শনিবার, ১২ অক্টোবর ২০২৪, ২৮ আশ্বিন ১৪৩১
বিশ্ব পরিবেশ দিবস আজ

বনায়নে অনেক পিছিয়ে বাংলাদেশ

আলতাব হোসেন
  ০৫ জুন ২০২৪, ০০:০০
বনায়নে অনেক পিছিয়ে বাংলাদেশ

আন্তর্জাতিক মানদন্ড অনুযায়ী একটি দেশে ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকতে হয়, কিন্তু বাংলাদেশ এদিক থেকে অনেক পিছিয়ে আছে। বর্তমানে দেশে মোট বনভূমির পরিমাণ ১৫ থেকে ১৭ শতাংশ। সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ, শিল্প কারখানা, পর্যটন, বনভূমি দখল ও প্রকাশ্যে পুড়িয়ে বন ধ্বংস করা হচ্ছে। প্রতিনিয়ত উজাড় হচ্ছে বনভূমি। এ যেন দেখার কেউ নেই। গাজীপুরের শালবন ৮০টির বেশি বৃহৎ শিল্পকারখানার দখল-দূষণে ধ্বংস হচ্ছে। বনায়নে দিনের পর দিন পিছিয়ে যাচ্ছেন বাংলাদেশ।

২০২০ সালের মধ্যে দেশের মোট ভূখন্ডের ১৭ শতাংশকে রক্ষিত বনাঞ্চল করার ঘোষণা দিয়েছিল সরকার। জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য ঠিক রাখতে বিশ্বের প্রায় সব দেশ জাতিসংঘের একটি সনদে স্বাক্ষর করে ওই ঘোষণা দেয়। কিন্তু লক্ষ্যমাত্রা পূরণে এখনো অনেক পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। 'দক্ষিণ এশিয়ার রক্ষিত বনের অবস্থা ও ভবিষ্যৎ' শীর্ষক এক গবেষণায় দেখা গেছে এ চিত্র।

এমন অবস্থায় বুধবার পালিত হবে বিশ্ব পরিবেশ দিবস। দিবসটির প্রতিপাদ্য হচ্ছে, 'করব ভূমি পুনরুদ্ধার, রুখব মরুময়তা; অর্জন করতে হবে মোদের খরা সহনশীলতা'। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বিশ্ব পরিবেশ দিবসের

\হমেলা ও বৃক্ষমেলার উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী সেখ হাসিনা। এ সময় প্রধানমন্ত্রী 'বৃক্ষ দিয়ে সাজাই দেশ, সমৃদ্ধ করি বাংলাদেশ' প্রতিপাদ্যে বৃক্ষমেলার উদ্বোধন করবেন। এ সময় তিনি একটি পলাশ ও বেল গাছের দুটি চারা রোপণ করবেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু অ্যাওয়ার্ড ফর ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেশন, জাতীয় পরিবেশ পদক, বৃক্ষ রোপণে প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় পুরস্কার এবং সামাজিক বনায়নে উপকারভোগীদের মধ্যে লভ্যাংশের চেক বিতরণ করা হবে। পরিবেশ মেলা চলবে ১১ জুন পর্যন্ত এবং বৃক্ষমেলা চলবে ১৩ জুলাই পর্যন্ত। প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৮টা পর্যন্ত মেলা চলবে।

এদিকে বিজ্ঞান সাময়িকী সায়েন্স অব দ্য টোটাল এনভায়রনমেন্টের গবেষণায় বলা হয়, ২০১১ সালে বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় সব দেশ জাতিসংঘের জীববৈচিত্র্য বিষয়ক সনদ (সিবিডি) অনুযায়ী ওই লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে। এসব দেশের মধ্যে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সবচেয়ে পিছিয়ে আছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো। এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ, আফগানিস্তান ও মালদ্বীপে রক্ষিত বনের পরিমাণ ৫ শতাংশের নিচে। বাংলাদেশ ২০২১ সাল পর্যন্ত দেশের মাত্র ৪ দশমিক ৬১ শতাংশ এলাকাকে রক্ষিত বন করতে পেরেছে। দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে এগিয়ে আছে ভুটান, দেশটির রক্ষিত বন ৪৯ শতাংশ ৬৭ শতাংশ। ভারতে রক্ষিত বন ৭ শতাংশ ৫২, শ্রীলংকায় ২৯ শতাংশ ৮৯, পাকিস্তানে ১২ শতাংশ ৩১, নেপালে ২৩ শতাংশ ৬৩, মালদ্বীপে ২ শতাংশ ৩ ও আফগানিস্তানে ৩ শতাংশ ৬৪ শতাংশ।

প্রকৃতিবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড রিসোর্সেস ইনস্টিটিউটের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বের ১৫ দশমিক ৭৩ শতাংশ এলাকা রক্ষিত বনভূমি। আর জলভাগের ৭ দশমিক ৯২ শতাংশ এলাকা রক্ষিত অবস্থায় আছে। ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা ও আফ্রিকার বেশিরভাগ দেশ রক্ষিত বনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পেরেছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে পিছিয়ে আছে এশিয়ার দেশগুলো। গবেষণায় বলা হয়, বাংলাদেশের রক্ষিত এলাকার ১ শতাংশের কম জায়গা কার্যকর ব্যবস্থাপনার আওতায় আনা হয়েছে। বাকি এলাকায় বন্যপ্রাণী হত্যা ও পাচার, বৃক্ষ ধ্বংস করাসহ মোট ১৪ ধরনের সমস্যা রয়েছে। রক্ষিত এলাকাগুলোর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা থাকলে একে প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থার (আইইউসিএন) সবুজ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশের কোনো রক্ষিত বন এখন পর্যন্ত ওই তালিকায় যুক্ত হতে পারেনি। সিবিডি থেকে ২০২০ থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে মোট ভূখন্ডের ৩০ শতাংশ এলাকাকে জীববৈচিত্র্য রক্ষা করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করার প্রস্তাব দিয়েছে।

বিশ্বজুড়েই জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাড়ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ। আর একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগের আঘাতে ধ্বংস হচ্ছে বনাঞ্চল। যার ফলে শ্বাসমূলীয় বনাঞ্চলের পরিমাণ আশঙ্কাজনকভাবে কমেছে। বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন শুধু প্রাণী বৈচিত্র্যের আধারই নয়, বাংলাদেশের প্রাকৃতিক ঢালও বটে। বিশ্বের বৃহত্তম এ শ্বাসমূল বন ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় বুক আগলে রক্ষা করে বাংলাদেশকে। এ এক অপার বিস্ময়! প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় সিডর, আইলা, ফণী ও বুলবুল, আম্ফানের ক্ষত কাটতে না কাটতেই রেমালের তান্ডব রোধে আবারও মায়ের আঁচলের মতো বুক পেতে উপকূলীয় এলাকার মানুষ ও সম্পদ রক্ষা করেছে সুন্দরবন। এভাবেই বারবার নিজে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে বাংলাদেশের প্রকৃতি ও জীবনকে বাঁচিয়ে যাচ্ছে সুন্দরবন। বাংলাদেশে আঘাত হানা শক্তিশালী ঘূর্র্ণিঝড়ের বিরুদ্ধে লড়তে সুন্দরবন হয়ে উঠেছে রক্ষাকবচ। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলের জন্য সুন্দরবন প্রাকৃতিক শক্তিশালী দেয়াল হয়ে উঠেছে। সুন্দরবন বারবার বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি থেকে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ায়। এখন সময় এসেছে সুন্দরবনের জন্য কিছু করার। নিজেদের স্বার্থেই সুন্দরবনকে বাঁচাতে হবে। বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনকে বাঁচাতে ঝুঁকির মুখে ফেলা কয়লাভিত্তিক বিদু্যৎ প্রকল্পের নির্মাণকাজ এবং সুন্দরবন ঘিরে যে শিল্পায়ন প্রক্রিয়া চলছে তা বন্ধ করা প্রয়োজন।

ঢাকা এবং পার্শ্ববর্তী এলাকায় অসংখ্য শিল্প কলকারখানা স্থাপন এবং বনভূমির অপর্যাপ্ততার কারণে বর্তমানে তাপপ্রবাহ এবং অক্সিজেন স্বল্পতার মতো মারাত্মক কিছু ঘটনা বর্তমানে পর্যবেক্ষণ করা যায়। এ ছাড়া সারাদেশে গড় তাপমাত্রা রেকর্ড ছাড়িয়ে যাচ্ছে। আগামী ১০ বছরের পরে হয়তো রাজধানী ঢাকা হবে বিশ্বের বসবাসের অযোগ্য প্রথম পাঁচটি শহরের মধ্যে একটি। বাংলাদেশের ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের অবস্থা দিন দিন বেশ নাজুক হয়ে উঠছে। প্রবল শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় ঠেকাতে ঠেকাতে সুন্দরবনও তার শক্তি হারাচ্ছে ক্রমশ। সব মিলিয়ে প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট নানা কারণে সুন্দরবনের মতো ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের পরিমাণ কমে যাচ্ছে।

বিশেষত সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশ নিয়ে অনেক আগে থেকেই উদ্বেগ জানিয়ে আসছে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা। কিন্তু তা সত্ত্বেও এ বিষয়ে সতর্ক হয়নি বাংলাদেশ। এ ছাড়া বন ধ্বংস হওয়ার ফলে বিপন্ন হচ্ছে পশুপাখির আশ্রয়স্থল। এর ফলে নষ্ট হচ্ছে পরিবেশের ভারসাম্য। দেশে এমনিতেই প্রয়োজনের তুলনায় বনাঞ্চল অনেক কম। অথচ শিল্পোন্নত দেশ জাপানের ভূখন্ডের শতকরা ৭০ ভাগ এবং জনবহুল দেশ ইন্দোনেশিয়ার ৫০ ভাগ ভূখন্ড বনে আচ্ছাদিত।

মঙ্গলবার সচিবালয়ে বিশ্ব পরিবেশ দিবস ও পরিবেশ মেলা ২০২৪ এবং জাতীয় বৃক্ষরোপণ অভিযান ও বৃক্ষমেলা ২০২৪ উপলক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী বলেছেন, আন্তর্জাতিক মানদন্ড অনুযায়ী বাংলাদেশ বনায়নে অনেক পিছিয়ে আছে। বাংলাদেশ একটি ঘনবসতিপূর্ণ দেশ, এখানে অনেক চ্যালেঞ্জ আছে। তারপরও আমাদের যতটুকু বনায়ন আছে তা রক্ষায় কাজ করতে হবে। বনায়ন কম থাকায় বাংলাদেশে ৩৩৪টি প্রজাতির বন্যপ্রাণীর বিপন্নের আশঙ্কায় আছে। দেশের প্রকৃতি থেকে ৩১টি প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আগামীতে আরও ৫৬টি প্রজাতির বন্যপ্রাণী বিলুপ্তির উচ্চ ঝুঁকিতে আছে। আমরা চাই না আমাদের দেশে আর কোনো প্রজাতি বিপন্ন হোক।

সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, 'আমরা সবুজ এলাকা হারিয়েছি, জলাশয়ও নেই। কাজেই আমরা মনে করি, নগর উন্নয়নে আমাদের যে মূল পরিকল্পনা আছে, সেটার মধ্যে বনায়ন নিয়ে আসতে হবে। ঢাকা শহরের কোন কোন জায়গায় আমরা বনায়ন করতে পারি, কী কী গাছ লাগাতে পারি, তা ঠিক করতে স্থানীয় সরকার বিভাগ, পূর্ত মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ও দুই সিটি করপোরেশনের সঙ্গে মিলে আমরা একটা ছক দাঁড় করানোর চেষ্টা করছি। বিশ্বজুড়ে যে মান আছে, সেটা বাংলাদেশে কতটুকু কার্যকর করতে পারব; আমরা জানি না। ঢাকা বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ শহর। এখানে আমরা কীভাবে সেই জায়গাটা বের করব? এরই মধ্যে আমরা কিছু কিছু কাজ শুরু করেছি।'

সংবাদ সম্মেলনে ড. ফারহিনা আহমেদ জানান, ২০৩০ সাল নাগাদ দেশের মোট ভূমির ২২ দশমিক ৩৭ শতাংশ হতে ২৫ শতাংশে এবং বনাচ্ছাদনের পরিমাণ ১৪ দশমিক ১ শতাংশ হতে ১৬ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এ বছর বর্ষা মৌসুমে সারাদেশে ৮ কোটি ৩৩ লাখ ২৭ হাজার চারা রোপণ করা হবে। দেশের উপকূল, বাঁধ এবং পোল্ডারে বনায়নের মাধ্যমে উপকূলজুড়ে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সবুজ বেষ্টনী সৃজন করা হচ্ছে। ২০২৩ সাল পর্যন্ত প্রয় ৮৯ হাজার ৮৫৩ হেক্টর উপকূলীয় বনায়ন সৃজন করা হয়েছে। ৩০ হাজার একর বনভূমি জবরদখলমুক্ত করা হয়েছে এবং তাতে বনায়ন সম্পন্ন হয়েছে। বনায়ন, বন ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের লক্ষ্যে ২২টি রক্ষিত বনাঞ্চল এলাকায় স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে ২৮টি সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করা হয়েছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে