শনিবার, ০২ নভেম্বর ২০২৪, ১৭ কার্তিক ১৪৩১

রেমালের ছোবলে লন্ডভন্ড উপকূল

১২ জনের মৃতু্য হ ৩৫ হাজার ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত, বিদু্যৎ বিচ্ছিন্ন পৌনে ৩ কোটিরও বেশি গ্রাহক, পানিবন্দি লাখ লাখ মানুষ, মাছের ক্ষতি দেড়শ' কোটির বেশি
বিশেষ প্রতিনিধি
  ২৮ মে ২০২৪, ০০:০০
ঘূর্ণিঝড় রেমালের তান্ডবে পাবনায় উপড়ে পড়া গাছ অপসারণ করেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা -যাযাদি

প্রবল শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় রেমালের তান্ডবে দেশের উপকূলীয় এলাকায় ১২ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। তীব্র গতির বাতাস আর ভারী বর্ষণের কারণে উপকূলীয় এলাকার পৌনে তিন কোটিরও বেশি গ্রাহক বিদু্যৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। রেমালের তান্ডবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে উপকূলীয় ও আশপাশের ১৬ জেলার কাঁচা বাড়িঘর ও রাস্তাঘাট; ভেসে গেছে মাছের ঘের, আবাদি জমি। লবণ পানিতে তলিয়ে গেছে ফসলের মাঠ। গাছপালা ভেঙে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে উপকূলীয় জনপদ। ৮-১০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস ও উপকূলীয় রক্ষা বাঁধ ভেঙে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন বিভিন্ন জেলার লাখ লাখ মানুষ। সুন্দরবন পস্নাবিত হওয়ায় জীববৈচিত্র্যের ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এদিকে, রোববার গভীর রাত পর্যন্ত উপকূলে তান্ডব চালাতে চালাতে সোমবার সকালের দিকে স্থলভাগে উঠে আসার পর বৃষ্টি ঝরিয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছে প্রবল ?ঘূর্ণিঝড় রেমাল, পরিণত হয়েছে গভীর স্থল নিম্নচাপে। আবহাওয়া অফিসের তথ্যমতে, উত্তর দিকে অগ্রসর হয়ে গভীর স্থল নিম্নচাপটি সোমবার রাত ৮টার দিকে পাবনার সুজানগর উপজেলা ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থান করছিল। এটি আরও উত্তরপূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে শক্তি হারিয়ে স্থল নিম্নচাপে এবং পরে লঘুচাপে পরিণত হবে। একপর্যায়ে গুরুত্বহীন হয়ে পড়বে।

অন্যদিকে, রেমালের প্রভাবে সোমবার সকাল থেকেই রাজধানী ঢাকাসহ এর আশপাশের এলাকায় ঝড়ো হাওয়াসহ ভারী বর্ষণ শুরু হয়। সকাল থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত রাজধানীতে ১১৬ মিলিমিটার অতি ভারী বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। ঝড়ে গাছ ভেঙে পড়ার পাশাপাশি রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় পানিবন্দি হয়ে ভোগান্তিতে পড়তে হয় নগরবাসীকে।

সোমবার বিকালে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মহিববুর রহমান সংবাদ সম্মেলনে জানান, প্রবল ঘূর্ণিঝড় রেমালের আঘাতে দেশের উপকূলীয় ছয় জেলায় অন্তত ১০ জনের মৃতু্য হয়েছে। উপকূলীয় জেলাগুলোতে ৩৫ হাজারের বেশি ঘরবাড়ি পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়েছে। ঝড়ে উপকূলের ৩৭ লাখ ৫৮ হাজারের বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

তিনি বলেন, ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতির মুখে পড়েছে উপকূল ও আশপাশের ১৯ জেলা। এগুলো হলো- সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, বরিশাল, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, বরগুনা, ভোলা, ফেনী, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, লক্ষ্ণীপুর, চাঁদপুর, নড়াইল, গোপালগঞ্জ, শরীয়তপুর ও যশোর।

ঘূর্ণিঝড় রেমাল রোববার রাত ৮টার দিকে মোংলার দক্ষিণ-পশ্চিম দিক দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ উপকূল ও বাংলাদেশের খেপুপাড়া উপকূল অতিক্রম শুরু করে। রাত দেড়টা থেকে ২টার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১১১ কিলোমিটার গতিতে বাতাস বয়ে গেছে পটুয়াখালীর খেপুপাড়ায়। এই ঝড়ের প্রভাবে জলোচ্ছ্বাসে উপকূলের অনেক এলাকা পস্নাবিত হয়েছে। ভেসে গেছে বহু মাছের ঘের।

