শনিবার, ১২ অক্টোবর ২০২৪, ২৮ আশ্বিন ১৪৩১

নতুন চাপে কৃষি শিল্প পরিবহণ

জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির কারণে গাড়িভাড়া ও পণ্য পরিবহণ ব্যয় বাড়বে। এর প্রভাব পড়বে সাধারণ যাত্রী ও ক্রেতার ওপর। সীমিত আয়ের মানুষ ফের অর্থনৈতিক চাপের মধ্যে পড়বে
সাখাওয়াত হোসেন
  ০২ জুন ২০২৪, ০০:০০
নতুন চাপে কৃষি শিল্প পরিবহণ

বিদু্যতের মূল্য বৃদ্ধির হিসেব-নিকেশ কষে নতুন পরিস্থিতি বুঝে ওঠার আগেই ফের বাড়ল জ্বালানি তেলের দাম। কয়েক মাসের ব্যবধানে এ দুটি পণ্যের দাম বৃদ্ধিতে কৃষকের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ার অবস্থা। এর উপর চলতি জুন মাসেই বিদু্যতের দাম নতুন করে আরও ১০ থেকে ১২ শতাংশ বাড়ানো হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আগাম আভাস দিয়েছে। এতে কৃষি পণ্যের উৎপাদন খরচ যে হারে বাড়বে তার সঙ্গে সমন্বয় করে বাজারে বাড়তি দরে জিনিসপত্র বিক্রি করা যাবে কিনা তা নিয়ে এ খাতের উপর নির্ভরশীল মানুষের রাতের ঘুম উধাও হয়ে গেছে।

এদিকে শিল্প খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা, বিদু্যতের সঙ্গে পালস্না দিয়ে জ্বালানি তেলের দাম যেভাবে দফায় দফায় বাড়ছে, তাতে পণ্য উৎপাদন খরচ ২০ থেকে ২৫ শতাংশ বাড়বে। ফলে শিল্পে উৎপাদিত পণ্যের দর আকাশ ছোঁয়া হয়ে দাঁড়াবে। দেশে উৎপাদিত পণ্যের তুলনায় কম দামে আমদানি পণ্য পাওয়া গেলে মানুষ বিদেশি পণ্য কেনার দিকে ঝুঁকবে। এছাড়া উচ্চমূল্যের কারণে দেশীয় শিল্পপণ্য রপ্তানির বাজার হারাবে। শিল্প খাতে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় কলকারখানার মালিকরা বিপুল সংখ্যক শ্রমিক-কর্মচারী ছাঁটাই করতে বাধ্য হবেন। এতে এখাতে অস্থিতিশীল হয়ে ওঠার আশঙ্কা রয়েছে। যা তাদের উপর নতুন চাপ সৃষ্টি করবে।

অন্যদিকে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির কারণে গাড়িভাড়া ও পণ্য পরিবহণ ব্যয় বাড়বে। এর প্রভাব পড়বে সাধারণ যাত্রী ও ক্রেতার ওপর। জ্বালানি তেলের মূল্য বাড়ার কারণে সীমিত আয়ের মানুষ ফের অর্থনৈতিক চাপের মধ্যে পড়বে।

কৃষি খাত পর্যবেক্ষকরা বলছেন, বিদু্যৎ ও জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির কারণে প্রতি কেজি চালে সরাসরি দাম বাড়বে ২৫ থেকে ৩০ পয়সা। ২০ পয়সা বাড়বে পরিবহণে। আরও ১০ পয়সা বাড়বে শ্রমিকের পারিশ্রমিকে। এ হিসেবে প্রতি কেজি চালের দাম পাইকারি পর্যায়ে নূ্যনতম ৫৫ থেকে ৬০ পয়সা বাড়বে। এছাড়া ধান থেকে চাল প্রক্রিয়াকরণের মিলগুলো চলে বিদু্যতে। কাজেই মিলের খরচ বাড়বে। সেচের কাজেও বাড়তি অর্থ খরচ হবে।

কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. আসাদুজ্জামান বলেন, জ্বালানি তেল ও

বিদু্যতের দাম বাড়ার ফলে ফসলের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। খরচ বাড়ার কারণে কৃষক চাষাবাদ কমিয়ে দেবে। তাছাড়া এসব উৎপাদিত ফসল বাজারে আসতে আসতে দ্বিগুণ দাম হয়ে যাবে। উৎপাদন খরচ বাড়লেও পণ্যের ন্যায্য দাম পান না কৃষক। কৃষক না বাঁচলে উৎপাদন ব্যাহত হবে। হুমকিতে পড়বে খাদ্য নিরাপত্তা।

প্রসঙ্গত, বিএডিসি এবং বিএমডিএ এই দুই সংস্থা মিলে দেশে সেচ পাম্প পরিচালনা করে। এছাড়া বেসরকারিভাবেও পাম্প চালানো হয়। সব মিলে দেশে সেচ পাম্পের সংখ্যা ১৬ লাখ ৫১ হাজার ৩৫টি। এর মধ্যে ১২ লাখ ১৭ হাজার ৭৮৯টি ডিজেলে চলে। বাকি ৪ লাখ ৩৩ হাজার ২৪৬টি চলে বিদু্যতে।

এদিকে পরিবহণ মালিক-শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কুষ্টিয়া থেকে ১২ টনের একটি লরি ঢাকায় পৌঁছতে খরচ পড়ে ১৩ হাজার ২০০ টাকা। প্রতি কেজিতে খরচ পড়ে ৯০ পয়সা। এর সঙ্গে যোগ হয় শ্রমিকের খরচ ২০ পয়সা। পরিবহণ ও শ্রমিকের খরচসহ চাল পরিবহণে কেজিপ্রতি খরচ হয় ১ টাকা ২০ পয়সা। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় এখন কেজিতে পরিবহণ খরচ বাড়বে ২০ পয়সা এবং শ্রমিকের খরচ বাড়বে ১০ পয়সা। এই ৩০ পয়সা বৃদ্ধিতে ১২ টন চাল ঢাকায় আনতে খরচ পড়বে ১৬ হাজার ৮০০ টাকা।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জ্বালানি তেল, বিদু্যৎ, পরিবহণ সেক্টর- এগুলো একটি অপরটির সঙ্গে সম্পৃক্ত। একটির দাম বাড়লে অপরটির দাম বাড়বেই। এই অযৌক্তিক দাম বৃদ্ধির বোঝা দিন-রাত জনগণকেই বইতে হচ্ছে। ভর্তুকি কমাতে জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে সরকার যা করছে, তা দেশের অর্থনীতির ওপর আরও চাপ সৃষ্টি করবে। বিশেষ করে সীমিত আয়ের মানুষ নতুন করে আরও কঠিন অর্থনৈতিক চাপের মধ্যে পড়বে।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও কনজু্যমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, দেশের সাধারণ মানুষ বর্তমানে উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে রয়েছে। এরইমধ্যে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির মানে নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়া। এর আগেও বিদু্যৎ,পানিসহ জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। এখন তেলের দাম বাড়ানোর চাপ ভোক্তারা নিতে পারবে না।

তিনি বলেন, সামনে আবার বিদু্যৎ, গ্যাসের দাম বাড়বে। এর পর আবার তেলের দাম কিছু দিন পর পর বাড়তেই থাকবে। পুরো বিষয়টি এখন একটি চক্রের মতো ঘুরে ঘুরে চলবে। ইতোমধ্যে সাধারণ মানুষ অতিষ্ঠ। সামনে আরও অতিষ্ঠ হয়ে উঠবে। মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে সব।

অর্থনীতিবিদরা জানান, যানবাহনের ভাড়া বাড়লে এবং শিল্প খাতের উৎপাদন খরচ বাড়লে এর প্রভাব পড়বে ভোক্তাদের ওপর। বাড়তি ব্যয়ের অর্থ ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্টরা জনগণের কাছ থেকেই আদায় করবে। শুধু তাই নয়, এ মূল্য বৃদ্ধির অজুহাতে যৌক্তিক ও অযৌক্তিকভাবে বিভিন্ন খাতে সেবার দামও বাড়ানোর প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে। এছাড়া জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধিতে রপ্তানি পণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়ে গিয়ে প্রতিযোগিতা সক্ষমতায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। দেশে উৎপাদন খরচ বাড়লে বিভিন্ন পণ্যের আমদানি বেড়ে যেতে পারে। আমদানির প্রবণতা বাড়লে ডলার সংকটসহ নানা সংকট সৃষ্টি হতে পারে।

বিদু্যৎ ও পিডিবির দুই কর্মকর্তা জানান, টাকার অবমূল্যায়নের কারণে বিদু্যতের উৎপাদন ব্যয় অনেকাংশে বেড়ে গেছে। এ কারণে জাতীয় বাজেটের আগে মূল্য সমন্বয়ের মাধ্যমে বিদু্যতের দাম বাড়ানোর বিষয়ে কাজ চলছে। জানা গেছে, ডলারের বিপরীতে এক টাকা অবমূল্যায়ন হলে পিডিবির বার্ষিক ব্যয় ৪৭৪ কোটি টাকা বেড়ে যায়। এ হিসাবে সাত টাকার অবমূল্যায়নের বিপরীতে পিডিবির বার্ষিক খরচ ৩ হাজার ৩১৮ কোটি টাকা বেড়ে যাবে। এজন্য জুনে বিদু্যতের দাম সমন্বয়ের পরিকল্পনা করা হয়েছে। খুচরা ও পাইকারি বিদু্যতের দাম কম-বেশি ১০ থেকে ১২ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে। যদিও এ বিষয়টি এখনো চুড়ান্ত হয়নি।

সংশ্লিষ্টরা আরও জানান, আমদানিনির্ভর বিদু্যৎ ও জ্বালানি খাত প্রায় পুরোপুরি ডলারকেন্দ্রিক। তেল, কয়লা, এলএনজি কিংবা ভারত থেকে বিদু্যৎ আমদানি, বিদু্যৎ কেন্দ্রের দেনা, বিদেশি কোম্পানির পাওনা- সবই পরিশোধ হচ্ছে ডলারে। পাশাপাশি আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ নিতে গিয়ে বিদু্যৎ ও জ্বালানি খাত ভর্তুকিমুক্ত করাসহ নানা সংস্কারের পথে হাঁটতে হচ্ছে সরকারকে।

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) সূত্র জানায়, ডলারের ব্যাপক মূল্য বৃদ্ধির কারণে চড়া খরচে আমদানি করে তুলনামূলক কম দামে জ্বালানি তেল বিক্রি করায় এ রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার শুধু মে মাসেই ৫০০ কোটি টাকার বেশি লোকসান হতে পারে।

প্রসঙ্গত, মে মাসের শুরুতে এ মাসের জন্য জ্বালানি তেলের মূল্য নির্ধারণ করে দেয় সরকার। এর এক সপ্তাহ পর, ৮ মে কেন্দ্রীয় ব্যাংক টাকা-ডলারের বিনিময় হার পদ্ধতিতে পরিবর্তন এনে 'ক্রলিং পেগ' পদ্ধতি চালু করে। এতে প্রতি ডলারের দর ৭ টাকা বেড়ে ১১৭ টাকায় উঠে যায়।

এপ্রিল মাসে জ্বালানির তেল আমদানি করা হয়েছিল ডলারপ্রতি ১১০ টাকা হিসাবে। গত ৩০ এপ্রিল মে মাসের জন্য জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ প্রতি লিটার ডিজেল ও কেরোসিনের দাম ১০৭ টাকা নির্ধারণ করে। আর প্রতি লিটার পেট্রোলের দাম ১২৪.৫০ টাকা ও অকটেনের দাম ১২৮.৫০ টাকা নির্ধারণ করে। কিন্তু এপ্রিলে বা মে মাসে ডলারের দাম বাড়ার আগে আমদানি করা বেশিরভাগ জ্বালানি তেলের মূল্য পরিশোধে বিপিসিকে প্রতি ডলারের দর দিতে হচ্ছে ১১৭ টাকা। এতে বিপিসিকে বাড়তি টাকা গুনতে হয়েছে। কিন্তু তেল বিক্রি করা হয়েছে তুলনামূলক কম দামে।

বিপিসির সূত্রমতে, ডলার সংকটের কারণে মে মাসেও সব জ্বালানি তেলের মূল্য পরিশোধ সম্ভব হয়নি, কিছু বকেয়া রয়ে গেছে। প্রতি মাসে পরিশোধিত ও অপরিশোধিত মিলিয়ে মোট ১৭-১৮ কার্গো জ্বালানি তেল আমদানি করে বিপিসি। প্রতি কার্গোতে গড়ে ৩০ হাজার টন তেল থাকে। বিপিসিই দেশে একমাত্র সংস্থা, যারা জ্বালানি তেল আমদানি ও বিপণন করে থাকে।

যদিও জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারের তুলনায় এখনো দেশে জ্বালানির দাম অনেক বেশি। তাই এখাতে কর কমিয়ে দাম সমন্বয় করা হলে মূল্যস্ফীতি কমে আসবে।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ইজাজ হোসেন বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে যে দাম রয়েছে সে তুলনায় এখানে যে দাম নির্ধারণ করা হয়েছে তা বেশি। সরকার এখানে রাজস্ব আয় হিসেবে এটি গ্রহণ করছে। নিত্যপণ্যে কোনো ট্যাক্স থাকা উচিত না। কেননা এতে মূল্যস্ফীতির একটি বড় সম্পর্ক রয়েছে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পেট্রোলিয়াম ও খনিজ সম্পদ প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. এম তামিম বলেন, বর্তমানে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো অর্থনৈতিক সমস্যা, সেটা জ্বালানি খাতের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত নয়।

তার ভাষ্য, বিদু্যৎ-জ্বালানি খাতের সমস্যা হলো, আমদানি নির্ভরতার কারণে বৈদেশিক মুদ্রার সংস্থানের দরকার। যেহেতু জ্বালানি খাতে আমদানি নির্ভরতা বেশি এবং অর্থনৈতিক সংকটের কারণে টাকার সংকট, ডলারের সংকট রয়েছে, মূলত সে কারণেই বিদু্যৎ-জ্বালানি খাতে সংকট দেখা দিয়েছে; দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে।

এদিকে ভোক্তারা বলছেন, বাজারে এমনিতেই নিত্যপণ্যের দাম চড়া। এর মধ্যে আবারও জ্বালানির দাম বাড়ায় জীবনযাত্রার ব্যয় আরও বাড়বে, সংসার চালানোই কঠিন হয়ে পড়বে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও বস্ত্রসহ মৌলিক চাহিদার বাজেট কাটছাঁট করে স্বল্প আয়ের মানুষ চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে পড়েছে। নতুন করে চাপ বাড়লে কোনোরকমে খেয়ে-পড়ে বেঁচে থাকাও কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে