ডায়রিয়া চিকিৎসায় ব্যয় বাড়ছে

রোটাভাইরাসের টিকা পাচ্ছে না শিশুরা

প্রকাশ | ২৭ মে ২০২৪, ০০:০০

পাঠান সোহাগ
বগুড়ার বাসিন্দা কায়সার মন্ডল। তার এক বছর বয়সি একমাত্র মেয়ে নাহিদা নাছিয়ার ১১ মাসে তিন বার পাতলা পায়খানা (ডায়রিয়া) হয়েছে। প্রথমবার সাত দিন পর মেয়ে মুখ তুলে তাকায়। তারপর থেকে ডায়রিয়ার টিকা খোঁজ করতে থাকেন তিনি। কিন্তু বগুড়ার কোথাও এ টিকা পাননি। তিনি বলেন, 'আমার বাচ্চার প্রখমবার ডায়রিয়ার আমার পকেটে থেকে ৩৫ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। আলস্নাহ্‌ও কাছে শুকরিয়া তিনি আমার মেয়েকে ফিরিয়ে দিয়েছেন। এরপর থেকে চিকিৎসকের পরামর্শে রোটা ভাইরাসের টিকা খুঁজছি। কত জায়গায় গেলাম, কোথায়ও এ টিকা পেলাম না।' ময়মনসিংহের ভালুকার আরিফ মিয়ার আট মাস বয়সি ছেলে আলিফ ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হলে ঢাকার একটি প্রাইভেট হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়। চিকিৎসায় ভালো হলে ছেলেকে রোটা ভাইরাসের টিকা 'রোটারিক্স' দেওয়ার জন্য নগরীর বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরছেন। কিন্তু টিকা পাননি। আরিফ মিয়া জানান, চার দিনের ছেলের জন্য চিকিৎসা বিল দিয়েছি ৪৮ হাজার টাকা। শুধু কায়সার মন্ডল কিংবা আরিফ মিয়া নন, তাদের মতো শত শত মানুষ এই টিকা খুঁজছেন, কিন্তু কোথাও পাচ্ছেন না। তথ্য বলছে, রোটাভাইরাস প্রতিরোধে 'রোটারিক্স' ভ্যাকসিনটি শিশুদের দেওয়া হতো। এ টিকা দেশে গস্ন্যাক্সো স্মিথ ক্লাইন (জিএসকে) সাপস্নাই দিত। তারা এক সময় বাংলাদেশে টিকা দেওয়ার কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। এর কোনো বিকল্প টিকা না থাকায় হেলথকেয়ারের একটি ভ্যাকসিন বের করার উদ্যোগ নেয়। কিন্তু সেটাও আলোর মুখ দেখেনি। এ কারণে দেশে এখন রোটাভাইরাস প্রতিরোধের কোনো ভ্যাকসিন নেই। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেছেন, রোটাভাইরাসের ইনফেকশন হলে ডায়রিয়া হয়। এতে প্রতিকার পেতে চাইলে রোটারিক্স দিতে হয়। এই ভ্যাকসিন শিশুদের ইমিউনিটি সিস্টেম ডেভেলপ করে। এখন এই টিকার সংকট চলছে। শুধু রোটা ভাইরাসের ভ্যাকসিন নয়, সব ধরনের ভ্যাকসিনের সংকট বাজারে। এতে রোগীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। টিকা দেওয়ার পর ডায়রিয়া হলেও ক্ষতির পরিমাণ কমে। এমনকি হামপাতালে চিকিৎসা খরচও কম হয়। বাংলাদেশ শিশু হাসপাতালের রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. কামরুজামান বলেন, 'এ টিকা সরকারিভাবে এখনো দেওয়া শুরু হয়নি। তবে প্রাইভেট ব্যবস্থাপনায় রোটা ভাইরাসের টিকা বাজারে পাওয়া যায়। তবে সবসময় সব জায়গায় পাওয়া যায় না। ইউনিসেফের তথ্য দিয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, দেশে শূন্য থেকে ১৭ বছর বয়সি শিশুর সংখ্যা ৫ কোটি ৬৯ লাখ। যা মোট জনসংখ্যার ৩৩ শতাংশ। এর মধ্যে শূন্য থেকে ১১ মাস বয়সের নবজাতক শিশু আছে ৩৪ লাখ। শূন্য থেকে ৫ বছরের নিচে শিশু আছে ১ কোটি ৬৩ লাখ। অর্থাৎ শূন্য থেকে ৫ বছরের নিচে দেশে শিশু আছে প্রায় ২ কোটি। সব বয়সি মানুষের মধ্যে প্রতি লাখে একাধিক বার ডায়রিয়ায় আক্রান্তসহ ৭৬২ জন মানুষ কোনো না কোনো ধরনের ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হন। পাশাপাশি একই বয়সের শিশু আক্রান্ত হয় প্রতি লাখে ২৭০ জনের কম। সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ন্যাশনাল হেলথ ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট সেন্টার ১৯৯৮ সাল থেকে সারা দেশে ডায়রিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা ও মৃতু্যর হিসাব সংরক্ষণ করে আসছে। তাদের দেওয়া তথ্যমতে, ডায়রিয়ার কারণে দেশে মৃতু্য অনেক কমেছে। তবে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে। ১৯৯৮ সালে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিল ২০ লাখ ৫৮ হাজার ৪১৭ জন। মারা গিয়েছিল ২ হাজার ৩২৭ জন। ২০১৬ সালে আক্রান্ত হয় ২৪ লাখ ৯ হাজার ২৯৪ হাজার। মৃতু্য হয় মাত্র পাঁচজনের। এ প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা মো. মামুন বলেন, '২০২৩ সালে আক্রান্ত হয় ১৯ লাখ ৫৯ হাজার ৮৪৮ হাজার। মৃতু্য হয় ১২ জনের। ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত গত চার মাসে ৬ লাখ ৫৩ হাজার ৪২৬ জন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়। তবে এ সময়ে কেউ মারা যায়নি।' দেশে সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির (ইপিআই) তথ্যমতে, ২০১১ থেকে ২০১৬ সালে বহু-বার্ষিক পরিকল্পনার অধীনে, ২০১৪ সালের শেষ নাগাদ রোটাভাইরাস ভ্যাকসিন দেওয়ার কথা ছিল। পাশাপাশি এ কর্মসূচির বাইরে ব্যক্তিগতভাবে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় টিকা কেনার সুযোগ ছিল। ভ্যাকসিন ব্যবস্থাপনার বৈশ্বিক জোট গেস্নাবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিন ইনিশিয়েটিভের (গ্যাভি) অর্থায়নে ভারত থেকে টিকা নেওয়ার কথা ছিল। এ টিকার দুই ডোজ বিতরণে খরচ পড়ত ২ ডলারের সমপরিমাণ টাকা। সব কিছু ঠিক থাকার পরও ২০১৮ সালে গ্যাভি কোনো কারণে আর অর্থায়ন করেনি। তারপর এ টিকা দেশে আসেনি। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) প্রতিষ্ঠার শুরু থেকে ডায়রিয়া নিয়ে গবেষণা করছে। এ প্রতিষ্ঠানে এক গবেষণায় দেখা গেছে, রোটাভাইরাসের সংক্রমণে যে সবল শিশুদের ডায়রিয়া হচ্ছে, তাদের ৬৫ শতাংশ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছে। বাকি ৩৫ শতাংশ রোগী বাহির থেকে চিকিৎসারসবা পেয়েছে। রোটাভাইরাস রোগের চিকিৎসায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে গড় খরচ ছিল ৮৪ ডলার বা ১০ হাজার টাকার বেশি। সরকারি হাসপাতালে এ খরচ সরকার ও রোগীর পরিবার বহন করেন। একইভাবে সরকারি হাসপাতালের বাইরে চিকিৎসা করাতে সব খরচ রোগীর পরিবারকে বহন করতে হয়। আইসিডিডিআর,বি'র ওই গবেষণায় দেখা গেছে, যদি প্রত্যেক শিশুকে রোটাভাইরাসের টিকা দেওয়া হয় তাহলে দেশে প্রতি বছরে ডায়রিয়া থেকে ২ হাজার ৫০০ শিশুর মৃতু্য কমবে। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, এ প্রতিষ্ঠানটি প্রতি বছর এক লাখের কম বেশি ডায়রিয়া রোগীকে বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা দিয়ে আসছে। আইসিডিডিআর,বি ঢাকা হাসপাতালের প্রধান ডা. বাহারুল আলম যায়যায়দিনকে বলেন, 'রোটাভারাসের কারণে সাধারণত ডায়রিয়া হয়ে থাকে। শীতকালে রোটাভাইরাস শিশুদের বেশি আক্রান্ত করে। আর গ্রীষ্মকালে এ ভাইরাস তরুণ ও বয়স্কদের আক্রান্ত করে।' আইসিডিডিআর,বি জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী ডা. রাশেদুল হক যায়যায়দিনকে বলেন, 'রোটাভাইরাসের কারণে ডায়রিয়ার সংক্রমণ বাড়ে। তখন মৃতু্যর ঝুঁকি বাড়ে। টিকা দিলে ঝুঁকিটা কমে যায়।'