সংবাদ সম্মেলনে ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, ঘূর্ণিঝড়ে ১৯ জেলার আংশিকভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে এক লাখ ১৪ হাজার ৯৯২টি ঘরবাড়ি। ইতোমধ্যে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তার জন্য চয় কোটি ৮৫ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১৫টি জেলায় নগদ সহায়তার তিন কোটি ৮৫ লাখ টাকা, পাঁচ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন চাল, পাঁচ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার, শিশুখাদ্য কেনার জন্য এক কোটি ৫০ লাখ টাকা, গোখাদ্য কেনার জন্য এক কোটি ৫০ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে।

খুলনা জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. আব্দুল করিম জানান, খুলনায় ঘূর্ণিঝড় রেমালের আঘাতে ১৬৮ কোটি ৫৬ লাখ ৫০ হাজার

টাকার মৎস্য সম্পদ এবং ৭৬ হাজার ৯০৪টি ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রাথমিকভাবে যে ক্ষয়ক্ষতির পরিসংখ্যান পেয়েছি, এতে মোট ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা চার লাখ ৫২ হাজার ২০০ জন। ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৭৬ হাজার ৯০৪টি এবং মৎস্য সম্পদের ক্ষতির পরিমাণ ১৬৮ কোটি ৫৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা।

সাতক্ষীরার উপকূলীয় উপজেলা শ্যামনগর ও আশাশুনিতে জোয়ারের পানিতে বেড়িবাঁধ উপচে এবং প্রবল বর্ষণে শত শত মৎস্য ঘের পস্নাবিত হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ে উপকূলীয় এলাকার ৫৪১ কাঁচা ঘরবাড়ি ধসে গেছে। সাতক্ষীরা-মুন্সীগঞ্জ সড়কের একাধিক পয়েন্টে গাছপালা ভেঙে পড়ায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পরে পুলিশ ও স্থানীয় মানুষের সহায়তায় গাছপালা সরিয়ে যোগাযোগব্যবস্থা স্বাভাবিক করা হয়েছে। সাতক্ষীরায় বাঁধ ভেঙে ফসলি জমিতে লবণাক্ত পানি প্রবেশ করায় বড় ক্ষতি হিসেবে দেখছেন কৃষকরা।

গাবুরা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মাসুদুল আলম বলেন, ঘূর্ণিঝড় রেমাল সাতক্ষীরা উপকূলে ব্যাপক তান্ডব চালিয়েছে। রাত ১০টা থেকে ৩টা পর্যন্ত একটানা ঝড়বৃষ্টি হয়েছে। দেড় শতাধিক বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভেসে গেছে মাছের খামার। শত শত গাছ উপড়ে পড়েছে। বাঁধ উপচে লোকালয়ে লবণপানি প্রবেশ করেছে।

এদিকে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশে ঝড়ের আঘাতে বিদু্যতের তার ছিঁড়ে অন্তত চারজন নিহত হয়েছেন। এ নিয়ে ঘূর্ণিঝড় রেমালের আঘাতে প্রদেশে মৃতের সংখ্যা ছয়জনে পৌঁছেছে বলে জানিয়েছে সেখানকার স্থানীয় কর্তৃপক্ষ। প্রদেশের রাজধানী কলকাতায় কংক্রিটের নিচে চাপা পড়ে একজনের প্রাণহানি ঘটেছে। এ ছাড়া সুন্দরবন লাগোয়া মৌসুনি দ্বীপে একটি মাটির বাড়ি ধসে এক নারী নিহত হয়েছেন।

বিদু্যৎ বিচ্ছিন্ন ২ কোটির বেশি মানুষ

ঢাকায় বিদু্যৎ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেছেন, দুর্ঘটনা এড়াতে আগে থেকেই উপকূলীয় কিছু এলাকায় বিদু্যৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। অনেক উপকূলীয় শহরে গাছ পড়ে এবং বিদু্যতের লাইন ভেঙে যাওয়ায় বিদু্যৎ সরবরাহে বিঘ্ন ঘটছে।

দেশের উপকূলের বিভিন্ন এলাকায় দুই কোটি ২২ লাখ গ্রাহকের বিদু্যৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয় বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ পলস্নী বিদু্যতায়ন বোর্ড (বিআরইবি)। সংস্থাটি বলেছে, ঘূর্ণিঝড় রেমালের তান্ডবের সময় ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে এসব গ্রাহকের বিদু্যৎ সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়েছে। ফলে অনেক এলাকা ১৬-১৭ ঘণ্টা যাবত বিদু্যৎবিহীন রয়েছে।

অন্যদিকে, পশ্চিমবঙ্গ কর্তৃপক্ষ বলেছে, রেমালের আঘাতে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন এলাকায় এক হাজার ২০০টি বিদু্যতের খুঁটি উপড়ে পড়েছে। এ ছাড়া ঝড়ের তান্ডবে রাজ্যে তিন শতাধিক মাটির ঘর ধ্বংস হয়েছে। প্রচন্ড বাতাসের কারণে অনেকের বাড়িঘরের টিন ও খড়ের ঘরের চালও উড়ে গেছে। বৃষ্টি ও উঁচু জোয়ারের কারণে সুন্দরবনের কিছু বাঁধ এবং উপকূলীয় অঞ্চল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

আবহাওয়াবিদদের মতে, আজ মঙ্গলবার সারা দিনের আবহাওয়া পরিস্থিতি প্রায় অপরিবর্তিত থাকবে। রাজধানী ঢাকাসহ বেশ কিছু জেলায় বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। ঘূর্ণিঝড় রেমালের গভীর স্থল নিম্নচাপটি ভারী বৃষ্টি ঝরিয়ে দুর্বল হয়ে আজকের মধ্যে আসামের দিকে চলে যাবে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগ থেকে ঘূর্ণিঝড়ে ১২ জনের মৃতু্যর তথ্য জানানো হলেও ছয় জেলায় ১২ জনের মৃতু্যর খবর পাওয়া গেছে। রোববার দুপুর থেকে সোমবার দুপুরের মধ্যে পটুয়াখালী, সাতক্ষীরা, ভোলা, বরিশাল, খুলনা ও চট্টগ্রামে এসব মৃতু্য ঘটে।

এর মধ্যে পটুয়াখালীতে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি জোয়ারের মধ্যে ভেসে গিয়ে একজন এবং গাছ পড়ে দুইজন মারা গেছেন। সাতক্ষীরাতেও জলোচ্ছ্বাসে ভেসে একজনের মৃতু্য হয়েছে। বরিশালে ভবনের দেয়াল ধসে দুইজন, গাছচাপায় একজন মারা গেছেন। ভোলায় ঝড়ে ঘর ও গাছচাপা পড়ে প্রাণ গেছে তিনজনের। খুলনায় ঘরের ওপর গাছ পড়ে একজনের মৃতু্য হয়েছে। আর চট্টগ্রামে নির্মাণাধীন ভবনের দেয়াল ধসে এক পথচারী মারা গেছেন।

আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো খবরে বিস্তারিত-

চট্টগ্রাম বু্যরো জানান, নগরীর বায়েজিদ বোস্তামি থানার টেক্সটাইল এলাকার চন্দ্রনগর বেলতলায় একটি নির্মাণাধীন মাদ্রাসার দেয়াল ধসে সাইফুল ইসলাম হৃদয় (২৬) নামে এক যুবক মারা গেছেন। সোমবার সকাল সাড়ে ৭টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। নিহত সাইফুল ইসলাম নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের বাবুল মিয়ার ছেলে। তিনি নগরের তারা গেট এলাকায় একটি কার্টন ফ্যাক্টরিতে কর্মরত ছিলেন।

বায়েজিদ ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন অফিসার মো. কামরুজ্জামান জানান, সকাল সাড়ে ৭টার দিকে এ দুর্ঘটনা ঘটে। ফায়ার সার্ভিসের একটি টিম ঘটনাস্থলে কাজ করছে।

বায়েজিদ বোস্তামি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সঞ্জয় কুমার সিনহা বলেন, 'স্থানীয়দের দেওয়া তথ্যমতে, সকাল সাড়ে ৭টার দিকে নির্মাণাধীন মাদ্রাসার একটি দেয়াল ধসে সাইফুল ইসলাম নামে এক যুবক ঘটনাস্থলে মারা যায়। ফায়ার সার্ভিসের সহায়তায় মরদেহটি উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে। এ বিষয়ে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে