প্রাণঘাতী অধিকাংশ ঘূর্ণিঝড়ের উৎপত্তিস্থল বঙ্গোপসাগর

প্রকাশ | ২৬ মে ২০২৪, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
শনিবার সন্ধ্যায় দেশের দক্ষিণ উপকূলীয় অঞ্চলে লাল পতাকা উড়িয়ে ও মাইকিং করে ঘূর্ণিঝড়ের সতর্কবার্তা প্রচার করেন স্বেচ্ছাসেবকরা -সংগৃহীত
বঙ্গোপসাগরের উত্তর উপকূল বিশ্বের যে কোনো সমুদ্র উপকূলের চেয়ে জলোচ্ছ্বাসের বেশি ঝুঁকিতে। একই কারণে এখানে ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতিও বেশি। এছাড়া বিশ্বের সবচেয়ে প্রাণঘাতী ঘূর্ণিঝড়ের উৎপত্তিও হয়েছে বঙ্গোপসাগরে। গত ২০০ বছরে এসব ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণ গেছে অন্তত ২০ লাখ মানুষের। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বঙ্গোপসাগরের ত্রিভুজ আকৃতি, অগভীর তলদেশ এবং ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেই সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়ের সবচেয়ে বড় শিকারে পরিণত হয়ে আসছে বাংলাদেশ। আবহাওয়া পরিস্থিতির ওপর নজর রাখা 'ওয়েদার আন্ডারগ্রাউন্ড' ওয়েবসাইটের পরিসংখ্যান বলছে, বিশ্বের ইতিহাসে প্রতি দশটি ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের আটটি সৃষ্টি হয় বঙ্গোপসাগরে। সংস্থাটির নথিবদ্ধ ইতিহাস অনুযায়ী, ৩৬টি ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে ২৬টির জন্মস্থান এ সমুদ্রভাগ। এমন বাস্তবতায় উপকূলের দিকে ধেয়ে আসছে আরেকটি ভয়ংকর ঘূর্ণিঝড় 'রেমাল'। বিশ্বের প্রধান প্রধান আবহাওয়ার মডেল বিশ্লেষণ করে আবহাওয়াবিদরা বলছেন, বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় 'রেমাল' রোববার সন্ধ্যার পর বাংলাদেশের খেপুপাড়া এলাকা দিয়ে স্থলভাগে আঘাত হানতে পারে। তথ্যানুযায়ী, বিশ্বের মোট মহাসাগরীয় অঞ্চলের মাত্র শূন্য দশমিক ছয় শতাংশ স্থান অধিকার করে আছে বঙ্গোপসাগর। কিন্তু এর তটরেখা বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ, সমুদ্র উপকূলে বাস করে প্রায় অর্ধশত কোটি মানুষ। তাই ঘূর্ণিঝড়ে হতাহতের ঘটনাও বেশি হয় এ সমুদ্রকে ঘিরে। বঙ্গোপসাগরে তৈরি সবচেয়ে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়টি ছিল ১৯৭০ সালের ভোলা ঘূর্ণিঝড়। ওই ঝড়ে দেশের ৩ থেকে ৫ লাখ মানুষের মৃতু্য হয়। দ্বিতীয়টি ঘটে ১৭৩৭ সালে। ভারত-বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল ক্ষতিগ্রস্ত করা ওই ঘূর্ণিঝড়কে বলা হয় 'হুগলী নদীর ঘূর্ণিঝড়'। ওই ঘূর্ণিঝড়ে ৩ লাখ মানুষের মৃতু্য হয়। বঙ্গোপসাগরে সংঘটিত ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষয়ক্ষতি বেশি হওয়ার কারণ জলোচ্ছ্বাস। কখনো কখনো জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা ১০ মিটারের বেশি হয়। ভূতাত্ত্বিকদের মতে, বঙ্গোপসাগরের ত্রিভুজাকৃতি এবং এর অগভীর তলদেশই ঘূর্ণিঝড়ে জলোচ্ছ্বাস সৃষ্টি হওয়ার কারণ। ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল চট্টগ্রামের উপকূলীয় অঞ্চলে প্রায় ২৫০ কিলোমিটার বেগে আঘাত হানে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়। ঘূর্ণিঝড়টি '০২ই' নামে পরিচিতি। এ ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে ২০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে পস্নাবিত হয় উপকূলীয় এলাকা। প্রায় এক লাখ ৩৮ হাজার মানুষ মারা যায়। কোটি মানুষ তাদের সর্বস্ব হারায়। ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ের সময় যে জলোচ্ছ্বাস হয়েছিল তার উচ্চতা ছিল ১০ দশমিক ৪ মিটার বা ৩৪ ফুট। চট্টগ্রামের পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিসে ৩২ বছর আবহাওয়াবিদ হিসেবে দায়িত্ব পালন করা ফরিদ আহমদ বলেন, 'বঙ্গোপসাগরে অন্য সাগরের তুলনায় বেশি জলোচ্ছ্বাস হয়। বঙ্গোপসাগরের অবতল আকৃতি এ জলোচ্ছ্বাসের অন্যতম কারণ। এছাড়া সমুদ্রের উপরিতল বা সারফেসের তাপমাত্রাও একটি কারণ। দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ১৯৭০ সাল ও ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়। ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর সর্বোচ্চ ২২৪ কিলোমিটার বেগে চট্টগ্রামের উপকূলে আঘাত হানে। এতে ১০-৩৩ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হয়েছিল। ১৯৯১ সালে ছয়-ঘণ্টার বেশি সময় বাতাস বইতে থাকে। ২২৪ কিলোমিটার বেগে আসা এ ঘূর্ণিঝড়ে ভেসে গিয়েছিল চট্টগ্রাম বিমানবন্দরের বিমান। এছাড়া ১৯৮৫ সালের উরিরচরের ঘূর্ণিঝড়, ২০০৭ সালের সিডর, ২০০৯ সালের আইলা স্মরণকালের ঘূর্ণিঝড়গুলোর অন্যতম।' বার্লিনভিত্তিক পরিবেশ গবেষণা সংস্থা (গ্রিন-ওয়াচ) ২০১৯ সালে এক প্রতিবেদনে উলেস্নখ করে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবিত দেশগুলোর মধ্যে সপ্তম। সংস্থাটি জানায়, বাংলাদেশের উপকূলে লবণাক্ত পানির ছোবলে বিপর্যস্ত কৃষিকাজ। অন্যদিকে মেরুর বরফ গলে সাগরের উচ্চতা বাড়ছে যেমন, ঠিক তেমনি তাপমাত্রার প্রভাবে সাগরের পানির প্রসারণও বেড়েছে। বেড়েছে ঘূর্ণিঝড় ও লবণাক্ততা। ওয়েদার আন্ডারগ্রাউন্ডের এক প্রতিবেদনে আবহাওয়াবিদ বব হেনসন উলেস্নখ করেন, 'জলবায়ু পরিবর্তনের টেক্সটবুক উদাহরণ হচ্ছে বঙ্গোপসাগর। বঙ্গোপসাগর খুবই উষ্ণ এক সাগর। বিশেষ করে সমুদ্রের উপরিতলের তাপমাত্রা। এ উষ্ণতা বঙ্গোপসাগরে ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির জন্যও দায়ী।'