিনা প্রশ্নে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ থাকছে। দেশের প্রচলিত আইনে যাই থাকুক না কেন- এক্ষেত্রে কোনো কর্তৃপক্ষ কোনো ধরনের প্রশ্ন তুলতে পারবে না। আগামী অর্থবছরের বাজেটে স্থাবর সম্পত্তি যেমন- ফ্ল্যাট, অ্যাপার্টমেন্ট ও ভূমির জন্য নির্দিষ্ট কর দিয়ে অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার সুযোগ থাকছে। এছাড়া নগদ অর্থসহ অন্যান্য পরিসম্পদের ওপর ১৫ শতাংশ কর পরিশোধ করে অপ্রদর্শিত অর্থ (কালো টাকা) বৈধ করার প্রস্তাব রয়েছে। এই প্রস্তাব অনুযায়ী, 'দেশের প্রচলিত আইনে যাই থাকুক না কেন, কোনো করদাতা স্থাবর সম্পত্তি যেমন- ফ্ল্যাট, অ্যাপার্টমেন্ট ও ভূমির জন্য নির্দিষ্ট করহার এবং নগদসহ অন্যান্য পরিসম্পদের ওপর ১৫ শতাংশ কর পরিশোধ করলে কোনো কর্তৃপক্ষ কোনো প্রকারের প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারবে না। আগামী অর্থবছরের জন্য করমুক্ত আয়সীমা অপরিবর্তিত রাখার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। তবে আয়কর হার নির্ধারণে একটি ধাপ বাড়ানো হয়েছে। সর্বোচ্চ করহার ৫ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। এতে বিত্তশালীদের আয়করের পরিমাণ বাড়বে। প্রস্তাবিত বাজেট অনুযায়ী, আয়ের প্রথম সাড়ে ৩ লাখ টাকার ওপর কোনো কর দিতে হবে না। পরবর্তী এক লাখ টাকার ওপর ৫ শতাংশ, পরবর্তী ৩ লাখ টাকায় ১০ শতাংশ, পরবর্তী ৪ লাখ টাকায় ১৫ শতাংশ আয়কর দিতে হবে। এরপর পরবর্তী ৫ লাখ টাকার ওপর ২০ শতাংশ, পরবর্তী ২০ লাখ টাকায় ২৫ শতাংশ এবং বাকি আয়ের ওপর দিতে হবে ৩০ শতাংশ আয়কর। চলতি অর্থবছরেও করমুক্ত আয়সীমা নির্ধারণ করা হয় সাড়ে তিন লাখ টাকা। অর্থাৎ আয়ের প্রথম সাড়ে ৩ লাখ টাকার ওপর কোনো কর দিতে হচ্ছে না। পরবর্তী এক লাখ টাকার ওপর ৫ শতাংশ, পরবর্তী ৩ লাখ টাকায় ১০ শতাংশ, পরবর্তী ৪ লাখ টাকায় ১৫ শতাংশ, পরবর্তী ৫ লাখ টাকার ওপর ২০ শতাংশ এবং বাকি আয়ের ওপর ২৫ শতাংশ আয়কর দিতে হচ্ছে। সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় আসছে আরও ৯ লাখ ৮১ হাজার ৬১ জন। নতুন করে ৫ লাখ প্রতিবন্ধী ভাতা, ১ লাখ ৫০ হাজার ৪৮০ জনের মাতৃত্বকালীন ভাতা, ২ লাখ বয়স্ক ভাতা, ২ লাখ বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্তা ভাতা, ৫ হাজার ৭৪৯ তৃতীয় লিঙ্গ ও ৯০ হাজার ৮৩২ জন সমাজের অন্য অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে ভাতার আওতায় আনা হবে। সামাজিক নিরাপত্তামূলক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ১ লাখ ৩৬ হাজার ২৬ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেছেন, যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১ লাখ ২৬ হাজার ২২৭ কোটি টাকা ছিল। সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ বাড়ছে ৯ হাজার ৭৫৪ কোটি টাকা।