মরদেহ না পেলে আসন শূন্য ঘোষণায় জটিলতা

অপেক্ষা করবে সংসদ :স্পিকার

প্রকাশ | ২৭ মে ২০২৪, ০০:০০

যাযাদি রিপোর্ট
সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারের মরদেহের সন্ধান ১২ দিন পেরিয়ে গেলেও এখনো পাওয়া যায়নি। গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, ১৩ মে রাতে খুন করা হয় আনোয়ারুলকে। কলকাতা পুলিশ তার মরদেহ উদ্ধারে চেষ্টা চালাচ্ছে। তবে মৃতদেহ পাওয়া না গেলে সংসদে তার আসন শূন্য ঘোষণা নিয়ে জটিলতা দেখা দিতে পারে। এদিকে, জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী জানিয়েছেন, ঘটনাটি ব্যতিক্রম। অতীতে এ ধরনের ঘটনা ঘটেনি। এজন্য তারা আরও অপেক্ষা করবেন। অন্যদিকে, জাতীয় সংসদের পক্ষ থেকে আনোয়ারুল আজীমের আসনটি শূন্য ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশ করার কথা। নির্বাচন কমিশনেরও ৯০ দিনের মধ্যে উপনির্বাচন অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। আনোয়ারুল আজীম একাধারে সংসদ সদস্য ও পরিবহণ ব্যবসায়ী। তাঁর স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ও ব্যাংক হিসাব পরিচালনার জন্যও মৃতু্যর বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া জরুরি। ১২ মে চিকিৎসার জন্য ব্যক্তিগত সফরে ভারতে যান ঝিনাইদহ-৪ আসনের টানা তিনবারের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল \হআজীম (আনার)। ১৭ মে থেকে পরিবারের সঙ্গে তার যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। পরদিন তার নিখোঁজের বিষয়ে উত্তর কলকাতার বরানগর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন সেখানকার বন্ধু গোপাল বিশ্বাস। এরপর সংসদ সদস্যের মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস (ডরিন) ঢাকায় গোয়েন্দা সংস্থা ডিবির কাছে বাবার নিখোঁজের অভিযোগ দেন। গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, ১৩ মে রাতে খুন করা হয় আনোয়ারুল আজীমকে। কলকাতা পুলিশ তার মরদেহ উদ্ধারে চেষ্টা চালাচ্ছে। এর মধ্যে ১২ দিন পেরিয়ে গেলেও মৃতদেহ পাওয়া যায়নি। সাম্প্রতিক অতীতে ২০১৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর গাইবান্ধা-১ আসনের সংসদ সদস্য মঞ্জুরুল ইসলাম (লিটন) নিজ বাড়িতে খুন হন। এরও আগে আহসান উলস্নাহ মাস্টার সংসদ সদস্য থাকা অবস্থায় খুন হন। তবে তাদের মরদেহ নিয়ে অনিশ্চয়তা ছিল না। ফলে মৃতু্যর পরপর সংসদ সচিবালয় আসন শূন্য ঘোষণা করে উপনির্বাচনের ব্যবস্থা করে। এদিকে, সংসদ সদস্য মারা গেলে কিংবা অনুমতি ছাড়া ৯০ কার্যদিবস সংসদের বৈঠকে অনুপস্থিত থাকলে পদ শূন্য ঘোষণা করে সংসদ সচিবালয়। এ-সংক্রান্ত গেজেট প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশনকে জানায় সংসদ। নির্বাচন কমিশন ৯০ দিনের মধ্যে উপনির্বাচনের আয়োজন করে। সাধারণত কোনো সংসদ সদস্যের মৃতু্যর এক সপ্তাহের মধ্যেই আসন শূন্য ঘোষণা করা হয়। সংসদ সদস্য মারা গেলে স্পিকার শোক প্রস্তাব গ্রহণ করেন। সংসদের অধিবেশন চলাকালে কেউ মারা গেলে ওই দিনের জন্য অধিবেশন মুলতবি করার রেওয়াজ আছে। সংসদ বিষয়ক গবেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক নিজাম উদ্দিন আহমদ বলেন, এভাবে কোনো সংসদ সদস্যের মৃতু্য অতীতে ঘটেনি। সাধারণত কারও মৃতু্যর ক্ষেত্রে মৃতু্য সনদ দেওয়া হয়। এখানে কীভাবে তা করা হবে সেটা এখনো পরিষ্কার নয়। মরদেহ বা দেহবশেষ না পেয়ে মৃতু্য সনদ দেওয়া হলে আইনি প্রশ্ন ওঠার সুযোগ থাকে। তবে এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্র মৃতু্যর কথা নিশ্চিত করছে। আসন শূন্য ঘোষণা করতে অসুবিধা হবে না বলে তিনি মনে করেন। সম্পদ ও উত্তরাধিকার: ২০০৯ সালে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন আনোয়ারুল। এরপর ২০১৪ সালের নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন নিয়ে প্রথমবার সংসদ সদস্য হন আনোয়ারুল। সেই থেকে টানা তিনবার তিনি ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া আনোয়ারুল আজীমের হলফনামা অনুসারে, তার পেশা ব্যবসা ও কৃষি। সংশ্লিষ্ট নানা সূত্রে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সংসদ সদস্যের পরিবহণ ব্যবসা রয়েছে। ডরিন পরিবহণ নামে বাস যশোর-খুলনা রুটে চলাচল করে। তবে নির্বাচন কমিশনে দেওয়া হলফনামায় তার বা পরিবারের সদস্যদের বাসের মালিকানার কোনো তথ্য উলেস্নখ করা হয়নি। তবে চারটি ট্রাকের মালিক তার স্ত্রী বলে হলফনামায় উলেস্নখ করা হয়েছে। আনোয়ারুল আজীম পরিবহণ মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ মালিক সমিতির সহসভাপতি। এই সমিতির সভাপতি জাতীয় পার্টির বহিষ্কৃত নেতা মসিউর রহমান এবং মহাসচিব ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি খন্দকার এনায়েত উল্যাহ। আনোয়ারুল কালীগঞ্জে উপজেলা মোটর মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদকও ছিলেন। পরিবহণ খাতের সূত্রগুলো বলছে, ওই অঞ্চলের পরিবহণ ব্যবসায় তার বেশ শক্ত নিয়ন্ত্রণ ছিল। হলফনামা অনুসারে, সংসদ সদস্য এবং তার স্ত্রীর নগদ টাকা আছে ১ কোটি ৬০ লাখ টাকার মতো। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা প্রায় ১ কোটি ২৮ লাখ টাকা। নিজের একটি গাড়ি ও স্ত্রীর নামে চারটি ট্রাক রয়েছে। স্থাবর সম্পদের মধ্যে আনোয়ারুল আজীমের নিজের নামে ৩৩ বিঘা কৃষিজমি রয়েছে। যার মূল্য প্রায় ৪৩ লাখ টাকা। তার স্ত্রীর নামে আছে সাড়ে ২৪ শতাংশ কৃষিজমি। সংসদ সদস্যের অকৃষি জমির পরিমাণ ১২৯ শতাংশ। স্ত্রীর রয়েছে ১৭৯ শতাংশ। দুজনের অকৃষি জমির মূল্য দেখিয়েছেন ৮২ লাখ টাকার বেশি। কালীগঞ্জ পৌর এলাকায় তার একটি চারতলা বাড়ি রয়েছে। জনতা ব্যাংক কালীগঞ্জ শাখায় ১ কোটি ১৭ লাখ টাকার মতো ঋণ থাকার কথা হলফনামায় উলেস্নখ আছে। হলফনামা অনুসারে, আনোয়ারুল আজীমের বিরুদ্ধে অতীতে হত্যা ও চোরাচালানসহ ২১টি মামলা ছিল। এর সব কটি থেকেই তিনি অব্যাহতি কিংবা খালাস পেয়েছেন। আনোয়ারুল কৃষি খাত থেকে বছরে দুই লাখ টাকার মতো আয় করেন। ব্যবসা থেকে তিনি ও তার পরিবারের সদস্যরা প্রায় ৩৮ লাখ টাকা বছরে আয় করেন। আর সংসদ সদস্য হিসেবে বেতন ও ভাতা পান বছরে প্রায় ২৪ লাখ টাকা। সংসদ সদস্যের স্ত্রী ও দুই মেয়ে রয়েছে। আনুষ্ঠানিকভাবে কাউকে মৃত ঘোষণা না করা হলে সম্পদের উত্তরাধিকার নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়। আর নিখোঁজ হলে অন্তত সাত বছর