১২ জেলায় ২২ জনের মৃতু্য

স্পষ্ট হচ্ছে রেমালের ক্ষত

পানিবন্দি লাখ লাখ মানুষ ভেসে গেছে হাজার কোটি টাকার মাছ সারাদেশে ৬১ কিমি বাঁধের ক্ষতি সুন্দরবন থেকে ৩০ মৃত হরিণ উদ্ধার

প্রকাশ | ২৯ মে ২০২৪, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
রেমালের তান্ডবে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে কুয়াকাটার জেলে পলস্নী -যাযাদি
একশ' কিলোমিটারের বেশি বাতাসের বেগ নিয়ে উপকূলে আঘাত হেনে ডাঙায় উঠে দুর্বল হয়েছে প্রবল ঘূর্ণিঝড় রেমাল। এর প্রভাবে মঙ্গলবারও দেশের বিভিন্ন এলাকায় বয়ে গেছে দমকা বাতাস। কোথাও কোথাও হয়েছে ভারী বর্ষণও। রোববার সন্ধ্যায় উপকূলে আঘাত হানার শুরু থেকে মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত দেশের ১২ জেলায় ২২ জনের প্রাণহানির কারণ হয়েছে রেমাল। রেমালের ছোবলের সঙ্গে সঙ্গে জলোচ্ছ্বাস আর ৫ থেকে ৭ ফুট উঁচু বানের তোড়ে ধসে পড়েছে অনেকের ঘর, গাছপালা ভেঙে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ঘরবাড়ি। নিচু এলাকার বাড়ি ডুবেছে পানিতে আর ভেসে গেছে মাছের ঘের। উপকূলজুড়ে ভেসে উঠতে শুরু করেছে ঝড়ের রেখে যাওয়া ক্ষত। ক্রমে প্রবল হয়ে ওঠা এই ঘূর্ণিঝড়ের তান্ডবে উপকূলের জেলাগুলো ছাড়াও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ জেলার শতাধিক উপজেলা। ঝড় উপকূল পার হওয়ার সময় জানমালের ব্যাপক ক্ষতি করে গেছে; জলোচ্ছ্বাসে পস্নাবিত হয়েছে বিস্তীর্ণ জনপদ। জোয়ারের সময় ঝড়ের তোপ বাড়িয়েছে ক্ষতি; উপকূলের একের পর এক এলাকায় বেড়িবাঁধ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে পস্নাবিত হয়েছে শত শত গ্রাম। সরকারি হিসাবেই ধ্বংস হয়েছে ৩৫ হাজার বাড়িঘর। এদিকে ঝড়ে ক্ষতির পাশাপাশি প্রায় দুই দিন থেকে ভোগান্তিও কম ছিল না উপকূলবাসীর। ঝড়ের কারণে বড় বিপর্যয় এড়াতে আগের দিনেই বিদু্যৎ বন্ধ রাখা হয়েছিল অনেক এলাকায়; অন্ধকারে ডুবে ছিলেন ৩০ লাখ গ্রাহকের পরিবার। ঝড় আঘাত হানার পর থেকে সোমবার রাত পর্যন্ত এ সংখ্যা বেড়ে হয় পৌনে তিন কোটি। বিদু্যৎহীন অবস্থা মঙ্গলবার সন্ধ্যা নাগাদও পুরোপুরি কাটেনি। আর বিদু্যৎহীনতার কারণে আস্তে আস্তে মোবাইল নেটওয়ার্কও বন্ধ হয়ে যায়। ঝড়ের আতঙ্কের মধ্যে স্বজনদের অবস্থা জানতে না পারার উৎকণ্ঠাও সঙ্গী হয়েছিল তাদের। সংবাদ সংগ্রহে ঢাকা থেকে উপকূলের সংবাদকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগেও বেগ পেতে হয়। বিদু্যৎহীনতার কারণে ইন্টারনেট-টেলিযোগাযোগ সেবায় নেমে এসেছে মহাবিপর্যয়। রেমালের দাপট দেখে বরগুনা সদরের নলটোনা গ্রামের সেলিম বলেন, 'বাপ-দাদার জায়গাজমি বাড়িঘর অনেক আগেই নদী ভাঙনে চইলস্না গ্যাছে। হ্যারপর কোনোভাবে একটা ঘর তুইলস্না পোলা-মাইয়া লইয়া আলস্নাম (বসবাস করেছি)। এইবারের বইন্নায় হেইডাও লইয়া গ্যাছে। এহন আলস্নাহ ছাড়া মোগো দ্যাহার কোনো উপায় নাই।' ১২ জেলায় ২২ জনের মৃতু্য রোববার ঘূর্ণিঝড় রেমালের আঘাতের শুরু থেকে মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত দেশের ১২ জেলায় ২০ জনের মৃতু্যর খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে সোমবার রাতে ঢাকায় বিদু্যৎস্পৃষ্ট হয়ে চারজনের মৃতু্য হয়েছে। এ ছাড়া বরিশালে তিন, পটুয়াখালী ও ভোলায় তিন, চট্টগ্রামে দুই, লালমনিরহাট, সাতক্ষীরা, কুমিলস্নায়, খুলনা, কুষ্টিয়া, বরগুনা এবং খাগড়াছড়িতে একজন করে মারা গেছেন। সারাদেশে ৬১ কিমি বাঁধের ক্ষতি: শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে রেমালের তান্ডবে বিধ্বস্ত হয়েছে দেশের উপকূলীয় ১৯ জেলা। দীর্ঘ ১৪ ঘণ্টার বেশি এ ঘূর্ণিঝড়ে দেড় লাখের বেশি বাড়িঘর সম্পূর্ণ ও আংশিক বিধ্বস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সাড়ে ৩৭ লাখ মানুষ। এ ছাড়া বসতবাড়ি, রাস্তায় উপড়ে পড়েছে গাছ। এ ছাড়া উপকূলের তিন জেলায় ৬১ কিলোমিটার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিছু এলাকায় পুরোপুরি এবং কিছু এলাকায় আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে বাঁধসংলগ্ন নিচু লোকালয়ে নোনা পানি প্রবেশ করেছে। এতে ভেসে গেছে হাজার বিঘার চিংড়িঘের। ব্যাপক ক্ষতি সুন্দরবনের প্রাণ-প্রকৃতির: ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে সুন্দরবনের প্রাণ-প্রকৃতির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে উলেস্নখ করে খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক (সিএফ) মিহির কুমার দো বলেন, বনের অভ্যন্তরে ২৫টি টহল ফাঁড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া উঁচু জোয়ারে বিস্তীর্ণ বনভূমি পস্নাবিত হয়েছে। সাগরের নোনাপানিতে বনভূমির সঙ্গে তলিয়ে গেছে ৮০টি মিঠাপানির পুকুর। পটুয়াখালীতে ক্ষতি ২৯ কোটি টাকা:ঘূর্ণিঝড় রেমালের তান্ডবে পটুয়াখালীতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এখনো পানিবন্দি হয়ে আছে কয়েক হাজার পরিবার। বাতাসের চাপ না থাকলেও উপকূলের আকাশ ঘন-কালো মেঘে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। অনেক স্থানে এখনো হালকা থেকে মাঝারি বৃষ্টিপাত হচ্ছে। জেলা প্রশাসনের প্রাথমিক তথ্যমতে, জেলায় ৩ হাজার ৫শ' কাঁচা ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে, হাজার হাজার গাছপালা উপড়ে পড়েছে। ৯ হাজার ১০৫ পুকুর, ৭৬৫টি মাছে ঘের এবং ১২০টি কাঁকড়া ঘের পস্নাবিত হয়েছে। এতে মৎস্যচাষিদের ১৩ কোটি ৩৩ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। সব মিলিয়ে জেলায় ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ ২৮ কোটি ৬৯ লাখ টাকা বলে জানিয়েছে জেলা ত্রাণ কর্মকর্তা। ভোলায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি: জেলায় ঘূর্ণিঝড় রেমালের তান্ডবে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বহু বাড়িঘর, কাঁচা-পাকা সড়ক, মাছের পুকুর, ঘের, গবাদি পশু, ক্ষেতের ফসলসহ প্রচুর গাছপালার ক্ষতি হয়েছে। অতি জোয়ারের পানিতে বন্দি হয়ে আছেন লক্ষাধিক মানুষ। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে মনপুরা উপজেলায়। ইতোমধ্যে স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে দুর্গতদের মধ্যে ত্রাণ সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে। জেলা প্রশাসক আরিফুজ্জামান মঙ্গলবার বলেন, প্রাথমিকভাবে ঘূর্ণিঝড়ে জেলায় সব মিলিয়ে ৭ হাজার ৪৬৫টি বাড়িঘর আংশিক ও সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে ৫ হাজার ঘরবাড়ি আংশিক ও ২ হাজার ৪৬৫টি সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পানিতে ভেসে গেছে ৫ হাজার ৮৬০টি পুকুর ও ৯৫০টি মৎস্য ঘের। ক্ষতি হয়েছে ১০ হাজার ৭৯১ হেক্টর জমির সবজি ও আউশ এবং বোরো ধানের ক্ষতি হয়েছে ১৪ হাজার ১০১ হেক্টর জমির। ৪৫ কিলোমিটার গ্রামীণ কাঁচা-পাকা সড়ক ক্ষতি হয়েছে। জেলা প্রশাসক বলেন, ঢালচর, চর কুকরিমুকরি, চরপাতিলা, চর নিজাম, মাঝেরচর, চর চটকিমারাসহ বিভিন্ন নিম্নাচল পস্নাবিত হয়েছে। যদিও ভাটার সময় পানি নেমে যায়। পানির চাপে সোমবার বিকালে মনপুরা উপজেলার সাকুচিয়া এবং হাজিরহাট পয়েন্টের বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করে। বাঁধের সংস্কার কাজ চলছে। তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত দুর্গত মানুষের জন্য ৩৭৫ টন চাল, ১৮ লাখ টাকা, শিশু খাদ্য, গো-খাদ্য বিতরণ করা হচ্ছে। ভোলা বিআইডবিস্নউটিএ'র সহকারী পরিচালক মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, আবহাওয়া পরিস্থিতি উন্নত হওয়ায় দুইদিন বন্ধ থাকার পর আজ দুপুর থেকে সব ধরনের নৌযান চলাচল শুরু হয়। এদিকে জেলায় ঘূর্ণিঝড় রেমালের তান্ডব শেষ হলেও এর প্রভাব রয়ে গেছে। সকাল থেকেই আকাশ কালো মেঘে ঢেকে রয়েছে। কখনো গুঁড়িগুঁড়ি আবার কখনো মুষলধারে বৃষ্টিপাত হচ্ছে। একই সঙ্গে থেমে থেমে বইছে ঝড়ো হাওয়া। সকাল থেকেই বিদু্যৎ ব্যবস্থা স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। মোবাইল ও ইন্টারনেট নেটওয়ার্ক গতি ফিরে পাচ্ছে। উত্তাল মেঘনা ও তেঁতুলিয়া নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। ইন্টারনেট-টেলিযোগাযোগ সেবায় মহাবিপর্যয়:ঘূর্ণিঝড় রেমালের তান্ডবে বিদু্যৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় দেশের অর্ধেকের বেশি মোবাইল নেটওয়ার্ক টাওয়ার বা সাইট অচল হয়ে আছে। মোবাইল নেটওয়ার্কের পাশাপাশি বিটিসিএল এবং আইএসপির গ্রাহকরা মোবাইল নেটওয়ার্কের সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন। মঙ্গলবার সকালে পস্ন্যাটফর্ম বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন (বিটিআরসি) জানিয়েছে, সারা দেশে মোট ৫৮ হাজার ২৯৮টি মোবাইল অপারেটরের টাওয়ারের মধ্যে ৩২ হাজার ৯০৬টি টাওয়ার অচল হয়ে আছে, যা শতকরা হিসাবে ৫৬ শতাংশ। বিটিআরসির ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড অপারেশনস বিভাগ জানিয়েছে, প্রায় সব ক্ষেত্রেই সাইট অচল হয়ে যাওয়ার কারণ হলো দীর্ঘ সময় বিদু্যৎ সংযোগ না থাকা। মোবাইল নেটওয়ার্কের পাশাপাশি ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের ক্ষেত্রেও সমস্যা দেখা দিয়েছে। বিটিআরসিতে আইএসপি অপারেটর দেওয়া তথ্যানুযায়ী, উপকূলীয় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় প্রায় তিন লাখ আই স্পিকার ফিক্সড ইন্টারনেট থেকে বঞ্চিত রয়েছে। উপকূল এলাকায় গাছপালা ভেঙে পড়া, বিদু্যৎ না থাকা এবং ঘূর্ণিঝড়ে ইন্টারনেট ক্যাবলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত জেলাগুলোর ১০০ ও বেশি আইএসপি অপারেটরের নেটওয়ার্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব জেলায় আইএসপি অপারেটরদের ৩২০টি পপের মধ্যে ২৫০টি অকার্যকর রয়েছে। যেসব এলাকায় বিদু্যৎ সরবরাহ বিচ্ছিন্ন রয়েছে সেসব জেলায় বিভিন্ন আইএসপি পপ পোর্টেবল জেনারেটর দিয়ে সেবা প্রধানের চেষ্টা করছে। এছাড়াও ঘূর্ণিঝড়ে বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন্স কোম্পানি লিমিটেডের (বিটিসিএল) ১৯টি, সামিট কমিউনিকেশন লিমিটেডের ২৯৬টি, ফাইবার এট হোমের ২৪টি সাইট অচল আছে। এদিকে বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশন বলছে, অপর্যাপ্ত ও মানহীন বিটিএস দিয়ে চলছে দেশের টেলিযোগাযোগ সেবা। এর ফলে বিদু্যৎ গেলেই থাকে না নেটওয়ার্ক। এতে গ্রাহক ভোগান্তি চরমে উঠেছে। সংগঠনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ জানান, দেশের টেলিযোগাযোগ ও ইন্টারনেট সেবায় গ্রাহকের চাহিদা উত্তরোত্তর বাড়ালেও মানহীন সেবা গ্রাহক ভোগান্তি চরমে পৌঁছেছে। আর এজন্য দায়ী অপর্যাপ্ত টাওয়ার, মানহীন মাইক্রোওয়েভ, মানহীন ব্যাটারি, ওভার হেড ফাইবার ও জেনারেটর না থাকা। তিনি আরও জানান, দেশে সক্রিয় সিমধারী গ্রাহকের সংখ্যা প্রায় ১৯ কোটি ২৬ লাখ অথচ এর বিপরীতে যেখানে টাওয়ার থাকার কথা প্রায় লক্ষাধিক সেখানে আছে ৪৫ হাজার ২৩১টি। এর মধ্যে রবির দুই হাজার ২৯৬, গ্রামীণফোনের ১২ হাজার ৫২৬, বাংলালিংকের চার হাজার ছয়টি, টেলিটকের ৬২১ এবং এবি হাইটেক কনসোর্টিয়াম লিমিটেডের ৮৬০, ইডটকো লিমিটেডের ১৬ হাজার ৬৮৩, সামিট চার হাজার ৩৮৮ ও কীর্তনখোলা ৬২১ এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বিটিসিএলের ৫১৪টি। আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো খবরে বিস্তারিত- খুলনার ৭৭ হাজার ৯০৪ বাড়িঘর বিধ্বস্ত প্রায়:খুলনা অফিস জানায়, ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে খুলনার দাকোপ, কয়রা ও পাইকগাছা উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে। ৬০টি পয়েন্টে বাঁধ ভেঙে ও উপচে জোয়ারের পানিতে তলিয়ে গেছে অসংখ্য গ্রাম। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন হাজার হাজার মানুষ। ঝড়ে প্রায় ৭৭ হাজার ৯০৪টি বাড়িঘর বিধ্বস্ত এবং ৪ লাখ ৫২ হাজার ২০০ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে খুলনার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. নাজমুল হুসেইন খান নিশ্চিত করেছেন। ১০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত:পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) খুলনা-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী আশরাফুল আলম বলেন, 'দাকোপের খলিশা, পানখালী, বটবুনিয়া ও কামিনিবাসিয়া এবং কয়রার দশালিয়া বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে। এই পাঁচটি জায়গা মিলে ১৫০ মিটারের মতো বাঁধ বিলীন হয়ে গেছে। দাকোপ, বটিয়াঘাটা, কয়রা ও পাইকগাছায় আরও ৬০টা পয়েন্টে পানি উপচে বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পাইকগাছায় অনেক জায়গায় ওভার ফ্লো হয়েছে। সব মিলিয়ে এরই মধ্যে ১০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।' ধ্বংসস্তূপ কুয়াকাটার জেলে পলস্নী:কুয়াকাটা প্রতিনিধি জানান, ঘূর্ণিঝড় রেমালের তান্ডবে টানা দুই দিনে ব্যাপক ক্ষতির শিকার হয়েছে পটুয়াখালীর কলাপাড়া। ঝড়ের তান্ডবে পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়েছে কুয়াকাটা পৌরসভার ১নং ওয়ার্ডের আশি ঘর কলোনি নামে পরিচিতি জেলে পলস্নীটি। এই পলস্নীর শতভাগ ঘরগুলো ঝড়ের তান্ডবে বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। অচল হয়ে পড়েছে প্রায় ২০০ মানুষের জনজীবন। জানা যায়, ২০০৭ সালের সিডরের পরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উদ্যোগে জেলেদের জন্য কুয়াকাটা পৌরসভার খাজুরা গ্রামে ৮০টি ঘর নির্মাণ করা হয়। সর্বশেষ ঘূর্ণিঝড় রেমালে আশ্রয়ণ প্রকল্পটির ৮০টি ঘরের শতভাগ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শিশুদের জন্য খাবার তৈরি করার মতো পরিবেশও নেই ওই বসতঘরগুলোতে। এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের সরকারি সাহায্য বা অনুদান পাননি তারা। চাঁদপুর শহর রক্ষা বাঁধের ১৬৫ মিটার ধস :চাঁদপুর প্রতিনিধি জানান, চাঁদপুর শহরের পুরান বাজার হরিসভা মন্দির ও বাকালি পট্টি এলাকাসহ শহররক্ষা বাঁধের ৮টি স্থানে অন্তত ১৬৫ মিটার সিসি বস্নক মেঘনা নদীতে দেবে গেছে। ভাঙন আতঙ্কে নদী তীরের অনেক লোকজন নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিয়েছেন। এখনো স্থানীয়দের মাঝে ব্যাপক আতঙ্ক বিরাজ করছে। এদিকে তাৎক্ষণিকভাবে পাউবো বালিভর্তি জিও টেক্সটাইল ব্যাগ ফেলে ভাঙন রোধে কাজ শুরু করে। ক্ষতিগ্রস্ত কার্তিক সাহা বলেন, 'বর্ষা আসলে প্রতি বছর নদীতে ভাঙন দেখা দেয়। ইেিতামধ্যে অনেকেই বসতভিটা হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ছে। ভাঙন দেখা দিলে কর্মকর্তারা আসেন নদীতে বালির বস্তা ফেলতে। আমরা স্থায়ী সমাধান চাই। যে পরিস্থিতি রাতে আমাদের বাড়িঘর টিকে কিনা আমরা খুব শঙ্কিত।' ভেসে গেছে অর্ধ লক্ষাধিক মাছের ঘের : বাগেরহাট প্রতিনিধি জানান, ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাব কাটিয়ে মঙ্গলবার সকালে রোদের দেখা মিলেছে। তবে বিদু্যৎবিহীন রয়েছে জেলার গ্রামীণ জনপদ। শহরাঞ্চলে সোমবার রাতের দিকে কিছু এলাকায় বিদু্যৎ সরবরাহ শুরু হলেও অনেক এলাকা ৪৮ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে বিদু্যৎবিহীন ছিল। ঘূর্ণিঝড়ে গাছপালা পড়ে সঞ্চালন লাইনের তার ছিঁড়ে ও বৈদু্যতিক খুঁটি উপড়ে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। দীর্ঘ সময় ধরে বিদু্যৎ না থাকায় মুঠোফোনসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় যোগাযোগ ব্যবস্থা সচল রাখতে পারছেন না দুর্যোগকবলিত এলাকার বাসিন্দারা। মঙ্গলবারও বিভিন্ন এলাকায় পানিবন্দি রয়েছেন হাজারও পরিবার। কিছু এলাকা থেকে পানি নেমে গেলেও ঘর থেকে রান্নার চুলা বেহাল অবস্থায় আছে। দ্রম্নত ব্যবস্থা না নিলে কিছু এলাকায় খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে বলে বলছেন স্থানীয়রা। কটকা থেকে ৩০ মৃত হরিণ উদ্ধার :এদিকে মঙ্গলবার সুন্দরবনের কটকা এলাকা থেকে ৩০টি মৃত হরিণ উদ্ধার করেছে বনবিভাগ। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত বনজুড়ে তলস্নাশি চালাচ্ছে বনরক্ষীরা। তাতে মৃত হরিণের সংখ্যা আরও বাড়বে বলে জানিয়েছে বনবিভাগ। এছাড়া ঝড়ে বনের অভ্যন্তরে ২৫টি টহল ফাঁড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বনের ভেতরে লবণ পানি ঢুকে নষ্ট হয়েছে অন্তত ৮০টি মিষ্টি পানির পুকুরও। খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক (সিএফ) মিহির কুমার দো জানান, রোববার বিকাল থেকে একটানা ২০ ঘণ্টা ঘূর্ণিঝড় রিমালের তান্ডব ও জলোচ্ছ্বাসে সুন্দরবনের প্রাণপ্রকৃতির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এতে বিশেষ করে বনের অনেক হরিণ মারা গেছে। এ পর্যন্ত বনের শুধু কটকা এলাকা থেকে ৩০টি মৃত হরিণ উদ্ধার করেছে বনবিভাগ। মৃত বন্যপ্রাণীর সন্ধানে বন জুড়ে বনরক্ষীদের তলস্নাশি চলছে। ঘূর্ণিঝড়ে সুন্দরবনের গাছপালারও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতি হয়েছে বনবিভাগের বিভিন্ন অফিসসহ টহল বোট, টিনের চালা, জানালা-দরজা, সোলার প্যানেল ও অবকাঠামোর। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে কটকা অভয়ারণ্যের অফিস ঘাটের জেটি ও পুকুর বঙ্গোপসাগরের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। দুবলা, কটকা, কচিখালি, বগি ও বিভিন্ন অফিসসহ ২৫টি টহলফাঁড়ির টিনের চালা উড়ে গেছে।