বিগত অর্থবছরগুলোতে বাজেটে বিদু্যৎ উৎপাদনে সর্বোচ্চ বরাদ্দ থাকলেও এবার গুরুত্ব পাচ্ছে অবকাঠামো ও সঞ্চালন ব্যবস্থা উন্নয়ন। চলমান প্রায় ২ ডজন প্রকল্প বাস্তবায়নে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এতে বেশ কিছু প্রকল্পের কাজ চলতি বছরেই শেষ করা যাবে। তবে এসব প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দের ফলে গ্রাহকের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি হবে বলেও মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ ছাড়া নতুন অর্থবছরে বিদু্যৎ উৎপাদনের মতো সঞ্চালন ব্যবস্থায় বেসরকারি খাতের বিনিয়োগের সুযোগ তৈরিতে নীতিমালা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। ইতোমধ্যে সরকারের একটি টেকনিক্যাল টিম সামগ্রিক গ্রাফিং কাজ করছে। তা শেষ হলেই দ্রম্নত এর অনুমোদন দেওয়া হবে।
চলতি মাসে প্রকাশিত ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য অনুমোদিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০২৫ অর্থবছরের বিদু্যৎ উৎপাদন প্রকল্পে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ১৯ হাজার ৭০৭.৮৯ কোটি টাকা; সঞ্চালন লাইন প্রকল্পগুলোতে ১১ হাজার ৭১৬.৪৩ কোটি টাকা এবং বিতরণ ব্যবস্থার চলমান প্রকল্পগুলোতে ১০ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
তবে চলতি ২০২৪ অর্থবছরের সংশোধিত এডিপির তুলনায় আগামী ২০২৫ অর্থবছরের সংশোধিত এডিপিতে ৬ শতাংশ বা ১ হাজার ২৫৯.৯১ কোটি টাকা বরাদ্দ কমেছে উৎপাদনের প্রকল্পগুলোতে। এ ছাড়া চলতি অর্থবছরের মূল এডিপির তুলনায় এই প্রকল্পগুলোতে বরাদ্দ কমেছে ১১.৫ শতাংশ। মূলত সংকোচনমূলক বাজেট ঘোষণার কারণে সার্বিক বরাদ্দের পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিদু্যৎ বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. হাবিবুর রহমান যায়যায়দিনকে বলেন, আমাদের বিদু্যৎ উৎপাদনে সক্ষমতা তৈরি হলেও সঞ্চালন ব্যবস্থায় দুর্বলতা রয়েছে। তাই গত বেশ কয়েক বছর ধরেই এ খাতে উন্নয়নে অনেকগুলো প্রজেক্ট হাতে নেওয়া হয়েছে। বেশ কিছু প্রকল্পের কাজ শেষ হলেও এখনো অনেকগুলোর কাজ চলমান রয়েছে, যা শেষ না হলে এর সুবিধা আমরা পাচ্ছি না। তাই নতুন অর্থবছরে এসব প্রকল্পে জোর দিয়ে বাজেটে বরাদ্দ রাখার পরিকল্পনা করা হয়েছে।
এদিকে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) তথ্য বলছে, গত এক দশকে দেশের বিদু্যৎ খাতে উৎপাদন সক্ষমতার পাশাপাশি সঞ্চালন লাইন, নতুন সাবস্টেশন, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, অটোমেশন ও দক্ষ জনবল তৈরিসহ সামগ্রিক পাওয়ার গ্রিড ব্যবস্থাপনা উন্নয়নে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকার কয়েক ডজন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছিল। যার মধ্যে এখনো ১৭টি মেগাপ্রকল্প চলমান রয়েছে। স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি এসব প্রকল্পের বেশির ভাগের কাজ শেষ ২০২৫ সাল নাগাদ।
