এলোমেলো সিদ্ধান্তে হযবরল দশা

ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা

প্রকাশ | ২৬ মে ২০২৪, ০০:০০

সাখাওয়াত হোসেন
ব্যাটারিচালিক রিকশা চলাচলের ব্যাপারে শুরুতেই পরিকল্পিত পদক্ষেপ না নিয়ে বিভিন্ন সময় এলোমেলো সিদ্ধান্ত নেওয়ায় এ খাতে হযবরল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। দুর্বল কাঠামোর দ্রম্নতগতির এ যান চলাচল বন্ধে সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রীর কঠোর নির্দেশনার মাত্র ছয় দিনের মাথায় মালিক-চালকদের সহিংস আন্দোলনের মুখে সরকারকে ফের পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে। যদিও সেতুমন্ত্রী জানিয়েছেন, স্বল্প আয়ের মানুষের কষ্টের কথা বিবেচনা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শুধু ঢাকা শহরে ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচলের অনুমতি দিয়েছেন। তবে পরিবহণ সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, উত্তাল পরিস্থিতি সামাল দিতে তড়িঘড়ি করে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও অনিয়ন্ত্রিত এ খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা কঠিন হবে। কেননা চট্টগ্রামসহ অন্য মহানগর ও জেলা-উপজেলা সড়কে ব্যাটারিচালিত রিকশা চলবে কিনা ওই নির্দেশনায় তা স্পষ্ট করা হয়নি। এছাড়া ঢাকা শহরে ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচলের অনুমতি দেওয়া হলেও তা কি শুধু অলিগলিতে চলবে, নাকি প্রধান সড়কেও দাপিয়ে বেড়াবে তা-ও স্পষ্ট নয়। ফলে ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল নিয়ে পুরনো জটিলতা রয়েই যাবে। বরং তা নতুন করে আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তারা। পরিবহণ খাত পর্যবেক্ষকরা জানান, ঢাকাসহ সারাদেশে প্রায় ৪০ লাখ ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল করছে, যা কিনতে এরই মধ্যে নিম্নআয়ের মানুষ তাদের সারা জীবনের সঞ্চয় ভেঙে কিংবা চড়া সুদে এনজিও বা আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে ৩২ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। এসব রিকশা তৈরির কারখানা ও বৈদু্যতিক চার্জ দেওয়ার ব্যবস্থাসহ আনুষঙ্গিক বিভিন্ন কাজে বিনিয়োগকৃত পুঁজির পরিমাণ কয়েক হাজার কোটি টাকা। এ অবস্থায় ব্যাটারিচালিত রিকশা তুলে দেওয়া হলে এ খাতে লগ্নিকৃত পুরো টাকাই গচ্চা যাবে। এছাড়া মালিক-চালকসহ প্রায় ৫০ লাখ মানুষ বেকার হয়ে পড়বে। তাদের পরিবারের নূ্যনতম ৪ জন সদস্য হিসেবে ২ কোটি মানুষের ভরণ-পোষণ, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ অন্য মৌলিক চাহিদা পূরণে ভয়াবহ সংকট দেখা দেবে। ফলে এদের একটি বড় অংশ অপরাধে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে- যা সামাল দেওয়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষে কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। অথচ দুর্বল কাঠামো ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার দ্রম্নতগতির ব্যাটারিচালিত রিকশার লাগাম টানা না গেলে আগামীতে এ যানের সংখ্যা হু হু করে বেড়ে সড়কের নিরাপত্তা পুরোপুরি ভেঙে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এছাড়া পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যও চরম হুমকির মুখে পড়বে। অভিজ্ঞজনদের অভিমত, ব্যাটারিচালিত রিকশার সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ার শুরুতেই তা বন্ধে দ্রম্নত কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত ছিল। অথচ এ ব্যাপারে তখন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। এমনকি ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধে হাইকোর্ট দফায় দফায় নির্দেশনা জারি করলেও সরকার তাতে গুরুত্ব দেয়নি। এ খাত ঘিরে চাঁদাবাজ চক্র তৎপর হয়ে উঠলেও তা নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। এ খাতটি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার পর এখন এলোমেলো সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে- যা 'গোদের উপর বিষফোঁড়া' হয়ে উঠবে। কেননা অর্ধকোটিরও বেশি মানুষের জীবন-জীবিকা পুরোপুরি এ খাতের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় ব্যাটারিচালিত রিকশা নিয়ে সরকারের নেওয়া যে কোনো সিদ্ধান্ত তাদের স্বার্থের বিপক্ষে গেলে তারা মরিয়া হয়ে এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামবে। এছাড়া পুলিশের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা, চাঁদা নেওয়া রাজনৈতিক নেতা ও স্থানীয় ক্যাডাররাও তাদের নিজেদের স্বার্থে এ ব্যবসা টিকিয়ে রাখার জন্য পরোক্ষভাবে মাঠে নামবে। কেননা ব্যাটারিচালিত রিকশা চলা বন্ধ হলে তারা মোটা অংকের চাঁদা থেকে বঞ্চিত হবেন। ব্যাটারিচালিত রিকশার ডজনখানেক মালিক-চালক ও শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে কথা বলেও এ তথ্যের সত্যতা পাওয়া গেছে। তারা জানান, ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল বন্ধে সরকারি সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে তাদের আন্দোলন বেগবান করার জন্য রাজনৈতিক নেতা ও ক্যাডাররা নানাভাবে সহায়তা করেছে। থানা পুলিশও পরোক্ষভাবে তাদের এ আন্দোলন সমর্থন করেছে। মিরপুর এলাকার একজন গ্যারেজ মালিক জানান, ব্যাটারিচালিত রিকশা এখন থানা পুলিশের অবৈধ আয়ের বড় উৎস হয়ে উঠেছে। রাজধানীর যেসব এলাকায় এ যানের দাপট বেশি ওইসব থানা ব্যাটারিচালিত রিকশা থেকে মাসে ৫০ থেকে ৭০ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করছে। রাজনৈতিক নেতা ও ক্যাডারদের চাঁদাবাজির অর্থও প্রায় তাদের সমপরিমাণ। সুতরাং ব্যাটারিচালিত রিকশা সড়ক নিরাপত্তার জন্য কতটা হুমকি, এতে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য কতটা ক্ষতিকর তা গুরুত্বে না নিয়ে নিজেদের স্বার্থেই তারা শুরু থেকেই এ অবৈধ বাণিজ্য টিকিয়ে রাখতে চাইছে। তাদের এ অভিযোগ যে অমূলক নয়, তা দেশে ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল শুরু থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত সার্বিক চিত্র বিশ্লেষণে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০১৪ সালে ঢাকা ও চট্টগ্রামে ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধের নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট। এরপর ২০১৭ সালে এসব পরিবহণ বন্ধে আরেক দফা নির্দেশনা আসে হাইকোর্টের। ২০২১ সালের ১৫ ডিসেম্বর অটোরিকশা বন্ধ ও আমদানি নিষিদ্ধ করে আবারও নির্দেশনা দেয় হাইকোর্ট। ২০২১ সালের ২০ জুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এসব রিকশা-ভ্যান বন্ধের নির্দেশ দেন। তবে দফায় দফায় এসব নির্দেশনার পর বিভিন্ন সময় লোক দেখানো অভিযান চালানো হলেও সরকারের পক্ষ থেকে কঠোর কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এ সুযোগে ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক নেতা, স্থানীয় ক্যাডার এবং থানা ও ট্রাফিক পুলিশের মদদে অলিগলিতে চলা ব্যাটারিচালিত রিকশা নগর-মহানগরের প্রধান সড়কে দাপিয়ে বেড়াতে শুরু করে। গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ব্যাটারিচালিত অবৈধ অটোরিকশা তৈরির কয়েকশ' কারখানা গড়ে ওঠে। এ ছাড়া গাড়ি মেরামতের ওয়ার্কশপগুলোও অবাধে এ অবৈধ এসব যান উৎপাদন শুরু করে। ফলে ২০১৩ সালে গোপনে বিভিন্ন রাস্তায় চলা অর্ধলক্ষাধিক ব্যাটারিচালিত রিকশা কয়েক বছরের ব্যবধানে এখন ৪০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। দুর্বল নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার দ্রম্নতগতির এ যানে সড়ক দুর্ঘটনা ভয়ংকর রূপ নিয়েছে। ১০ বছরে রাস্তায় নামা ৪০ লাখ অটোরিকশার ব্যাটারি ব্যবহৃত ১২ বিলিয়ন কেজি সিসা পরিবেশ ও স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য বড় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নষ্ট ব্যাটারি ভেঙে ভেতরের সিসা পরিষ্কার করতে ব্যবহার করা পানি বিভিন্ন নদী-নালা, খাল-বিল ও কৃষি জমিতে ছড়িয়ে পড়ে পানি ও মাটি ব্যাপকভাবে দূষণ করেছে। এছাড়া এই দূষিত পানির জলাশয়ে বেড়ে ওঠা মাছের শরীরে সিসা প্রবেশ করে খাদ্য চক্রের মাধ্যমে জনস্বাস্থ্যকে হুমকির মুখে ফেলেছে। ঢাকার সাভার ও টাঙ্গাইলে ব্যাটারি পুনঃচক্রায়ন কারখানার আশপাশের বাসিন্দাদের রক্ত পরীক্ষা করে একজন শিশুর রক্তে প্রতি ডেসিলিটারে ৪৬ মাইক্রোগ্রাম সিসা পাওয়া গেছে। যেখানে রক্তে সিসার সর্বোচ্চ গ্রহণযোগ্য পরিমাণ সাড়ে তিন মাইক্রোগ্রাম প্রতি ডেসিলিটার। যা মানুষের আইকিউ লেভেল কমে যাওয়া, মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হওয়া এবং স্নায়ুতন্ত্রের বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে গবেষণায় ওঠে এসেছে। এদিকে ব্যাটারিচালিত রিকশার কাঠামোগত দুর্বলতা এবং এর পরিবেশ ও স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির বিষয়গুলো নিয়ে শুরু থেকেই বিভিন্ন মহলে আলোচনা-সমালোচনা হলেও এ যান চলাচল বন্ধে এতদিন কেন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি? দীর্ঘদিন পর এ ব্যাপারে কঠোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও রাতারাতি তা কেন তুলে নেওয়া হলো- তা নিয়ে নানামুখী প্রশ্ন উঠেছে। পরিবহণ সংশ্লিষ্টদের অনেকের ধারণা, টাইগার ইকো মোটর্সের বৈদু্যতিক থ্রি হুইলার একচেটিয়া বাজারজাতকরণের সুযোগ দিতেই সরকারের একটি বিশেষ মহল ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধের পক্ষ নিয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি ব্যাটারিচালিত রিকশা ও রিকশাভ্যানকে মোটরযানের স্বীকৃতি দিতে সড়ক পরিবহণ সংশোধন আইন ২০২৪-এর খসড়া নীতিগতভাবে অনুমোদন করা হয়। সেখানে ব্যাটারিচালিত যানবাহনকে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত রয়েছে। সংশোধনীর খসড়ায় তিন চাকার মোটরযানের ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার শিক্ষাগত যোগ্যতা প্রস্তাব করা হয়েছে 'পঞ্চম শ্রেণি পাস'। এছাড়া বিমার বিষয়টি যুক্ত করা হয় সংশোধনীতে। প্রসঙ্গত, সম্পূর্ণ দেশীয় ব্যবস্থাপনায় তৈরি তিন চাকার থ্রি হুইলার 'বাঘ'। এই ইকোট্যাক্সিতে অত্যাধুনিক সব ডিজিটাল ব্যবস্থাপনা রয়েছে। দেশে প্রচলিত ইজিবাইকে ব্যবহৃত অ্যাসিড ব্যাটারিতে মূলত আবাসিক ও অবৈধ বিদু্যৎ দিয়ে চার্জ হয়। এর ফলে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকার বিদু্যৎ অপচয় হয়। 'বাঘ'-এর চার্জার নিয়ন্ত্রিত হবে সিএমএস বা চার্জিং ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমে এবং ব্যাটারি নিয়ন্ত্রিত হবে ব্যাটারি ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমে। এই দুটোতে দুটো 'ব্রেইন সফটওয়্যার' রয়েছে। বৈধ সংযোগ ছাড়া এগুলো কাজ করবে না। প্রচলিত ইজিবাইকে ব্যবহৃত অ্যাসিড ব্যাটারিতে খরচ পড়ে বেশি এবং এগুলো পরিবেশের জন্যও ক্ষতিকর। 'বাঘ' চলবে লিথিয়াম আয়নে। এটি পরিবেশবান্ধব ও দামও কম- টাইগার মোটর্স দীর্ঘদিন ধরে এ প্রচারণা চালাচ্ছে।