এমপি আনার হত্যাকান্ড

খুনিচক্রের স্বীকারোক্তি প্রমাণে 'গলদঘর্ম' গোয়েন্দারা

প্রকাশ | ২৭ মে ২০২৪, ০০:০০

সাখাওয়াত হোসেন
আনোয়ারুল আজীম আনার
ঝিনাইদহ-৪ আসনের এমপি আনোয়ারুল আজীম আনার কিলিং মিশনের অন্যতম চার সদস্য বাংলাদেশ ও ভারতের গোয়েন্দাদের হাতে ধরা পড়ার পর নৃশংস এ খুনের লোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছে। এমপি আজীমকে শ্বাসরোধে হত্যার পর কীভাবে শরীর থেকে মস্তক বিচ্ছিন্ন করা হয়, কীভাবে চাকু দিয়ে চামড়া ছাড়িয়ে লাশ টুকরো টুকরো করা হয়, আর কীভাবে ট্রলিতে ভরে কোথায় ফেলা হয়- সে ব্যাপারে ব্যাপক তথ্য দিয়েছে তারা। তবে তাদের এ স্বীকারোক্তি অনুযায়ী প্রমাণ সংগ্রহ করতে মাঠে নেমে গলদঘর্ম হয়েছে গোয়েন্দারা। তদন্তে সংশ্লিষ্ট ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিবি) ও ভারতীয় সিআইডি সূত্র জানায়, এমপি আজীমের কিলিং মিশনে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তারকৃতরা গোয়েন্দা জিজ্ঞাসাবাদে খুনের কথা স্বীকার করলেও তার লাশের খন্ডিত কোনো অংশ এখনো উদ্ধার না হওয়ায় এ হত্যাকান্ড আইন-আদালতে প্রমাণ করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। যা গোয়েন্দাদের চরম বিপাকে ফেলেছে। গোয়েন্দাদের ভাষ্য, কলকাতার নিউটাউনের সঞ্জীবা গার্ডেন নামের যে অ্যাপার্টমেন্টে এমপি আজিম খুন হয়েছেন, সেখানে কয়েক জায়গায় রক্তের দাগ পাওয়া গেছে। এ রক্ত এমপি আজীমের ফরেনসিক পরীক্ষায় যদি নিশ্চিত হওয়াও যায়, তাতে তিনি খুন হয়েছেন তা প্রমাণ করা যাবে না। কেননা, তার শরীরের কোনো অংশ কেটে রক্তপাত হতে পারে। এতে তিনি মারা না-ও যেতে পারেন। এছাড়া সঞ্জীবা গার্ডেনের সিসি ফুটেজে ট্রলি নিয়ে সন্দেহভাজন দুই খুনিকে বের হতে দেখা গেলেও এর ভেতরে এমপি আজিমের লাশের খন্ডিত অংশ ছিল তা প্রমাণ করা কঠিন। এ প্রসঙ্গে গোয়েন্দা পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, সন্দেহভাজন খুনিদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এমপি আজীমের খুনের বিষয়টি আদালতে প্রমাণ করা দুষ্কর। তাই তারা কংক্রিট কোনো প্রমাণ খুঁজে বের করতে আদা-জল খেয়ে নেমেছেন। এদিকে সন্দেহভাজন খুনিরা ধরা পড়ার পর লম্বা সময় পেরোলেও খুনিদের দেওয়া লোমহর্ষক বর্ণনা অনুযায়ী এমপি আজীমের মৃত দেহ টুকরো টুকরো করার কাজে ব্যবহৃত চাপাতি, ছুরি-চাকু বা ধারালো কোনো অস্ত্র এখনো উদ্ধার করা যায়নি। সন্দেহভাজন খুনিদের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, তার মৃত দেহের টুকরো অংশ বিভিন্ন খালে বা জঙ্গলে ফেলে দেওয়ার পর তা ভেসে যাওয়া কিংবা জলজ প্রাণী খেয়ে ফেলার কথা বলা গেলেও হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত ধারালো অস্ত্রের ব্যাপারে এ ধরনের যুক্তি দাঁড় করানো অবাস্তবিক। তদন্তে সংশ্লিষ্ট ভারতীয় গোয়েন্দাদের বরাত দিয়ে সেখানকার গণমাধ্যম কর্মীরা জানান, হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত চাপাতি-চাকু-ছুরি নিয়ে গ্রেপ্তারকৃত কসাই জিহাদ যে তথ্য দিয়েছে, তার সত্যতা এখনো তারা মেলাতে পারেনি। এদিকে এমপি আজীম খুনে গ্রেপ্তারকৃত সন্দেহভাজন কিলারদের দেওয়া তথ্যের সঙ্গে উপযুক্ত প্রমাণ না মেলাতে পেরে গোয়েন্দারা এ বিষয়টিকে নতুনভাবে পর্যালোচনার চিন্তা-ভাবনা করছে। তাদের ধারণা, গ্রেপ্তারকৃত দুর্ধর্ষ কিলাররা তাদের 'মিসগাইড' করতে বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে মূল ঘটনাকে আড়াল করার অপতৎপতা চালাতে পারে। তাই শুধু এদিকে দৃষ্টি না রেখে অন্য কীভাবে এ হত্যাকান্ডের প্রমাণ সংগ্রহ করা যায় সে বিষয়ে নতুন কৌশল গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অন্যদিকে এমপি আজীম খুনের মাষ্টারমাইন্ড আকতারুজ্জামান এবং কিলিং মিশনে সরাসরি অংশ নেওয়া সিয়াম, ফয়জল এবং মুস্তাফিজুরকে ধরতে গোয়েন্দা তৎপরতা সর্বোচ্চ পর্যায়ে বাড়ানো হয়েছে। গোয়েন্দাদের ধারণা, তাদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হলে নতুন আরও তথ্য পাওয়া যাবে। যা দিয়ে এমপি আজীমের খুনের প্রমাণ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। এদিকে এমপি আজীমের খুনের তদন্তে রোববার কলকাতায় পৌঁছেছেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের তিন সদস্যের একটি দল। দলটির নেতৃত্বে রয়েছেন ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ। অন্য দুই সদস্য হলেন- ওয়ারী বিভাগের ডিসি মুহাম্মদ আব্দুল আহাদ ও এডিসি শাহীদুর রহমান। রোববার সকাল ১০টায় ইউএস বাংলার একটি ফ্লাইটে কলকাতার উদ্দেশে রওনা দেয় প্রতিনিধি দলটি। বাংলাদেশ সময় বেলা ১১টায় তারা কলকাতায় পৌঁছান তারা। ভারতের নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছেই সাংবাদিকের মুখোমুখি হন ডিবি প্রধান হারুন অর রশীদ। তিনি বলেন, 'হত্যা মামলার তদন্ত ও ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আমরা পশ্চিমবঙ্গে এসেছি। আমাদের কাজ হচ্ছে অপরাধ যেখান থেকে শুরু হয়েছে এবং যেখানে শেষ হয়েছে- ক্রিমিনাল প্রসিডিওর অনুযায়ী দুটি স্থানই পরিদর্শন করব। গ্রেপ্তারকৃত আসামিদের কাছ থেকে আমরা অনেক তথ্য পেয়েছি। কলকাতা পুলিশ এবং বাংলাদেশ পুলিশ অনেক তথ্য আদান-প্রদান করেছে এই মামলার তদন্ত সংক্রান্ত। আমরা মামলার তদন্ত কাজের জন্য কলকাতা পুলিশের কাছে সহযোগিতা চাইব। হত্যাকারীদের সঠিক মোটিভ কী ছিল সেটা আমরা জানার চেষ্টা করব।' সাংবাদিকদের অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'বাংলাদেশে যে তিনজন গ্রেপ্তার হয়েছে তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে কলকাতার পুলিশ। আমরাও কলকাতায় যে একজন গ্রেপ্তার হয়েছে, তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে চাইব।' হত্যাকান্ডের বিষয়ে জানতে চাইলে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, বাংলাদেশের একজন সংসদ সদস্যকে হত্যা করে ভারতের মাটিতেই কোথাও ফেলে দেওয়া হয়েছে। মরদেহ খুঁজে পাওয়ার ব্যাপারে আশা প্রকাশ করে হারুন অর রশিদ বলেন, পশ্চিমবঙ্গের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সিআইডি অনেক কাজ করছে, অনেক দূর এগিয়েছে। আমরা আশা করি, খুব শিগগিরই এ সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যাবে। ভারতে গ্রেপ্তার জিহাদকে জিজ্ঞাসাবাদের পাশাপাশি ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও তদন্তে পাওয়া তথ্য বিনিময় করবে দুই দেশের নিরাপত্তা বাহিনী। ভারতের সিআইডির হাতে গ্রেপ্তার হওয়া জিহাদকে বাংলাদেশে নিয়ে যাওয়া হবে কিনা সে ব্যাপারে ডিবি প্রধান হারুন জানান 'যদি এক দেশ হতো সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের আসামি এবং এখানকার আসামিকে মুখোমুখি বসিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারতাম। কিন্তু যেহেতু দুটি দেশ ভিন্ন, তাই হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে আমরা বিভিন্ন কথা বলেছি। কিন্তু এক্ষেত্রে দুই দেশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে আমরা পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেব।' আখতারুজ্জামানকে দেশে ফেরানো নিয়ে হারুন-অর-রশিদ বলেন, 'এই হত্যাকান্ডের মাস্টারমাইন্ড, পরিকল্পনাকারী আখতারুজ্জামান এই ঘটনা বাস্তবায়নের ভার আমানুলস্নাকে দিয়ে গত ১০ মে বাংলাদেশে ফিরে যায়। এরপর নেপাল-দুবাই হয়ে হয়তোবা যুক্তরাষ্ট্রে চলে গেছে। বাংলাদেশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছি। ইন্টারপোলের সঙ্গে কথা বলে তাকে কীভাবে দেশে আনা যায়, সে ব্যাপারে আলোচনা চলছে।' এদিকে রিমান্ডের তৃতীয় দিনে আমানুলস্নাহ ও শিলাস্তিসহ গ্রেপ্তারকৃত তিনজনই বেশকিছু নতুন তথ্য দিয়েছে। যা গোয়েন্দারা নানাভাবে ক্রসচেক করে দেখছেন। পাশাপাশি তাদের দেওয়া পৃথক তথ্য সমন্বয় করে এমপি আজীমের খুনের বিষয়টি নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া চেষ্টা চলছে। গোয়েন্দা পুলিশের একজন তদন্তকারী কর্মকর্তা বলেন, কিলারদের হাতে খুন হওয়া এমপি আজীমের লাশ পাওয়া না গেলে এ হত্যাকান্ড নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করা কঠিন হবে এটি সত্য। যদিও তা একেবারে অসম্ভব নয়। এর আগেও বিভিন্ন সময় খুন হওয়া ব্যক্তির লাশ পাওয়া যায়নি। তবে পারিপার্শ্বিক আলামত দিয়ে আইন আদালতে ওইসব হত্যাকান্ড প্রমাণ করা গেছে।