পিজিসিবি'র তথ্যানুসারে চলমান ১৭টি প্রকল্পের মধ্যে কিছু প্রকল্পের মেয়াদ ৭ থেকে ১০ বছরব্যাপী এবং কিছু প্রকল্পের মেয়াদ ৩ থেকে ৫ বছর পর্যন্ত। সংস্থাটির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, অধিকাংশ প্রকল্প শেষ হবে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর ও ২০২৫ সালের ডিসেম্বর নাগাদ। এ ছাড়া কিছু প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হবে ২০২৮ সালে। এর বাইরে ২টি প্রকল্পের একটি চলতি বছর জুন ও অপরটির মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০২১ সালে। এ ছাড়া যেসব প্রকল্প ২০২৪ সাল নাগদ শেষ হওয়ার কথা, তার অনেকগুলোরই ২০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত কাজ বাকি রয়েছে, যা নির্ধারিত সময়ে শেষ হওয়া নিয়েও উদ্বেগ রয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিদু্যৎ সচিব বলেন, বর্তমানে আমরা বিদু্যৎ উৎপাদন করেও পরিবহণ জটিলতায় শতভাগ ব্যবহার করতে পারছি না। তাই রেকর্ড উৎপাদন করেও গ্রামে লোডশেডিং করতে হচ্ছে। ইতোমধ্যেই অনেক প্রকল্পের কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে, তাই নতুন অর্থবছরে এ খাত গুরুত্ব পাচ্ছে।
চলমান প্রকল্পগুলোর অর্থ ছাড় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সাধারণত দাতা সংস্থার অর্থ ছাড় হয় প্রকল্প শেষ হওয়ার পরে। তাই কাজ এগিয়ে নিতে সামগ্রিক অর্থের জোগান সরকারকেই করতে হয়। পরে বিল সাবমিট হলে অর্থ ছাড় হয়। তবে প্রকল্প বাস্তবায়নে বাজেটে অর্থ বরাদ্দ বাড়লেও তা বিদু্যৎ উপাদনে কোনো প্রভাব ফেলবে না।
তবে উৎপাদন ব্যয়ের পাশপাশি প্রকল্প বাস্তবায়েন বাড়তি অর্থ গ্রাহকের বিদু্যৎ বিলের সঙ্গে সমন্বয় হবে। এতে নতুন অর্থবছরে বিদু্যৎ বাবদ গ্রাহকের ব্যয় আরও বাড়বে। এদিকে প্রতিবছর ৪ দফায় বিদু্যতের দাম বাড়িয়ে ভর্তুকি তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে নতুন অর্থবছরে বিদু্যৎ বিল অস্বাভাবিক হারে বাড়বে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। বিদু্যৎ সচিবও তা স্বীকার করে বলেন, যেহেতু ভর্তুকি তুলে কমছে, তাই এই বাড়তি অর্থ জোগানে গ্রাহকই আমাদের একমাত্র উৎস।
এদিকে ২০২৫ অর্থবছরের এডিপিতে বিদু্যৎ সঞ্চালন লাইন প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ ২০২৪ অর্থবছরের সংশোধিত এডিপির তুলনায় ১১ শতাংশ এবং মূল এডিপির তুলনায় ১৫.৭৮ শতাংশ বাড়তে পারে। এ ছাড়া চলতি অর্থবছরে সংশোধিত এডিপির তুলনায় আগামী অর্থবছরের এডিপিতে বিতরণ ব্যবস্থার উন্নয়নে বরাদ্দ বাড়তে পারে ৩৪.৮ শতাংশ। এটি অবশ্য চলতি ২০২৪ অর্থবছরের মূল এডিপির চেয়ে ৫.৮ শতাংশ কম।
নতুন অর্থবছরে সঞ্চালন লাইনের চলমান প্রকল্পগুলোর মধ্যে বরাদ্দ বেড়েছে পাওয়ার গ্রিড নেটওয়ার্ক শক্তিশালীকরণ প্রকল্পে। এই প্রকল্পে চলতি অর্থবছরের সংশোধিত এডিপির তুলনায় নতুন এডিপিতে বরাদ্দ ১ হাজার ৮৯১.১০ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩ হাজার ৬১৫ কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়েছে।
এ ছাড়া বড়পুকুরিয়া-বগুড়া-কালিয়কৈর ৪০০ কেভি সঞ্চালন লাইন প্রকল্পে প্রায় দ্বিগুণ বাড়িয়ে ২ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ৮৩৮ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে রূপপুর পারমাণবিক বিদু্যৎকেন্দ্রের উৎপাদিত বিদু্যৎ ইভাকুয়েশনের জন্য সঞ্চালন লাইন নির্মাণ প্রকল্পে।
এদিকে বিতরণ ব্যবস্থার উন্নয়নে বিদু্যৎ উন্নয়ন বোর্ডকে ১ হাজার ৩০৫ কোটি টাকা, পলস্নী বিদু্যতায়ন বোর্ডকে ৩ হাজার ০১৭.৬২ কোটি টাকা, ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানিকে (ডিপিডিসি) ৪ হাজার ৩৯০.৮৩ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।