শনিবার, ১২ অক্টোবর ২০২৪, ২৮ আশ্বিন ১৪৩১

বঙ্গবন্ধুর খুনি মোসলেমের সন্তানরা এনআইডিতে বাবার নাম পাল্টালেন কীভাবে, তদন্ত শুরু

যাযাদি রিপোর্ট
  ৩১ মে ২০২৪, ০০:০০
বঙ্গবন্ধুর খুনি মোসলেমের সন্তানরা এনআইডিতে বাবার নাম পাল্টালেন কীভাবে, তদন্ত শুরু

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যার পলাতক আসামি রিসালদার মোসলেম উদ্দিনের সন্তানরা কীভাবে জাতীয় পরিচয়পত্রে (এনআইডি) তাদের বাবার নাম পাল্টেছেন, সে বিষয়ে তদন্ত শুরু হয়েছে।

বুধবার জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালক মাহবুব আলম তালুকদার বলেন, সপ্তাহ দুয়েক আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের পাঠানো এ-সংক্রান্ত একটি চিঠি পেয়েছে ইসি। বঙ্গবন্ধুর খুনি এবং জেলহত্যা মামলার আসামি মোসলেম উদ্দিনের ছেলেমেয়েরা বাবার নাম বদলে এনআইডিতে মো. রফিকুল ইসলাম খান লিখিয়ে নিয়েছেন। কীভাবে এটা করা হলো, এর সঙ্গে কারা জড়িত, সেসব খুঁজে বের করতে কাজ শুরু হয়েছে। চিঠিতে তদন্ত শেষে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতেও ইসিকে অনুরোধ করেছে জননিরাপত্তা বিভাগ।

মাহবুব আলম বলেন, 'চিঠি পাওয়ার পর বিষয়টি খুব গুরুত্বসহকারে নিয়ে আমরা কাজ করছি। ইসির কর্মকর্তাদের নিয়ে তিন-চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে।'

শিগগির তদন্ত কাজ শেষ করে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন ইসির এই কর্মকর্তা।

তদন্তের তাগিদ : ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের মধ্যে ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত মোসলেম উদ্দিনসহ এখনো পলাতক পাঁচজন।

ইসিকে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে, মোসলেম উদ্দিনের ছয় ছেলেমেয়ে তাদের জাতীয় পরিচয়পত্রে বাবার নাম পরিবর্তন করে মো. রফিকুল ইসলাম খান বানিয়ে নিয়েছেন।

'ভুয়া' পরিচয়পত্র ব্যবহার করে মোসলেম উদ্দিনের তিন ছেলেমেয়ে পাসপোর্ট এবং এক ছেলে ড্রাইভিং লাইসেন্সেও তাদের বাবার নাম মো. রফিকুল ইসলাম খান অন্তর্ভুক্ত করেছেন।

এ অবস্থায় মোসলেমের সন্তানদের এনআইডি, পাসপোর্ট ও অন্যান্য ডেটাবেজে তাদের পিতার নাম বদলে নেওয়ার বিষয়টি রাষ্ট্রের জন্য হুমকিস্বরূপ।

যথাসময় তদন্ত শেষ হবে

মোসলেম উদ্দিনের নাম পাল্টানোর সঙ্গে জড়িতদের ধরতে মন্ত্রণালয় থেকে যেসব জায়গায় খোঁজ নেওয়া দরকার, সব জায়গায় তা নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন এনআইডি অনুবিভাগের মহাপরিচালক মাহবুব।

তিনি বলেন, 'তবে প্রাথমিক খোঁজ-খবর তো আমাদের ডেটাবেইজ থেকেই নিতে হবে। (পিতার নাম পাল্টে এনআইডি) সেটা অনেক আগে হয়েছে। কোথা থেকে কারা কাজটি করেছে, তদন্ত প্রতিবেদন পেলে তা বলা যাবে। এ জন্য অপেক্ষা করতে হবে।'

মোসলেমের সন্তানরা ভোটার হওয়ার সময় তাদের বাবার নাম বদলেছেন না কি এনআইডি করার পর তথ্য সংশোধনের সময় তা করেছেন, সেটি স্পষ্ট করেননি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

মাহবুব আলম বলেন, 'তদন্ত সম্পূর্ণ না হলে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট করে বলা যাচ্ছে না।'

সত্য উদ্ঘাটনে তদন্তে তাড়াহুড়া করতে চান না জানিয়ে তিনি বলেন, 'অতি তাড়াতাড়ি করতে গেলে মূল কাজের অন্তরায় হতে পারে। যথা সময় তদন্তটা শেষ হয়ে যাবে, আশা করি।'

মিথ্যা ও বিকৃত তথ্যে এনআইডি করার যে শাস্তি

২০১০ সালের জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইনের ১৪ ধারায় মিথ্যা তথ্য দেওয়ার অভিযোগ প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ এক বছরের কারাদন্ড এবং ২০ হাজার টাকা অর্থদন্ডের বিধান রয়েছে।