পর্যন্ত উত্তরাধিকাররা সম্পদের মালিকানা পান না। বিশিষ্ট আইনজীবী শাহদীন মালিক এ বিষয়ে বলেন, এর আগেও সংসদ সদস্য খুন হওয়ার ঘটনা আছে। তবে লাশ না পাওয়ার বিষয়টি নতুন। আসন শূন্য ঘোষণা কিংবা মৃতু্য নিশ্চিত করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সংসদ সচিবালয়কে অবহিত করতে পারে। সংসদ সচিবালয়ও জানতে চাইতে পারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে। এর বাইরে সংসদ সচিবালয় ও নির্বাচন কমিশনের নিশ্চিত হওয়ার সুযোগ নেই। আর মৃতু্য নিশ্চিত হলে উত্তরাধিকার প্রশ্নেও ঝামেলা হবে না। অপেক্ষা করবে সংসদ :স্পিকার এদিকে, ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার ভারতে হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, তবে তার লাশ এখনো পাওয়া যায়নি। হত্যাকান্ডের ঘটনাস্থল ভারতের সরকার বা বাংলাদেশ থেকেও ওই সংসদ সদস্যের মৃতু্যর বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়নি। এ অবস্থায় ওই সংসদীয় আসনটি শূন্য ঘোষণার বিষয়ে অপেক্ষা করছে সংসদ সচিবালয়। তার মৃতু্যর বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত হলে সংসদ থেকে ওই আসনটি শূন্য ঘোষণা করা হবে। এ বিষয়ে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছেন, ঘটনাটি ব্যতিক্রম। অতীতে এ ধরনের ঘটনা ঘটেনি। এজন্য তারা আরও অপেক্ষা করবেন। আগামী ৫ জুন অনুষ্ঠেয় সংসদের তৃতীয় অধিবেশনের আগেই একটি সুরাহা হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। তিনি আরও বলেন, এ বিষয়ে আমরা এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেব না। আমরা আরও অপেক্ষা করব। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ ঘটনা খুবই ব্যতিক্রম। আগে এ ধরনের ঘটনা কখনই ঘটেনি। আমাদের সামনে কোনো নজির নেই। কার্যপ্রণালি বিধিতেও এ বিষয়ে কোনো নির্দেশনা নেই। এটা তো অনুমাননির্ভর। আনার বিষয়ে স্পিকার আরও বলেন, এখানে সমস্যা হচ্ছে তার দেহ পাওয়া যায়নি। তাই এখনও আমরা অপেক্ষা করছি। আমাদের কোনো একটা নির্ভরযো?গ্য সূত্র থেকে জানতে হবে। সেটা হয়তো উনার মৃতু্যসনদ বা কোনো কাগজ আমাদের কাছে আসতে হবে যেখানে প্রমাণ হবে উনি মারা গেছেন। না হলে আমরা কীভাবে বুঝব উনি মারা গেছেন? সেটার প্রমাণটা কী? সেটা আসতে হবে। শুধু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা গণমাধ্যমের প্রতিবেদনের ওপর নির্ভর করে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। আনাররের আসন নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা চলছে, আলোচনা চলছে জানিয়ে তিনি বলেন, অতীতের কোনো ঘটনা সঙ্গে মেলাব না। তাই এখনো আমরা অপেক্ষা করছি। আশা করি ফয়সালা হবে। সবকিছু নির্ভর করছে উনি মারা গেছেন এ তথ্যটা সংসদের কাছে কোনো নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে আসতে হবে। আগামী ৫ জুন সংসদ অধিবেশনের আগে কার্য?উপদেষ্টা কমিটির বৈঠক হবে, সেখানে এ বিষয়ে আলোচনা করবেন বলেও স্পিকার জানান। ওই বৈঠকে কমিটির সদস্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উপস্থিত থাকবেন। বাজেট অধিবেশন শুরুর আগেই বিষয়টি স্পষ্ট হওয়া যাবে বলেও আশা করেন তিনি।