শনিবার, ১২ অক্টোবর ২০২৪, ২৮ আশ্বিন ১৪৩১
জনশক্তি রপ্তানির নামে মানব পাচার

অন্তরালে সক্রিয় মূল হোতারা

গাফফার খান চৌধুরী
  ০১ জুন ২০২৪, ০০:০০
অন্তরালে সক্রিয় মূল হোতারা

দেশের কিছু টু্যর অ্যান্ড ট্রাভেল এজেন্সি বেআইনিভাবে জনশক্তি রপ্তানির নামে মানব পাচারে জড়িত। অথচ এসব এজেন্সির বিরুদ্ধে তেমন কোনো আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। তাদের পরস্পর যোগসাজশে বছরের পর বছর ধরে চলছে এমন মানব পাচারের ঘটনা। এ ধরনের এজেন্সির প্রকৃত কার্যক্রমও জনসম্মুখে প্রকাশ করা হয় না। সেই সুযোগকেই কাজে লাগিয়ে জনশক্তি রপ্তানির নামে মানব পাচার করে ওই এজেন্সিগুলো হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। মূলত তদারকি ও সচেতনতার অভাবে মানব পাচারের ঘটনা বাড়ছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) মানব পাচার ও প্রতিরোধ সেল সূত্র বলছে, বর্তমানে মানব পাচার সংক্রান্ত তদন্তাধীন রয়েছে প্রায় ৭ হাজার মামলা। এসব মামলায় আসামির সংখ্যা প্রায় ৩৫ হাজার। আর মামলার অভিযোগ মোতাবেক পাচার হওয়া মানুষের সংখ্যা প্রায় ১১ হাজার। সব মামলার অভিযোগই মোটামুটি একই ধরনের।

প্রায় শতভাগ মামলার অভিযোগে বলা হয়েছে, টু্যর অ্যান্ড ট্রাভেল এজেন্সি লোভনীয় বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে প্রতারণার শিকার হয়েছেন মামলার বাদী বা তাদের আত্মীয় স্বজনরা। এজেন্সির স্থানীয় এজেন্টদের মাধ্যমে তারা বিদেশ যাওয়ার জন্য টাকা দিয়ে প্রতারিত হয়েছেন। ফাঁদে পড়া মানুষের অধিকাংশকেই বিদেশে ভালো বেতনে চাকরির প্রলোভন দেখিয়েছিলেন আসামিরা। সেই ফাঁদে পড়ে নিঃস্ব হয়েছেন মামলার বাদীসহ তাদের স্বজনরা।

সূত্রটি বলছে, সাধারণত ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ভালো বেতনে চাকরি দেওয়ার প্রলোভনে ফেলে বিদেশ পাঠায় প্রতারক চক্র। এরপর তাদের আকাশ, জল বা স্থলপথে লিবিয়া, মিয়ানমার, থ্যাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, ইরাক, ইরান, মালয়েশিয়া, ওমান, বাহরাইন, দুবাই, সিঙ্গাপুরসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নিয়ে যাওয়া হয়। এসব দেশে মানব পাচারকারী চক্রের সঙ্গে জড়িত বাংলাদেশি মানব পাচারকারী চক্রগুলো। বিদেশে যাওয়ার পর বাংলাদেশিদের বিভিন্ন দেশে থাকা গোপন আস্তানায় আটকে রাখা হয়। সেখানে তাদের ওপর চালানো হয় অমানুষিক নির্যাতন। সেই নির্যাতনের ভিডিও ধারণ করে বা সরাসরি মোবাইল ফোনে কল দিয়ে তাদের পরিবারকে দেখানো হয়। এরপর মোটা অঙ্কের টাকা মুক্তিপণ হিসাবে দাবি করে। আদায় করা টাকা দেশীয় এজেন্টের মাধ্যমে অথবা হুন্ডির মাধ্যমে বা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে পাঠানো হয়। পাচারকারীরা সন্তোষ্ট হলেই হয়তো কারও ভাগ্যে মুক্তি পেলে। আবার কারও ভাগ্যে নেমে আগে নির্মম নির্যাতন।

অনেকের পরিবারের কাছ থেকে মুক্তিপণ হিসাবে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করার পরেও তাদের হত্যা করে সাগরে ফেলে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। আবার অনেককে গণকবর দেওয়া হয়েছে। এমন ঘটনা ঘটেছে থাইল্যান্ডের গভীর জঙ্গলে। যেখানে বেশ কিছু গণকবর আবিষ্কৃত হওয়ার পর পুরো বিশ্বে মানব পাচারের বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসে।

সূত্রটি বলছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গড়ে উঠেছে আন্তর্জাতিক মানব পাচারকারী চক্র। চক্রের অধিকাংশ সদস্য বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, লিবিয়া, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া ও ইরানসহ বিভিন্ন দেশের নাগরিক। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী অন্তত ১২টি জেলায় মানব পাচারকারীরা বেশি সক্রিয়। তার মধ্যে কক্সবাজার অন্যতম। এছাড়া চট্টগ্রাম, রংপুর, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারি, নোয়াখালীসহ আশপাশের জেলাগুলোতেও তাদের তৎপরতা লক্ষ্যণীয়। সেসব এলাকার লোকজন তুলনামুলকভাবে কম শিক্ষিত বা অশিক্ষিত, বিদেশ সম্পর্কে তেমন ধারণা নেই সেসব এলাকায় বেশি সক্রিয় থাকে মানব পাচারকারী চক্রের সদস্যরা।

সিআইডি সূত্রে জানা গেছে, বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই বাংলাদেশের দূতাবাস বা চ্যান্সারি অফিস নেই। মানব পাচারকারীদের টার্গেট ওইসব দেশগুলো। দেশগুলোতে জনশক্তি রপ্তানির নামে ভ্রমণ ভিসায় বাংলাদেশের সহজ সরল মানুষকে পাঠায় অধিকাংশ টু্যর অ্যান্ড ট্রাভেল এজেন্সি। অথচ এসব এজেন্সি শুধুমাত্র কোনো দেশে ভ্রমণের জন্য লোক পাঠাতে পারে। আইনগতভাবে জনশক্তি রপ্তানি করতে পারে না। গ্রামের সহজ সরল মানুষ না বুঝেই এসব এজেন্সির লোভনীয় বিজ্ঞাপন দেখে পাচারের শিকার হন।

সূত্রটি বলছে, সম্প্রতি উজবেকিস্তান ও কিরগিস্তানে লোক পাঠানোর নামে মানব পাচার করার ঘটনা ব্যাপকভাবে আলোচনায় এসেছে। অনেকেই প্রতারিত হয়ে মামলা করেছেন। সেইসব মামলার তদন্তে বেরিয়ে আসছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। চলতি বছরের শুরুতেই ছয়জন বাংলাদেশিকে কিরগিজস্তানে পাঠায় ঢাকার নয়াপল্টনের 'জান্নাত ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল' নামের একটি এজেন্সি। ওই ছয় বাংলাদেশির প্রত্যেকের কাছ থেকে জনপ্রতি ৫ থেকে ৬ লাখ করে টাকা নেয় এজেন্সিটি।

সিআইডির অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার আজাদ রহমান যায়যায়দিনকে বলেন, 'মানব পাচারের অভিযোগে মামলার পর ঢাকার নয়াপল্টনের ওই এজেন্সির মালিক ইব্র্রাহিম মলিস্নক নাহিদ (৩৫), তার দুই সহযোগী শারমিন হোসেন লাবনী (৩৬) ও আরিফুর রহমান সাদীকে (২৪) গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তাররা পেশাদার মানব পাচারকারী চক্রের সদস্য।

সিআইডির মানব পাচার ও প্রতিরোধ সেলের অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার মো. শাহ্‌জাহান হোসেন যায়যায়দিনকে বলেন, শুধু কিরগিস্তানে নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এভাবেই এজেন্সিগুলো জনশক্তি রপ্তানির নামে মানব পাচার করছে। অথব এসব এজেন্সির বিষয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষের তেমন কোনো নজরদারি করার তথ্য পাওয়া যায়নি। নজরদারি না বাড়ানো হলে এজেন্সিগুলো মানব পাচার করতেই থাকবে।

সিআইডি সূত্রে জানা গেছে, মানব পাচার প্রতিরোধে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের নজরদারি বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। কারণ টু্যর অ্যান্ড ট্রাভেল এজেন্সির লাইসেন্স দিয়ে থাকে পর্যটন করপোরেশন। অথচ দেশে কি পরিমাণ এ ধরনের এজেন্সি আছে তার সুনির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। আর যেসব এজেন্সি বিদেশে জনশক্তি রপ্তানি করে থাকে, তার লাইসেন্স দিয়ে থাকে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও উন্নয়ন বু্যরো (বিএমইটি)। সংশ্লিষ্টদের তদারকির অভাবে দেশ থেকে মানব পাচার থামানো যাচ্ছে না।

সূত্রটি বলছে, জনশক্তি রপ্তানি কোম্পানির কাজ কি এবং টু্যর অ্যান্ড ট্রাভেল এজেন্সির কাজ কি তা জনসম্মুখে প্রচার করা জরুরি। মানুষকে কোনো এজেন্সির কি কাজ বা আইনগতভাবে কি কাজ করতে পারে, সে সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা সম্ভব হলে, দেশ থেকে মানব পাচার অনেকাংশে কমে যাবে। কারণ মানুষ এজেন্সির কর্মক্ষমতা সম্পর্কে জানতে পারবে। এজেন্সির আইনগত কর্মক্ষমতা সম্পর্কে না জানার কারণে অধিকাংশ মানব পাচারের ঘটনাগুলো ঘটছে। আর এজেন্সিগুলোও সেই সুযোগ নিচ্ছে।

মানব পাচারের বিষয়ে সিআইডি প্রধান পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ আলী মিয়া যায়যায়দিনকে বলেন, মানব পাচার কমিয়ে আনতে সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। যিনি বিদেশ যাবেন, তার অবশ্যই উচিত যেসব এজেন্সির মাধ্যমে বিদেশ যাচ্ছেন, তার বৈধতা আছে কিনা, তা যাচাই বাছাই করা বা জানা। এছাড়া ওই এজেন্সি টু্যর অ্যান্ড ট্রাভেল এজেন্সি নাকি জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান তা আগে নিশ্চিত হতে হবে।

তিনি আরও জানান, সহজ সরল মানুষদের বোকা বানিয়ে টু্যর অ্যান্ড ট্রাভেল এজেন্সির এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী বিদেশ জনশক্তি রপ্তানির নামে মানব পাচার করছে। এতে করে বিদেশে দেশের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হচ্ছে। পাচারকারী চক্র কাট আউট পদ্ধতিতে কাজ করে। যে কারণে মানব পাচারে জড়িত অধিকাংশ রাঘব বোয়ালদের সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রমাণের অভাবে আইনের আওতায় আনা সম্ভব হয় না। তবে মানব পাচারের ক্ষেত্রে সরকারের জিরো টলারেন্স নীতি অনুযায়ী কাজ করছে সিআইডি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে