শনিবার, ১২ অক্টোবর ২০২৪, ২৮ আশ্বিন ১৪৩১

সিলেটে পানিবন্দি পাঁচ লাখের বেশি মানুষ

কুশিয়ারার দুই মিটার ও সুরমার পানি বিপৎসীমার এক মিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে
সিলেট অফিস
  ০১ জুন ২০২৪, ০০:০০
সিলেটে পানিবন্দি পাঁচ লাখের বেশি মানুষ

সিলেটের বন্যাকবলিত বিভিন্ন এলাকা থেকে বন্যার পানি কমতে শুরু করেছে। শুক্রবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত জেলার সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর তিনটি পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হলেও সব কটি নদ-নদীর পানি কমেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নতুন করে বৃষ্টিপাত না হওয়া এবং আকাশে রোদ থাকায় বন্যার পানি কমছে। তবে গত দুইদিনে বেড়েছে পানিবন্দি মানুষের সংখ্যা। প্রশাসনের হিসাব অনুযায়ী, জেলার ১৩ উপজেলার মধ্যে বন্যাকবলিত ৭ উপজেলায় ৫ লাখ ৩৩ হাজারের বেশি মানুষ পানিবন্দি হয়েছেন। আর আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছেন ৪ হাজার ৮০২ জন। শুক্রবার সকাল পর্যন্ত পানিবন্দি ও আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নেওয়া মানুষের সংখ্যা বেড়েছে।

শুক্রবার দুপুরে পানি উন্নয়ন বোর্ড-পাউবো সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ বলেন, 'শুক্রবার সিলেটের গোয়াইনঘাট ও জৈন্তাপুর উপজেলার নদ-নদীর পানি বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে জকিগঞ্জে কুশিয়ারা নদীর পানি বিপৎসীমার দুই মিটার ও কানাইঘাটে সুরমা নদীর পানি বিপৎসীমার ১ মিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।'

ভারি বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ি ঢল না নামলে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হবে না জানিয়ে পাউবোর প্রকৌশলী আরও বলেন, 'কিছুদিনের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে। গত ২৪ ঘণ্টায় চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল ১৯৩ মিলিমিটার। আর এর আগের ২৪ ঘণ্টায় ভারতের মেঘালয় রাজ্যের চেরাপুঞ্জিতে ৬৩৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছিল।'

পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে, ঘূর্ণিঝড় রেমেলের প্রভাবে ভারতের মেঘালয় ও আসামের

পাহাড়ি এলাকায় টানা ভারীবর্ষণ হয়েছে। প্রবল বর্ষণের এই পানি নেমে আসায় সিলেটের গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ, জৈন্তাপুর, কানাইঘাট ও জকিগঞ্জে বন্যা দেখা দেয়। সুরমা, কুশিয়ারা, সারি, লোভা, ধলাই ও পিয়াইন নদীর বিভিন্ন স্থানে বেড়িবাঁধ ভেঙে ও উপচে ওই পাঁচ উপজেলার বিস্তীর্ণ জনপদ পস্নাবিত হয়। বৃহস্পতিবার কুশিয়ারা নদীর পানি উপচে বিয়ানীবাজার ও গোলাপগঞ্জ উপজেলা বন্যাকবলিত হয়ে পড়ে।

জেলা প্রশাসনের হিসাব অনুযায়ী, শুক্রবার পর্যন্ত সিলেটের ৭ উপজেলার ৫ লাখ ৩৩ হাজার ২০২ জন বন্যাকবলিত হয়েছেন। এর মধ্যে গোয়াইনঘাট উপজেলার ১৩ ইউনিয়নের ২ লাখ ৪৫ হাজার ৭৫০ জন, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ৩ ইউনিয়নের ৯৩ হাজার জন, কানাইঘাট উপজেলার ৯ ইউনিয়নের ৮০ হাজার ৬০০ জন, জৈন্তাপুরের ৩ ইউনিয়নের ৬৫ হাজার জন, জকিগঞ্জের ৮ ইউনিয়নের ৩৯ হাজার ৮৫২ জন, বিয়ানীবাজারের ৫ ইউনিয়নের ৫ হাজার ৫০০ জন ও গোলাপগঞ্জের ১ ইউনিয়নের ৩৫০০ জন।

স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ, জৈন্তাপুর, কানাইঘাট ও জকিগঞ্জ উপজেলায় পস্নাবিত গ্রামের সংখ্যা বেশি। এ পাঁচ উপজেলায় অন্তত ৭০০ গ্রাম এরই মধ্যে পস্নাবিত হয়েছে। এ ছাড়া বিয়ানীবাজার ও গোলাপগঞ্জ উপজেলার কিছু গ্রামও পস্নাবিত হয়েছে।

তবে নতুন করে বৃষ্টিপাত না হওয়া এবং আকাশে রোদ থাকায় বন্যায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত গোয়াইনঘাট উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় পানি কমতে শুরু করেছে। গত দুদিন ধরে পানিতে ডুবে থাকা গোয়াইনঘাট-সালুটিকর সড়ক এবং গোয়াইনঘাট-জাফলং সড়ক থেকে পানি নেমেছে। পানি নেমে যাওয়ার পর এ দুটি সড়কে বন্যার ক্ষত স্পষ্ট হয়েছে। সড়ক দুটোর কয়েকটি স্থানে খানাখন্দ আর গর্ত তৈরি হয়েছে। তবে উপজেলার রাধানগর-জাফলং সড়কের কিছু অংশে এখনো পানি আছে।

গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তৌহিদুল ইসলাম জানান, উপজেলার তিনটি নদীর পানি এখন বিপৎসীমার নিচে নেমে গেছে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক, কালভার্টগুলো মেরামত ও সংস্কার করে জনচলাচলে উপযোগী করতে এলজিইডি কর্তৃপক্ষকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বন্যাকবলিত মানুষের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম অব্যাহত আছে।

প্রশাসন সূত্র জানায়, জেলার ১৩ উপজেলায় ৫৪৭টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এতে আশ্রয় নিয়েছেন ৪ হাজার ৮০২ জন। এর মধ্যে জকিগঞ্জের ৫৫ আশ্রয়কেন্দ্রে ৯৫ জন, জৈন্তাপুরের ৪৮ আশ্রয়কেন্দ্রে ৬৭৫ জন, গোয়াইনঘাটে ৫৬ আশ্রয়কেন্দ্রে ২৩৫৬ জন, কানাইঘাটে ৩১ আশ্রয়কেন্দ্রে ১৪৬৬ জন, কোম্পানীগঞ্জে ৩৫ আশ্রয়কেন্দ্রে ১৩৫ জন, বিয়ানীবাজারের ৬৭ আশ্রয়কেন্দ্রে ৬০ জন এবং গোলাপগঞ্জের ৫৭ আশ্রয়কেন্দ্রে ১৫ জন আশ্রয় নিয়েছেন।

জেলা প্রশাসক শেখ রাসেল হাসান বলেন, 'পানিবন্দি পরিবারগুলোকে আশ্রয়কেন্দ্রে স্থানান্তরের চেষ্টা চলছে। সরকারি ও বেসরকারিভাবে শুকনা ও রান্না করা খাবার এবং বিশুদ্ধ পানি বিতরণ কার্যক্রম চলমান আছে। এ ছাড়া বন্যার্তদের স্বাস্থ্যসেবা দিতে ১৩১টি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে।'

শুক্রবার দুপুরে গোয়াইনঘাট উপজেলা সদরের বাসিন্দা ও বাজারের ব্যবসায়ী সোহাগ চক্রবর্তী জানান, বন্যার পানি আগের থেকে কমেছে। তবে উপজেলার রাস্তাঘাটে এখনও পানি রয়েছে। বাজারের পানি নেমেছে।

সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার বাসিন্দা ও স্থানীয় সংবাদকর্মী মো. রেজওয়ান করিম সাব্বির জানান, বন্যার পানি নামার পর শুক্রবার দুপুরে তিনি নিজের বাসাবাড়ি পরিষ্কার করেছেন।

তিনি বলেন, 'উপজেলার বিরাইমারা হাওড়, খারুবিল, শেওলারঢুপ, বাহনহাওড়, ঢুলটি, ডিবিরহাওড়, কেন্দ্রি, হারুবিলসহ নিম্নাঞ্চলে পানি রয়েছে। তবে আগের থেকে পানি কমেছে। রাস্তাঘাট এখনো পানিতে তলিয়ে আছে।'

গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. তৌহিদুল ইসলাম বলেন, 'গোয়াইনঘাটে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। উপজেলার তিনটি নদীর পানি বিপৎসীমার নিচে নেমেছে। আকস্মিক বন্যায় উপজেলার ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক ও ব্রিজ-কালভার্ট পরিদর্শন করা হয়েছে। এলজিইডি উপজেলা প্রকৌশলীকে ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তাঘাট ও ব্রিজ মেরামত ও সংস্কার করে যানবাহন ও জনচলাচল উপযোগী করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।'

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সিলেটের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ খয়ের উদ্দিন মোলস্না বলেন, 'বন্যায় কবলিত উপজেলাগুলোর কী পরিমাণ আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা পেতে একটু সময় লাগবে। পানি নেমে গেলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ সঠিকভাবে জানানো যাবে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, অতিবৃষ্টি ও ঢলের কারণে জেলার গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ, জৈন্তাপুর, কানাইঘাট ও জকিগঞ্জে মোট ৫ হাজার ৬০১ হেক্টর আউশ ধান, আউশ বীজতলা ও সবজি খেত কম বেশি পস্নাবিত হয়েছে। এর মধ্যে আউশ ধানের জমি রয়েছে ১ হাজার ৬৮২ হেক্টর। এ ছাড়া ৯২৭ হেক্টর আউশ বীজতলা ও ২ হাজার ৯৯২ হেক্টর সবজি খেত রয়েছে।

বন্যায় সিলেট জেলার রাস্তাঘাটের কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে জানতে চাইলে এলজিইডি সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী কে এম ফারুক হোসাইন বলেন, 'ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে উপজেলা প্রকৌশলীদের বলা হয়েছে। তবে বন্যার পানি সড়ক থেকে পুরোপুরি নামলে এটা পরিমাপ করা যাবে। পুরো তথ্য পেতে আরও কয়েকদিন সময় লাগবে।'

সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা-কর্মীর ছুটি বাতিল

আকস্মিক বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রস্তুতির অংশ হিসেবে সিলেটে সিটি করপোরেশনের সব কর্মকর্তা ও কর্মীর ছুটি বাতিল করা হয়েছে। সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা সাজলু লস্কর জানান, আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে শুকনো খাবার ও বিশুদ্ধ পানি এবং প্রাথমিক চিকিৎসা সামগ্রী পাঠানো শুরু হয়েছে। তাছাড়াও ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় উদ্ধার কাজের জন্য নৌকার ব্যবস্থা, বিদু্যৎ সরবরাহ স্বাভাবিক রাখাসহ জরুরি সেবার জন্য কন্ট্রোল রুম চালু করা হয়েছে।

পানির নিচে ফায়ার স্টেশন

সুরমা নদী উপচে পানি ঢুকে নগরীর তালতলা এলাকার সিলেট ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কার্যালয়ে পানি প্রবেশ করেছে। সেখান থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে মেশিনারিজ। এছাড়া, সুরমা তীরবর্তী বিভিন্ন আবাসিক এলাকাও পস্নাবিত হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, বৃহস্পতিবার রাত থেকে পানি উঠতে শুরু করে ফায়ার সার্ভিসের সিলেটের প্রধান এই স্টেশনে। ইতোমধ্যে বন্যার পানি ফায়ার সার্ভিসের ব্যারাকেও উঠে গেছে।

সিলেট ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন অফিসার মো. বেলাল হোসেন বলেন, 'বন্যার পানি ওঠার কারণে স্টেশন থেকে মেশিনারিজ ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের আলমপুর স্টেশনে নিয়ে রাখা হয়েছে। পানি আরও বাড়লে গাড়িগুলো অন্যত্র নিয়ে রাখতে হবে। সেই সঙ্গে কর্মীদের আপাতত সিলেট জেলা স্টেডিয়ামে অস্থায়ীভাবে থাকার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।'

সিলেট সিটি করপোরেশনের ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের অন্তর্গত ফায়ার সার্ভিসের মূল স্টেশন। ওই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শান্তনু দত্ত শন্তু বলেন, 'ফায়ার সার্ভিসের তালতলা স্টেশনটির পেছন দিয়ে বয়ে যাওয়া বৈঠাখাল ছড়াটি সরাসরি সুরমা নদীর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। সুরমা নদীর পানি বাড়ায় ফায়ার স্টেশনে পানি ওঠে। সুরমার পানি কমলে পানি নেমে যাবে। পানি বাড়লে ফায়ার সার্ভিস ব্যারাকসহ তালতলা এলাকা ডুবে যায়। এ অবস্থায় ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের যন্ত্রপাতি ও আবাসন স্থানান্তর ছাড়া বিকল্প উপায় নেই। তালতলা ফায়ার স্টেশন ছাড়াও নগরের বাগবাড়ী, উপশহর এলাকার নিম্নাচল পানি উঠতে শুরু করেছে।

শুক্রবার সরেজমিন সিলেট নগরীর জামতলা, তালতলা, তোপখানা, সোবহানীঘাটসহ কয়েকটি নিম্নাঞ্চলে পানি প্রবেশ করেছে।

সিলেট সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ বলছে, উজানের পানি নেমে আসায় নদীতে পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। যেখানে ছড়ার পানি নদীতে যাওয়ার কথা সেখানে নদীর পানি ছড়া উপচে নগরীর নিম্নাঞ্চল পস্নাবিত হচ্ছে।

দুর্গত এলাকা ঘোষণার দাবি

বন্যাকবলিত কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর ও কানাইঘাট উপজেলাকে বন্যাদুর্গত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করার দাবি জানিয়েছে একটি সংগঠন। জৈন্তা কেন্দ্রীয় পরিষদ নামের সংগঠনটি জেলা প্রশাসক শেখ রাসেল হাসানের কাছে এ বিষয়ে স্মারকলিপি দিয়েছে। বন্যাকবলিত এলাকায় পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী জরুরিভিত্তিতে সরবরাহের দাবিও জানানো হয়। স্মারকলিপি দেওয়ার সময় সংগঠনটির সভাপতি গিয়াস আহমেদ, সাধারণ সম্পাদক সালাউদ্দিন বেলাল, সাবেক সাধারণ সম্পাদক জামাল উদ্দিন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে