কাটেনি জলাবদ্ধতা, কমেনি ভোগান্তি

যেসব বাসা-বাড়িতে ময়লা পানি ঢুকে পড়েছে, তারা পড়েছেন সবচেয়ে বেশি বিপাকে। নোংরা পানির দুর্গন্ধে ঘরে থাকা দায় হয়ে পড়েছে। ঘরের আসবাবপত্র পানিতে ভিজে যাতে নষ্ট হয়ে না যায় সেজন্য তাদের নানা কসরত করতে হচ্ছে

প্রকাশ | ২৯ মে ২০২৪, ০০:০০

সাখাওয়াত হোসেন
রেমালের প্রভাবে গত দুই দিনের বৃষ্টিতে রাজধানীর সড়কগুলোয় মঙ্গলবারও জলাবদ্ধতা কমেনি। এতে চরম দুর্ভোগে পড়েন নগরবাসী। ছবিটি মতিঝিল নটর ডেম কলেজ সড়ক থেকে তোলা -ফোকাস বাংলা
দেশের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া প্রবল ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে ঝরা বৃষ্টি মঙ্গলবার সকালে পুরোপুরি থেমে গেলেও রাজধানী ঢাকার অনেক এলাকার জলাবদ্ধতা কাটেনি। বিশেষ করে নগরীর নিচু এলাকার অধিকাংশ রাস্তাঘাট এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত (মঙ্গলবার রাত ৮টা) হাঁটু থেকে কোমর পানিতে তলিয়ে আছে। অনেক ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে এক থেকে দেড় ফুট বৃষ্টির পানি জমেছিল। ফলে সেখানকার বাসিন্দাদের আগের দিনের মতোই মঙ্গলবারও চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। ঢাকার নিচু এলাকার স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, জলাবদ্ধতা না কাটায় সেখানকার কর্মজীবী মানুষকে বাসার সামনের রাস্তা পার হতে রিকশা-ভ্যান ব্যবহার করতে হচ্ছে। সুযোগ বুঝে এসব যানের চালকরা গলাকাটা ভাড়া আদায় করছেন। সামান্য দুই-তিনশ' গজ রাস্তা রিকশা-ভ্যানে পার হতে অনেককে ৫০ থেকে ৬০ টাকা গুনতে হয়েছে। এছাড়া ওইসব এলাকার যেসব বাসা-বাড়িতে ময়লা পানি ঢুকে পড়েছে, তারা পড়েছেন সবচেয়ে বেশি বিপাকে। নোংরা পানির দুর্গন্ধে ঘরে থাকা দায় হয়ে পড়েছে। ঘরের আসবাবপত্র পানিতে ভিজে যাতে নষ্ট হয়ে না যায় সেজন্য তাদের নানা কসরত করতে হচ্ছে। পাশাপাশি তাদের ঘরে রান্নাও বন্ধ হয়ে গেছে। উপায়ন্তর না দেখে অনেকে আশপাশের এলাকা কিংবা দূরে আত্মীয়-স্বজনের বাসায় আশ্রয় নিয়েছেন। এদিকে নিচু এলাকা অনেক দোকানে পানি ঢুকে পড়ায় নানা ধরনের মালামাল নষ্ট হয়েছে। এতে অনেক খুদে দোকানিকে পুঁজি হারিয়ে পথে বসতে হবে। ভাসানটেক এলাকার মুদি দোকানি আজমল জানান, বৃষ্টির পানিতে ভিজে তার প্রায় ২০ হাজার টাকার পণ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব জিনিস ১০ থেকে ১২ হাজার টাকায় বিক্রি হবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। এদিকে রাজধানীর মাতুয়াইল এলাকার বেশির ভাগ অংশ এখনো পানির নিচে। পানিবন্দি হয়ে আছে যাত্রাবাড়ী থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের উত্তর পাশের একটি রাস্তাও। জলাবদ্ধতা কাটেনি পার্শ্ববর্তী জনতাবাগ, মদিনাবাগ, রায়েরবাগ এলাকার রাস্তাঘাটেও। জলাবদ্ধতা রয়ে গেছে রাজধানীর রামপুরা ও বাড্ডা এলাকাতেও। মগবাজার, ইস্কাটন ও বেইলি রোড এলাকায় জলাবদ্ধতার চিত্র তেমন খারাপ না হলেও মালিবাগের বিভিন্ন সড়কে, বিশেষ করে মালিবাগ মোড় থেকে রাজারবাগ পুলিশ লাইনসের সামনের সড়কের বিভিন্ন অংশে এখনো পানি জমে রয়েছে। মিরপুর সড়কে নুরজাহান মার্কেট ও ধানমন্ডি হকার্স মার্কেটের সামনের মূল সড়কে \হপানি জমে থাকলেও পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। সরেজমিন রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, খিলগাঁও, গোড়ান, সিপাইবাগ, মধুবাগ, ভাটারা ও পুরান ঢাকার বেশ কিছু সড়কে কালো ময়লা পানি জমে আছে। কর্মস্থলগামী মানুষ ও শিক্ষার্থীরা অনেকে রিকশা-ভ্যানে এসব রাস্তা পার হচ্ছে। যাদের চড়া ভাড়া দেওয়ার সামর্থ্য নেই তারা হাঁটু পর্যন্ত প্যান্ট-পায়জামা গুটিয়ে কর্দমাক্ত পানি ভাঙছেন। বেশকিছু অভিভাবককে স্কুলগামী শিশু সন্তানকে কোলে করে এসব রাস্তা পার করিয়ে দিতে দেখা গেছে। নিউমার্কেট এবং মিরপুর সড়কে নুরজাহান মার্কেট ও ধানমন্ডি হকার্স মার্কেটের সামনের মূল সড়কে মঙ্গলবার দুপুরেও পানি জমে ছিল। এতে করে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন মার্কেটের দোকানি এবং এ সড়ক ব্যবহারকারী পথচারীরা। কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, রাতের বেলা পানির পরিমাণ আরও বেশি ছিল। সকালে কিছুটা কমেছে। মঙ্গলবার ওই এলাকার মার্কেটগুলোর সাপ্তাহিক ছুটি থাকলেও দোকানে পানি উঠে কিনা এমন শঙ্কায় অনেক দোকানি ভোরেই দোকানে এসেছে। রহমত আলী নামের এক ব্যবসায়ী জানান, বৃষ্টি হলে ধানমন্ডি হকার্স মার্কেট, নুরজাহান মার্কেটে পানি উঠে যায়। কারণ সড়কের চেয়ে এই মার্কেটের ফ্লোর খানিকটা নিচু। সেজন্য সব সময় তারা শঙ্কার মধ্যে থাকেন। রাতের বৃষ্টিতে বাইরের ফুটপাতে দোকানগুলোতে পানি উঠলেও মার্কেটের ভেতরে কোনো দোকান পানিতে ডোবেনি। ওই দোকানির ভাষ্য, এই এলাকার পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা খুবই নাজুক। যার কারণে ভারী বৃষ্টিপাত হলেই সড়ক ডুবে যায়। আর এ জলাবদ্ধতা বেশ খানিকটা দীর্ঘস্থায়ী হয়। এদিকে জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমির (নায়েম) পার্শ্ববর্তী আবাসিক এলাকার বাসিন্দারা ভয়াবহ বিপাকে পড়েছেন। এই এলাকাটির একমাত্র সড়কেই জমে আছে হাঁটু সমান পানি। এতে করে সেখানকার বাসিন্দা এবং জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমিতে প্রশিক্ষণ নিতে আসা বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাদের চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। হাঁটুপানি থাকায় রাস্তা দিয়ে হাঁটার উপায় নেই। বাধ্য হয়েই অনেকে রিকশায় ও ভ্যানগাড়িতে চড়ে গন্তব্য পৌঁছাচ্ছেন। নায়েমে প্রশিক্ষণ নিতে আসা নাম প্রকাশ অনিচ্ছুক বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের এক কর্মকর্তা বলেন, বৃষ্টি হলেই এখানে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়। অথচ এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কোনো নজর নেই। একটি দেশের জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমির সামনের সড়কের এমন বেহাল অবস্থা চিন্তা করা যায় না। পানি জমে থাকার কারণে সকালে স্কুল-কলেজে যেতে পারায় সেখানকার শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা অনেকে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। শিলা রহমান নামের এক শিক্ষার্থী বলেন, 'সকালে কলেজে যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে রাস্তায় বের হয়ে দেখি এই দুরাবস্থা। ওই সময় কোনো রিকশাও পাইনি। যে কারণে শেষ পর্যন্ত কলেজে যেতে পারিনি।' অনেকে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বছরের পর বছর ধরে এখানকার বাসিন্দারা এমন দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। অথচ নগর পিতার কথার ফুলঝুড়ি ছড়ালেও এদিকে তাদের কোনো নজর নেই। যাত্রাবাড়ী এলাকার বাসিন্দা মাহমুদা খাতুন জানান, টানা বর্ষণে তলিয়ে গেছে ওই এলাকার বেশির ভাগ রাস্তাঘাট। অনেকের বাড়িঘরে পানি ঢুকে গেছে। তারা অবর্ণনীয় কষ্টে দিনযাপন করছে। বেশিরভাগ ঘরে রান্নার চুলা জ্বলছে না। আশপাশের হোটেল থেকে তারা সকালের নাশতা কিংবা দুপুর ও রাতের খাবার কিনে খাবেন সে উপায়ও নেই। পূর্ব রামপুরার বেশকিছু এলাকায় মঙ্গলবার দুপুরেও জলাবদ্ধতা দেখা গেছে। অনেক দোকানপাটও ছিল জলমগ্ন। অনেক দোকানিকে দোকান থেকে পানিতে ভেজা মালামাল সরাতে দেখা গেছে। আবার কেউ কেউ দোকান থেকে বালতিতে ভরে পানি ফেলছেন। প্রগতি সরণি এলাকার বাসিন্দারা জানান, ওই এলাকার নদ্দা ও জোয়ার সাহারা বাজার দিয়ে ঢোকা দুই সড়কে সামান্য বৃষ্টিতে হাঁটুপানি জমে যায়। প্রগতি সরণিতেও পানি জমে। সোমবার রাত ১২টার দিকে ওই সড়কে হাঁটুপানি ছিল। মঙ্গলবার সকালেও সে পানি পুরোপুরি সরেনি। আশপাশের অনেক ভবনের নিচে পানি জমেছে। নিচু টিনশেড বাড়িগুলোর একাংশ পানির নিচে তলিয়ে যায়। এসব বাড়ির মানুষ খাটের ওপর বসে দিন কাটাচ্ছে। পানি যাতে খাটের ওপর উঠে না যায় এজন্য কিছুক্ষণ পরপর পানি সেচে তা কমিয়ে রাখার চেষ্টা চালান। ওই দুই সড়কসংলগ্ন প্রায় একডজন স্কুলের শিক্ষার্থীদের চরম ভোগান্তি পোহাতে দেখা গেছে। রিকশা না পেয়ে অনেক ছাত্রছাত্রী ময়লা পানি মাড়িয়ে স্কুলে যায়। কর্মস্থলগামী মানুষকেও একই ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। এদিকে রাজধানীর বেশকিছু নিচু এলাকার বাসাবাড়ির ভূগর্ভস্থ পানির ট্যাংকিতে নোংরা পানি ঢুকে পড়ায় সুপেয় পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। অনেকে দোকান থেকে বোতলের পানি কিনে এনে খাচ্ছেন। যাদের সে সামর্থ্য নেই তারা দূর থেকে কলসি, বালতি বা অন্য কোনো কন্টেইনারে পানি সংগ্রহ করছেন। ভাসনটেক এলাকা বাসিন্দা শহীদুলস্নাহ জানান, তার এবং তার আশপাশের বেশির ভাগ বাড়ির পানির রিজার্ভার ট্যাংকিতে রাস্তা থেকে ময়লা পানি এসেছে ঢুকেছে। অনেকের ট্যাংকি এখনো পানির নিচে তলিয়ে আছে। এগুলো পুরোপুরি পরিষ্কার ও বিশুদ্ধ না করে পানি সংরক্ষণ করা যাবে না।