তথ্য-উপাত্ত বিকৃত বা বিনষ্ট করার দন্ডের বিষয়ে ১৬(১) ধারায় বলা হয়েছে, 'কমিশনের কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী অথবা এই আইন দ্বারা বা এর অধীন জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন কার্যক্রম পরিচালনা, পরিচয়পত্র প্রস্তুতকরণ, বিতরণ ও রক্ষণাবেক্ষণ-সংক্রান্ত দায়িত্ব পালনরত কোনো ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে কমিশনের কাছে সংরক্ষিত জাতীয় পরিচয়পত্র-সংক্রান্ত কোনো তথ্য-উপাত্ত বিকৃত বা বিনষ্ট করলে এই অপরাধের জন্য অনূর্ধ্ব সাত বছরের কারাদন্ড বা অনধিক এক লাখ টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডের বিধান রয়েছে।'

১৬(২) ধারা বলা আছে, 'কোনো ব্যক্তি অসৎ উদ্দেশ্যে জাতীয় পরিচয়পত্রে উলিস্নখিত কোনো তথ্য বিকৃত অথবা বিনষ্ট করিলে এই অপরাধের জন্য তিনি অনূর্ধ্ব দুই বছর কারাদন্ড বা অনধিক ৪০ হাজার টাকা অর্থদন্ড, বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবে।'

মোসলেম উদ্দিনের খোঁজ নেই

দুই দফায় ছয়জনের ফাঁসি কার্যকর হলেও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাকি পাঁচ খুনি এখনো রয়েছে অধরা। তারা হলেন- আব্দুর রশীদ, শরীফুল হক ডালিম, মোসলেম উদ্দিন, রাশেদ চৌধুরী ও এবিএমএইচ নূর চৌধুরী।

এর মধ্যে রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে এবং নূর চৌধুরী কানাডায় অবস্থান করছেন। বাংলাদেশের বারবার দাবির পরও তাদের ফেরত পাঠানো হয়নি।

বাকি তিনজনের কোনো খোঁজ এখন পর্যন্ত পায়নি সরকার কিংবা গোয়েন্দারা। মোসলেম উদ্দিন ভারতে আছেন বলে ২০২১ সালে দেশটির পত্রিকায় খবর এলেও এর 'সত্যতা নিশ্চিত' হতে পারেনি বাংলাদেশ সরকার।

১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফেরার পর ইতিহাসে চিহ্নিত কালো ওই অধ্যাদেশ বাতিলের পর জাতির পিতার খুনের বিচারের পথ খোলে।

এর মধ্যে বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সহকারী মহিতুল ইসলাম ধানমন্ডি থানায় একটি হত্যা মামলা করেন।

ওই মামলায় ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর ঢাকার তখনকার জেলা ও দায়রা জজ কাজী গোলাম রসুল ১৫ জন সাবেক সেনা কর্মকর্তাকে মৃতু্যদন্ড দেন।

আপিলের রায়ে এই ১৫ জনের মধ্যে তিনজন খালাস পান। যে ১২ জনের মৃতু্যদন্ড বহাল রাখে উচ্চ আদালত, তাদের একজন আজিজ পাশা পলাতক থাকা অবস্থায় দেশের বাইরে মারা যান বলে খবর আসে।

বাকি ১১ জনের মধ্যে সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশীদ, মহিউদ্দিন আহমদ, এ কে বজলুল হুদা এবং এ কে এম মহিউদ্দিন বন্দি অবস্থায় আদালতে রিভিউ আবেদন করলে তা খারিজ হয়ে যায়।

এরপর ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি ওই পাঁচজনের ফাঁসি কার্যকর হয় ঢাকার কারাগারে। বাকি ছয়জন পলাতক থেকে যান।

এর প্রায় ১০ বছর পর গত বছরের ৭ এপ্রিল ভোরে পলাতক ছয়জনের একজন ৭২ বছর বয়সি মাজেদকে ঢাকার গাবতলী থেকে গ্রেপ্তারের কথা জানায় সরকার।

তখন গোয়েন্দারা বলেছিলে, মাজেদ এতদিন ভারতের পশ্চিমবঙ্গে পালিয়েছিলেন, করোনাভাইরাস মহামারির সময় দেশে ফেরেন।

পলাতক মাজেদের আপিলের সুযোগ ছিল না। তবে রাষ্ট্রপতির কাছে তিনি প্রাণভিক্ষা চেয়ে আবেদন করেছিলেন। তা নাকচ হওয়ার পর কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ২০২০ সালের ১২ এপ্রিল তার ফাঁসি কার্যকর করা হয়।

তখনই কলকাতার দৈনিক আনন্দবাজারে খবর এসেছিল যে, পলাতক বাকি পাঁচজনের একজন রিসালদার মোসলেম উদ্দিন ভারতে গোয়েন্দাদের হাতে ধরা পড়েছেন।

ওই খবর পেয়ে নড়েচড়ে উঠেছিল বাংলাদেশ সরকার, ভারতের এনসিবির কাছে চিঠিও দেওয়া হয়েছিল। পরে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, প্রকাশিত খবরটি 'সত্য নয়'।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে