সিলেটের ৫ উপজেলায় বন্যা আশ্রয়কেন্দ্রে ছুটছেন মানুষ

দুর্যোগ মোকাবিলার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে :প্রশাসন তিস্তায় পানি বাড়ায় খুলে দেওয়া হলো জলকপাট

প্রকাশ | ৩১ মে ২০২৪, ০০:০০

সিলেট অফিস
ভারত থেকে আসা উজানের পানির ঢলে সিলেটের গোয়াইনঘাট সীমান্তবর্তী নয়াখেল এলাকার বাড়িঘর তলিয়ে গেছে। ছবিটি বৃহস্পতিবার তোলা -ফোকাস বাংলা
টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সিলেটে আকস্মিক বন্যা দেখা দিয়েছে। জেলার নদ-নদীর পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করে পাঁচ উপজেলার নিম্নাঞ্চল পস্নাবিত হওয়ার পাশাপাশি ডুবে গেছে রাস্তাঘাট। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন হাজারো মানুষ। এসব এলাকার বাসিন্দারা আশ্রয়কেন্দ্রে ছুটছেন। সড়ক ডুবে যাওয়ায় ব্যাহত হচ্ছে যান চলাচল। সিলেট জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. আবুল কুদ্দুস বুলবুল জানিয়েছেন, বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় জেলায় ৪৭০টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। ইতোমধ্যে বাসিন্দারা এখানে উঠতে শুরু করেছেন। সিলেটে গত কয়েক দিন ধরে বৃষ্টিপাত হচ্ছে। এর সঙ্গে মেঘালয় থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে তলিয়ে গেছে সিলেটের গোয়াইনঘাট, জকিগঞ্জ, কানাইঘাট, জৈন্তাপুর ও কোম্পানিগঞ্জ উপজেলার বেশ কিছু এলাকা। ওই সব এলাকার সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে। অনেকের ঘর-বাড়ি তলিয়ে গেছে। ভেসে গেছে গবাদি পশু ও পুকুর-খামারের মাছ। এ অবস্থায় দিশেহারা ও আতঙ্কিত হয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ছুটছেন বন্যা দুর্গত এলাকার মানুষজন। সিলেট আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ শাহ মোহাম্মদ সজিব হোসেন জানান, বৃহস্পতিবার সকাল ৬টা থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত জেলায় ৩৬ দশমিক ২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। আর মে মাসের ২৯ দিনে সিলেটে ৭০৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। ২০২৩ সালের মে মাসে ৩৩০ দশমিক ০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়। আগামী কয়েকদিন সিলেটে অস্থায়ী দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের ঝড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে বলেও জানান এই সহকারী আবহাওয়াবিদ। এদিকে সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী বৃহস্পতিবার সকাল ৯টায় সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলায় 'সারি নদীর' পানি একদিনে ২০২ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপৎসীমার ৯৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। 'সুরমা নদীর' পানি কানাইঘাট উপজেলা পয়েন্টে ১৯৬ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপৎসীমার ১৬৬ সেন্টিমিটার ওপরে এবং 'কুশিয়ারা নদীর' পানি জকিগঞ্জের অমলসীদ পয়েন্টে ২২০ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপৎসীমার ২০২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পাউবো সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ বলেন, 'নদ-নদীর পানি ক্রমেই বাড়ছে। জেলার অন্তত তিনটি পয়েন্টে নদ-নদীর পানি বিপৎসীমার ওপরে প্রবাহিত হচ্ছে। আরও কিছু পয়েন্টে পানি বিপৎসীমা ছুঁই ছুঁই করছে।' জেলার পাঁচ উপজেলার মধ্যে গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর ও কানাইঘাট উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতি সবচেয়ে 'খারাপ' উলেস্নখ করে সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোহাম্মদ মোবারক হোসাইন বলেন, 'সেনাবাহিনী ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। প্রয়োজনে তারাও উদ্ধার অভিযানে যোগ দিচ্ছেন। জেলা ও উপজেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির বৈঠক হয়েছে। উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে কন্ট্রোলরুম খোলা হয়েছে। বন্যা কবলিত মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসা হচ্ছে।' সিলেট জেলা প্রশাসন থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী ইতোমধ্যে বন্যাকবলিত পাঁচ উপজেলায় ১০০০ বস্তা শুকনো খাবার ও ৭৫ টন চাল বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া ২ লাখ ৫০ হাজার টাকার ত্রাণসামগ্রী উপজেলাগুলোতে বরাদ্দ প্রদান করা হয়েছে। গোয়াইনঘাট উপজেলা সদরের বাসিন্দা ও বাজারের ব্যবসায়ী সোহাগ চক্রবর্তী বলেন, 'বুধবার সন্ধ্যা ৭টার দিকে বাসাতে পানি প্রবেশ করেছিল। রাতে বাসার ভেতরে হাঁটু সমান পানি হয়েছিল; খুব কষ্টে রাত কাটিয়েছি। বৃহস্পতিবার বিকাল ৩টার দিকে বাসার পানি একটু কমেছে। তবে বাজারের পানি এখনো পুরো নামেনি; আমার দোকানেও পানি আছে।' গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. তৌহিদুল ইসলাম বলেন, 'উপজেলার ৭৫ ভাগ এলাকা পস্নাবিত হয়ে লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। জাফলং-বিছনাকান্দিসহ সব পর্যটন এলাকার পর্যটকবাহী নৌকা নিয়ে উদ্ধার অভিযান চলছে। এ উপজেলার ৫৬টি আশ্রয়কেন্দ্রে বুধবার রাতেই ১৬৭টি পরিবার আশ্রয় নিয়েছেন। বৃহস্পতিবার সকালে থেকে যা ২৫০-এ ছাড়িয়েছে। অনেক মানুষ নিজের বাড়িঘর ছেড়ে পাশের উঁচু বাড়িঘরে আশ্রয় নিয়েছেন।' ট্রাকে আশ্রয় চার পরিবারের বুধবার রাতে ঘরে পানি উঠে যাওয়ায় জৈন্তাপুরের বিরাইমারা গ্রামের চার পরিবারের ১৫ জন সদস্য রাস্তার পাশে দাঁড় করিয়ে রাখা একটি ট্রাকে আশ্রয় নেন। বৃহস্পতিবার সকালে দেখা যায় সিলেট-তামাবিল মহাসড়কের জৈন্তাপুরে রাস্তার পাশে ১০টি ট্রাক দাঁড় (পার্কিং) করিয়ে রাখা। এর মধ্যে একটি ট্রাকে শামিয়ানা টাঙানো। ওই ট্রাকে অবস্থান করছিলেন নারী-শিশুসহ ১৫ জন। ট্রাকের নিচে বাঁধা পাঁচটি ছাগল। পাশে বাঁধা রয়েছে একটি গরু। ট্রাক থেকে নেমে কিছু সময় পর পর রাস্তার পাশের পরিবেশ বোঝার চেষ্টা করছিলেন বড়রা। সঙ্গে ট্রাকের নিচে থাকা ছাগলগুলোকে খাবার দেওয়ার ব্যবস্থা করছিলেন। এর একটি ট্রাকে বুধবার রাতে আশ্রয় নেওয়া বিরাইমারা গ্রামের ওয়াহিদ মিয়া (৫৫) বলেন, 'ট্রাকে এখন পর্যন্ত তারা চার পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। বুধবার সন্ধ্যার পর থেকে ঘরে পানি উঠতে শুরু করেছিল। এরপর ভোর চারটার দিকে ঘরে আর থাকা যাচ্ছিল না। পরে গরু-ছাগলসহ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সিলেট-তামাবিল মহাসড়কে অবস্থান নেন। সেখানে একটি ট্রাকে রাতেই শামিয়ানা টাঙিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। এরপর আরও তিনটি পরিবার তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে।' একই গ্রামের কালু মিয়া (৪৮) বলেন, এমন পরিস্থিতি আগে হয়নি। হঠাৎ পানি বেড়ে গিয়েছিল। এরপর পরিবারের পাঁচ সদস্য নিয়ে সড়কেই রাত কাটিয়েছেন। সকালে ভাত রান্না করে সবাই কিছু কিছু খেয়েছেন। পানি না নামলে তাদের কী অবস্থা হবে, বুঝতে পারছেন না। ট্রাকে অবস্থান নেওয়া মরিয়ম বেগম (৪৫) বলেন, ঢলের পানিতে ঘরে থাকা হাঁস-মুরগি ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। জৈন্তাপুর উপজেলায় বন্যা কবলিতদের মাঝে ইতোমধ্যে ত্রাণ বিরতণ করা হয়েছে জানিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) উম্মে সালিক রুমাইয়া বলেন, 'পাহাড়ি ঢল ও টানা বৃষ্টিতে উপজেলার সব কটি ইউনিয়নে বন্যা হয়েছে। তবে সকালের তুলনায় দুপুরে পানি একটু কমেছে। আমরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি এবং নিম্নাঞ্চলের জনসাধারণ ও গবাদিপশু নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিতে বলা হয়েছে।' কানাইঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফারজানা নাসরিন বলেন, 'উপজেলা সদর, পৌরসভা ও ইউনিয়নগুলোতে বন্যা ছড়িয়ে পড়েছে। মানুষজন আশ্রয়কেন্দ্রে রয়েছেন। বন্যা দুর্গতদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ চলছে। প্রশাসন সতর্ক অবস্থানে রয়েছে।' তথ্য অনুযায়ী বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় নানা প্রস্তুতি নিয়েছে জেলা প্রশাসন। ইতোমধ্যে গোয়াইনঘাট, জকিগঞ্জ, জৈন্তাপুর, কানাইঘাট ও কোম্পানীগঞ্জ- এই ৫টি উপজেলায় মোট ২১৫টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এর মধ্যে গোয়াইনঘাটে ৫৬, জৈন্তাপুরে ৪৮, কানাইঘাটে ১৮, কোম্পানীগঞ্জে ৩৫ ও জকিগঞ্জে ৫৮টি। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে মঙ্গলবার বিকাল থেকে মানুষজন উঠতে শুরু করেছেন।