নতুন বিচারপতি নিয়োগে আলোচনায় যারা

প্রকাশ | ২৬ মে ২০২৪, ০০:০০

যাযাদি রিপোর্ট
দিন দিন বাড়ছে মামলার সংখ্যা। সেই অনুপাতে দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে বাড়েনি বিচারপতি। বিচারহীন হয়ে ঝুলে আছে বহু মামলা, তৈরি হয়েছে মামলা জট। এ অবস্থায় মামলা জট কমাতে ও বিচার কার্যক্রম গতিশীল করতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক সৎ, দক্ষ ও যোগ্য বিচারক নিয়োগের দাবি জানিয়েছেন আইনজীবীরা। রাষ্ট্রপতি শিগগির হাইকোর্ট বিভাগে বিচারপতি নিয়োগ দেবেন বলে আশা প্রকাশ করেছেন আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক। সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন ও আইনজীবীদের সূত্রে জানা গেছে, কয়েক বছর আগেও হাইকোর্ট বিভাগে ১১০ জনের বেশি বিচারপতি দায়িত্ব পালন করেন। এর মধ্যে অনেকে আপিল বিভাগে নিয়োগ পেয়েছেন নয়তো অবসরে গেছেন। কিন্তু তাদের স্থানে সময়মতো নতুন বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া হয়নি। বর্তমানে হাইকোর্ট বিভাগে স্থায়ী বিচারপতির সংখ্যা ৮৪ জন। এর মধ্যে তিনজনকে অসদাচরণের অভিযোগে বিচারিক দায়িত্ব থেকে বিরত রাখা হয়েছে। এ অবস্থায় হাইকোর্ট বিভাগে ১২ থেকে ১৬ জন বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া হতে পারে। এরই মধ্যে ৩০ থেকে ৩৫ জনের বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে তাদের নাম আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এ নিয়ে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন বলেন, 'বিচারপতি নিয়োগের বিষয়ে দেশের প্রধান বিচারপতি ও আইনমন্ত্রী পরামর্শ করবেন। হাইকোর্টে বিচারপতি নিয়োগ নিয়ে আমার সঙ্গে ওইভাবে কারও কথা হয়নি। কথা হলে বলতে পারব কবে, কতজন বিচারক নিয়োগ দেওয়া হতে পারে।' খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হাইকোর্ট বিভাগে এখন নতুন বিচারপতি নিয়োগের তোড়জোড় চলছে। 'নিয়োগযোগ্য' ব্যক্তিদের নাম এখন বিবেচনার টেবিলে। কাদের নাম আছে তালিকায়, বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা নাকি আইনজীবী, এ নিয়ে বিচারঙ্গনে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। বরাবরের মতোই রাষ্ট্রের আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাধারণ সদস্য ও বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা- এই তিন ক্যাটাগরি থেকে উচ্চ আদালত তথা হাইকোর্ট বিভাগে বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া হবে। বিচারপতির সংখ্যা নির্দিষ্ট নয় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগে বিচারপতির সংখ্যা নির্দিষ্ট নয়। সংবিধানের ৯৪ (২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, 'প্রধান বিচারপতি (যিনি বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি' নামে অভিহিত হইবেন) এবং প্রত্যেক বিভাগে আসন গ্রহণের জন্য রাষ্ট্রপতি যে সংখ্যক বিচারক নিয়োগের প্রয়োজনবোধ করবেন, সেই সংখ্যক অন্যান্য বিচারক লইয়া সুপ্রিম কোর্ট গঠিত হইবে।' সংবিধানের ৯৫ (১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, 'প্রধান বিচারপতি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হইবেন এবং প্রধান বিচারপতির সহিত পরামর্শ করিয়া রাষ্ট্রপতি অন্যান্য বিচারককে নিয়োগদান করিবেন।' 'অযোগ্যতা'র বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা সুপ্রিম কোর্টে বিচারপতি নিয়োগের 'যোগ্যতা'র বিষয়টি এখনো অস্পষ্ট। তবে 'অযোগ্যতা'র বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে সংবিধানে। সংবিধান অনুযায়ী ৬৭ বছর বয়স পর্যন্ত বিচারপতি পদে থাকা যায়। সংবিধানে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি বাংলাদেশের নাগরিক না হলে, সুপ্রিম কোর্টে অনূ্যন ১০ বছর অ্যাডভোকেট না থাকলে অথবা বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সীমানার মধ্যে অনূ্যন ১০ বছরের কোনো বিচার বিভাগীয় পদে অধিষ্ঠান না করে থাকলে অথবা সুপ্রিম কোর্টের বিচারক পদে নিয়োগ লাভের জন্য আইনের দ্বারা নির্ধারিত যোগ্যতা না থেকে থাকলে তিনি বিচারক পদে নিয়োগ লাভের যোগ্য হবেন না। বিচারক নিয়োগ নিয়ে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল আবু মোহাম্মদ (এএম) আমিন উদ্দিন বলেন, বিচারপতি নিয়োগ করেন রাষ্ট্রপতি। এর আগে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে তিনজন বিচারপতি নিয়োগ হওয়ায় হাইকোর্ট বিভাগে বিচারপতি কমেছে। স্বাভাবিকভাবেই এখন হাইকোর্ট বিভাগে বিচারপতি নিয়োগ হওয়ার কথা। তবে কবে কখন নিয়োগ দেবেন সেটা মহামান্য রাষ্ট্রপতিই জানেন। দক্ষ বিচারপতির বিকল্প নেই সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা চাচ্ছেন দক্ষ, সৎ ও আইন সম্পর্কে অভিজ্ঞ- এমন ব্যক্তিদের যেন বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে একজন দক্ষ বিচারপতির বিকল্প নেই। এ ব্যাপারে কথা হয় সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ও সাবেক অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এবং সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী মো. মোমতাজ উদ্দিন ফকিরের সঙ্গে। তিনি বলেন, 'সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে বিচারপতি সংকট কেটেছে। এখন জরুরিভিত্তিতে হাইকোর্ট বিভাগে বিচারক নিয়োগ হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।' মোমতাজ উদ্দিন বলেন, মামলা নিষ্পত্তির জন্য ভালো, দক্ষ ও যোগ্য বিচারপতি দরকার। মামলা যে হারে বাড়ছে, বিচারপতিও কিন্তু কম না। কিন্তু দেখতে হবে নিষ্পত্তি কত। মামলা হ্রাস-বৃদ্ধি বিচারপতির দক্ষতার ওপর নির্ভর করে। ফলে দেখে-শুনে ভালো বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন। সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী বলেন, 'বর্তমানে হাইকোর্টে বিচারপতি নিয়োগের কোনো নীতিমালা নেই। আমি মনে করি, দক্ষতা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে যেন বিচারপতি নিয়োগ করা হয়, তিনি যে দলেরই হোন না কেন, সেটাই আমাদের কাম্য। কিন্তু দলীয় নীতিতে যদি বিচারপতি নিয়োগ করা হয়, তাহলে সেটা নিয়োগ হবে, কিন্তু ন্যায়বিচারের পক্ষে থাকবে না। আমরা বহুদিন থেকেই দাবি করে আসছি, বিচারপতি নিয়োগের নীতিমালা হোক।' শিগগির নিয়োগ হাইকোর্টে বিচারপতি নিয়োগ নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবী মো. খুরশীদ আলম খান বলেন, 'সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে তিনজন বিচারপতি নিয়োগের পর এখন দু'টি বেঞ্চ গঠন করেছেন প্রধান বিচারপতি। এটা মহৎ উদ্যোগ। হাইকোর্ট বিভাগে বিচারক কমেছে, এখন সেখানে নিয়োগ দেওয়া উচিত। মামলা যেভাবে বাড়ছে তাতে আমার মনে হয় শিগগির হাইকোর্ট বিভাগে বেশ কয়েকজন বিচারক নিয়োগ করা উচিত।' উচ্চ আদালতে নতুন বিচারক নিয়োগ নিয়ে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, 'সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নিয়োগ একটি চলমান প্রক্রিয়া। বিচারপতি নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি। তারপরও এ বিষয়ে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে কথা বলব। আশা করছি, রাষ্ট্রপতি শিগগির হাইকোর্ট বিভাগে বিচারপতি নিয়োগ দেবেন।' আলোচনায় যারা এদিকে হাইকোর্টে নতুন বিচারপতি হিসেবে কারা নিয়োগ পাচ্ছেন- এ নিয়ে আলোচনা চলছে। তাদের মধ্যে অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি ও জুডিশিয়ারি থেকে কারা আসছেন তা নিয়ে চলছে আলোচনা। রাষ্ট্রের আইন কর্মকর্তাদের মধ্যে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সুজিত চ্যাটার্জি বাপ্পী, মো. আসাদুজ্জামান মনির, এ কে এম আমিন উদ্দিন মানিক, সমরেন্দ্র নাথ বিশ্বাস, শেখ মো. (এসকে) সাইফুজ্জামান জামান, ব্যারিস্টার আবদুলস্নাহ আল মাহমুদ বাশার, মো. সারওয়ার হোসেন বাপ্পী, ব্যারিস্টার নওরোজ মো. রাসেল চৌধুরী ও বিএম আব্দুর রাফায়েলের নাম সম্ভাব্য বিচারপতি হিসেবে আলোচনায় রয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীদের মধ্যে অ্যাডভোকেট মিনহাজুল হক চৌধুরী, আমিনুল হক হেলাল, আব্দুর রাজ্জাক রাজু, মো. মুজিবুর রহমান, বাকির উদ্দিন ভূঁইয়া, এ বি এম নূর-এ আলম (উজ্জ্বল) ও সুপ্রিম কোর্ট বারের সাবেক সহ-সম্পাদক ব্যারিস্টার এম শফিকুল ইসলামের নাম আলোচিত হচ্ছে। বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল মো. গোলাম রব্বানী, আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. গোলাম সারওয়ার, আইন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব উম্মে কুলসুম, ঢাকা মহানগরের সাবেক দায়রা জজ মো. আসাদুজ্জামান ও দুদকের মহাপরিচালক (লিগ্যাল অ্যান্ড প্রসিকিউশন) মীর রুহুল আমীনের নাম আলোচনা হচ্ছে। এর আগে সর্বশেষ ২০২২ সালের ৩১ জুলাই সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে ১১ জনকে অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি।