শনিবার, ১২ অক্টোবর ২০২৪, ২৮ আশ্বিন ১৪৩১

বান্দরবানেও বেনজীরের কোটি টাকার সম্পত্তি!

ক্যমুই অং মারমা, বান্দরবান
  ০৩ জুন ২০২৪, ০০:০০
বেনজীর আহমেদ

সমতলের পর এবার পাহাড়েও কয়েক কোটি টাকার সম্পদের খোঁজ পাওয়া গেছে সাম্প্রতিক সময়ে দেশে আলোচিত পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদের। এর মধ্যে বান্দরবান সদর উপজেলার সুয়ালক ইউনিয়নে ২৫ একর ও লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নের টংগঝিরি এলাকায় ৫৫ একর জায়গা।

এদিকে জায়গাগুলো বিভিন্ন সময় নিজের, তার স্ত্রী ও দুই মেয়ের নামে লিজ ও কিনে নিয়েছেন বেনজীর আহমেদ। আর এসব জায়গা পাইয়ে দিতে সহযোগিতা করার অভিযোগ উঠেছে স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতার বিরুদ্ধে।

সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, বান্দরবান-কেরানীহাট মহাসড়কের পাশে বাংলাদেশ চা বোর্ডের রাস্তা দিয়ে কিছুদূর গেলেই হাতের ডান পাশে এইচবিবির একটি সড়ক। সড়কটি ধরে কিছুদূর যেতেই দেখা মেলে বেনজীর আহমেদের বিলাসবহুল শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত রেস্টহাউস। এরপর একে একে চোখে পড়ে মৎস্য প্রজেক্ট, গরুর খামারসহ বিভিন্ন ফলদ-ফলজ বাগান। এসব প্রজেক্টের দেখাশোনার জন্য রয়েছে চার-

পাঁচজন কর্মচারী।

তাদের মধ্যে একজন লেদু মিয়া। তিনি জানান, জায়গাটি বেনজীর আহ?মে?দের হ?লেও সবকিছুর দেখাশোনা করেন বান্দরবান জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মংওয়াই চিং মারমা। তাদের বেতন-ভাতা, গরু ও মাছের খাদ্য ক্রয় থেকে শুরু করে সবকিছু তিনিই সামাল দেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক নারী কেয়ারটেকার জানান, এ জায়গা?টি এস?পির জায়গা হি?সে?বেই পরিচিত সকলের কা?ছে। ত?বে কাগজপত্রে বেন?জীর আহ?মেদ, তার স্ত্রী ও কন?্যার নাম রয়েছে বলেও জানান তিনি।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৬ সা?লে বেন?জীর আহ?মেদ, তার স্ত্রী জীশান মির্জা ও মে?য়ে ফারহীন রিশতা বিন?তে বেনজীরের না?মে ৩১৪ নম্বর সুয়ালক মৌজায় ৬১৪ নম্বর দাগে ও ৩ নম্বর সিটে ২৫ একর জায়গা লিজ নিয়েছিলেন বান্দরবান পৌর এলাকার মধ্যমপাড়ার বাসিন্দা আবুল কাশেমের ছে?লে শাহ জাহা?নের কাছ থে?কে। এদিকে, লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নের ডলুছ?ড়ি মৌজায় বেন?জীর আহমেদ, তার স্ত্রী ও মে?য়ের না?মে রয়েছে ৫৫ একর জায়গা।

শনিবার সরেজমিন লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নের ডলুছ?ড়ি মৌজার টংগঝি?রি?তে গিয়ে দেখা যায়, ৫৫ একরের মধ্যে প্রায় ২৫ একরজুড়ে বেনজীর আহমেদের বিভিন্ন ফলদ-ফলজের সৃজিত বাগান। সেখানে রয়েছে দু'কক্ষবিশিষ্ট টিনশেড ঘর। জায়গা দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা কেয়ারটেকার মো. ইব্রাহিম জানান, প্রতি মাসের ১০ থেকে ১২ তারিখ বান্দরবানের মং (মংওয়াই চিং) নামে একজন আসেন এবং বেতন দিয়ে চলে যান। তবে জায়গাটি আসল মালিক কে সেটা তিনি জানেন না বলে জানান কেয়ারটেকার ইব্রাহিম।

স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে, এসব জায়গায় একসময় অসহায় প?রিবারের বসবাস থাক?লেও নামমাত্র মূ?ল্যে এসব জ?মি তারা বি?ক্রি ক?রতে বাধ?্য হয়েছে।

টংগঝি?রি পাড়ার বাসিন্দা সাবেক ইউপি সদস্য পাইসাপ্রম্ন ত্রিপুরা জানান, তাদের এলাকায় বেনজীর আহমেদের ৫৫ একর জায়গা র?য়ে?ছে। এ জায়গাগু?লো?তে একসময় অসহায় প?রিবা?রের বসবাস থাক?লেও বর্তমানে জায়গাগুলো বেনজীর আহমেদের জায়গা হয়ে গেছে আর তারা এখন অসহায় হয়ে গেছেন।

একই পাড়ার বাসিন্দা এরমনি ত্রিপুরা নামে আরেক ব্যক্তি জানান, তারা গরিব মানুষ, আর এসপি (আইজিপি বেনজীর) তাদের অনেক টাকা। পার্শ্ববর্তী জায়গা হওয়ায় বাধ্য হয়ে তাদের ত্রিপুরারা জায়গাগুলো তার কাছে বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন। জায়গাগুলো হারিয়ে এখন অনেক কষ্টের মধ্যে দিন যাচ্ছে তাদের। তখনকার দিনে তাদের ক্ষমতার কাছে তারা অসহায় ছিলেন। এখনও জায়গার ব?্যাপা?রে কারোর কাছে মুখ না খোলার জন?্যও প্রতিনিয়ত হুম?কি আসছে বলেও জানান তিনি।

বান্দরবান সুয়ালক ইউনিয়?নের চেয়ারম?্যান উক?্যনু মারমা জানান, তার সুয়ালক ইউনিয়নে মাঝেরপাড়ার জায়গাটি মূলত জেলা স্বেচ্ছাসেবক লী?গের সভাপ?তি মংওয়াই চিং দেখাশোনা করেন। স্থানীয়দের কাছে শুনেছেন জায়গাটি বেনজীর আহ?মে?দের। তিনি জায়গাগু?লো কীভা?বে নি?য়ে?ছেন তা জানেন না। তবে মা?ঝে মধ্যে একজন এস?পি এখা?নে আসতেন বলে জানান তিনি।

এদিকে, পাহাড়ে বেনজীর আহমেদকে জায়গা ক্রয় করে দেওয়া ও লিজ নেওয়ায় সহযোগিতার কথা অস্বীকার করে স্বেচ্ছাসেবক লী?গে?র সভাপ?তি মংওয়াই চিং জানান, সুয়ালকের মা?ঝেরপাড়ায় বেনজীর আহমে?দের জায়গার পা?শে তার কিছু জায়গা আছে। সে সুবা?দে এক পু?লিশ কর্মকর্তার অনুরোধে তিনি তার (বেনজীর আহ?মে?দ) এ জায়গাগু?লো দেখাশোনা করেন। তবে লামার ডলুছ?ড়ির টংগঝি?রির জায়গা জখলের বিষ?য়টি অস্বীকার ক?রে তি?নি বলেন, ডলুছ?ড়ি মৌজার জায়গার ব?্যাপা?রে তিনি কিছুই জানেন না।

বান্দরবান জেলা প্রশাসক শাহ্‌ মোজা?হিদ উদ্দিন বলেন, বান্দরবা?নে বেনজীর আহমেদের লিজের জায়গা যদি থাকে তবে সেটি তিনি এখানে যোগদান করার আগে হতে পারে। অভিযোগের বিষয়ে বিস্তারিত খবর নি?য়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।

\হ

গ্রামবাসীকে লাঠিপেটার অভিযোগ

এদিকে, গোপালগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, গোপালগঞ্জে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদের মালিকানাধীন রিসোর্টের সামনে গ্রামবাসীদের লাঠিপেটা করেছে অভিযোগ উঠেছে।

সদর উপজেলার সাহাপুর ইউনিয়নের বৈরাগীটোল গ্রামে 'সাভানা ইকো রিসোর্ট অ্যান্ড ন্যাচারাল পার্ক' নামে ওই রিসোর্টের সামনে শনিবার সন্ধ্যায় এ ঘটনা ঘটে।

স্থানীয়রা বলছেন, এ ঘটনায় চারজন আহত হয়েছেন। তারা হলেন ইকোপার্ক সংলগ্ন সাহাপুর ইউনিয়নের বৈরাগীটোল গ্রামের বিনোদ বিহারি বলের ছেলে বিপস্নব বল, সন্তোষ বলের ছেলে সঞ্জয় বল ও সাগর বল এবং ওই এলাকার রনি।

তবে গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার বৌলতলী পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক মো. আমিনুল ইসলামের ভাষ্য, লাঠিপেটার কোনো ঘটনা ঘটেনি।

ঘটনার বর্ণনায় আহত বিপস্নব বলেন, 'গত ২-৩ বছরে বেনজীর আহমেদ আমাদের গ্রামের অসহায় পরিবারের জমি বিভিন্ন কৌশলে দখল করে নিয়েছেন। এ নিয়ে আমরা ভয়ে মুখ খুলতে সাহস পাইনি। বেনজীরের অপকর্ম এখন বের হয়ে আসছে। তাই ৪-৫ দিন ধরে তার বিরুদ্ধে মিডিয়ায় কথা বলে মনের ক্ষোভ মেটাচ্ছি। এ কারণে পুলিশ আমাদের ওপর লাঠিচার্জ করেছে।'

আহত সঞ্জয় বল বলেন, 'গত দুই বছরে সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ আমাদের গ্রামের অসহায় লোকের জমি দখল করে নিয়েছেন। এ নিয়ে আমরা ভয়ে মুখ খুলতে পারি নাই। দুদকের অনুসন্ধানে বেনজীর ও তার পরিবারের বিপুল সম্পদের তথ্য বেরিয়ে আসার পর আমরা কথা বলছি। এ কারণে শনিবার সন্ধ্যার পর পুলিশ এসে আমাদের ওপর লাঠিপেটা শুরু করে। আমার মোবাইল ফোন ভেঙে ফেলেছে। আমাদের কী দোষ ছিল, পুলিশ এসে আমাদের বেধড়ক মারপিট করবে?'

সাভানা ইকোরিসোর্টের নিরাপত্তা কর্মী আব্দুলস্নাহ বলেন, 'শনিবার সন্ধ্যার দিকে গ্রামের কিছু লোক রিসোর্টের সামনে জড়ো হয়। তারা বিভিন্নভাবে আমাদের হুমকি-ধামকি দিচ্ছিল। পরে রিসোর্টের দোকানে অবস্থান নেন তারা।'

তিনি বলেন, 'সেখানে তারা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করে। রিসোর্টে হামলা হতে পারে এমন আশঙ্কায় আমরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। পরে আমাদের পক্ষ থেকে পুলিশকে ফোন করে বিষয়টি জানানো হয়। সন্ধ্যার পর পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।'

লাঠিপেটা প্রসঙ্গে গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার বৌলতলী পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, 'সাভানা ইকোরিসোর্টের কর্মচারীরা ফোন করে খবর দেন যে, পার্কের সামনে স্থানীয় লোকজন জড়ো হয়েছে। তারা দারোয়ানকে ভয়ভীতি দেখাচ্ছে। খবর পেয়ে আমরা সেখানে যাই। সেখানে যাওয়ার পর দেখি, দোকানের ভেতর কিছু লোক জুয়া খেলছে। তাই তাদের ধমক দিয়েছি। এ সময় আতঙ্কে ঘটনাস্থল ত্যাগ করতে গিয়ে একজন পড়ে গিয়ে ব্যথা পেয়েছে; এতে তারা ক্ষুব্ধ হয়।'

তিনি বলেন, 'তারা লাঠিপেটার মিথ্যা অভিযোগ করেছে। সেখানে এমন কোনো ঘটনাই ঘটেনি।'

ছবির ক্যাপশন : ১. বান্দরবান সদরের সুয়ালক ইউনিয়নে ২৫ একর জায়গায় বিশ্রামের জন্য নির্মিত বেনজীর আহমেদের রেস্টহাউস, ২. লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নের টংগঝিরি এলাকায় বেনজীর আহমেদের জায়গার একাংশের ছবি, ৩. বেনজীর আহমেদের নামে কাগজের ডকুমেন্ট

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে