সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর রিভিউ শুনানি ১১ জুলাই

প্রকাশ | ২৪ মে ২০২৪, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদ সদস্যদের হাতে দেওয়া হয়েছিল সংবিধানের যে ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে, তা অবৈধ ও বাতিল করে দেওয়া আপিল বিভাগের রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদনের শুনানি হবে আগামী ১১ জুলাই। বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বাধীন সাত বিচারকের আপিল বেঞ্চ বৃহস্পতিবার শুনানির এই দিন ধার্য করেন। এদিন সকালে আবেদনের বিষয়টি উপস্থাপন করেন রিটকারী আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন এ সময় উপস্থিত ছিলেন। পরে মনজিল মোরসেদ বলেন, 'ষোড়শ সংশোধনীর রায়ের বিরুদ্ধে করা রিভিউ আবেদন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের নিয়মিত ও পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চের কার্যতালিকায় ছিল। এটি শুনানির জন্য সকালে মেনশন করেছিলাম। কিন্তু প্রধান বিচারপতি আজ বেঞ্চে না থাকায় বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বাধীন আপিল বেঞ্চ আবেদনটি শুনানির জন্য আগামী ১১ জুলাই দিন ধার্য করেছেন।' বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে আনা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী ২০১৬ সালে অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্ট। ওই বছর ৫ মে বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী, বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি আশরাফুল কামালের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের বিশেষ বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করেন। ওই বছরের হ১১ অগাস্ট এ রায় সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। পরে এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। ২০১৭ সালের ৮ ফেব্রম্নয়ারি আপিল শুনানিতে অ্যামিকাস কিউরি নিয়োগ দেয় আপিল বিভাগ। আপিল শুনানিতে ১০ অ্যামিচি কিউরির মধ্যে শুধু আজমালুল হোসেন কিউসি ষোড়শ সংশোধনীর পক্ষে মত দেন। অপর নয় অ্যামিচি কিউরি ড. কামাল হোসেন, এম আই ফারুকী, আব্দুল ওয়াদুদ ভূঁইয়া, সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এ এফ এম হাসান আরিফ, এম. আমিরুল ইসলাম, বিচারপতি টিএইচ খান, রোকন উদ্দিন মাহমুদ, ফিদা এম কামাল, এ জে মোহাম্মদ আলী সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর বিপক্ষে তাদের মতামত তুলে ধরেন। ওই বছরের ৮ মে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে আপিল শুনানি শুরু হয়, চলে ১১ দিন। ২০১৭ সালের ৩ জুলাই তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন সাত বিচারকের আপিল বেঞ্চ ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ও বাতিলের রায় বহাল রাখেন। এরপর ১ অগাস্ট ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করে সুপ্রিম কোর্ট, যা নিয়ে ক্ষমতাসীনদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। সংবিধানের ওই সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল। কিন্তু রায়ে তা বাতিল করে জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনামলে প্রতিষ্ঠিত সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল ফিরিয়ে আনে সুপ্রিম কোর্ট। সাত বিচারকের ঐকমত্যের ভিত্তিতে দেওয়া ৭৯৯ পৃষ্ঠার ওই রায়ে তখনকার প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা নিজের পর্যবেক্ষণের অংশে দেশের রাজনীতি, সামরিক শাসন, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি, সুশাসন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে সমালোচনা করেন। ওই রায় এবং পর্যবেক্ষণ নিয়ে খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও প্রধান বিচারপতির সমালোচনা করেন। রায়ের পর্যবেক্ষণে বঙ্গবন্ধুকে 'খাটো করা হয়েছে' অভিযোগ তুলে বিচারপতি সিনহার পদত্যাগের দাবি তোলেন ক্ষমতাসীন দলের অনেক নেতা। তুমুল আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে বিচারপতি সিনহা ছুটিতে যান। ছুটি শেষে ওই বছর ১০ নভেম্বর বিদেশ থেকেই রাষ্ট্রপতির কাছে নিজের পদত্যাগপত্র পাঠান বিচারপতি সিনহা। পরে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় রিভিউ আবেদন করে আপিল বিভাগের রায় বাতিল চায়। রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছিলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আইনসভার কাছে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা রয়েছে। দেশের সংবিধানেও শুরুতে এই বিধান ছিল। তবে সেটি 'ইতিহাসের দুর্ঘটনা' মাত্র। কমনওয়েলথভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর ৬৩ শতাংশের অ্যাডহক ট্রাইবু্যনাল বা ডিসিপিস্ননারি কাউন্সিলরের মাধ্যমে বিচারপতি অপসারণের বিধান রয়েছে বলে পর্যবেক্ষণে উলেস্নখ ছিল। আরও বলা হয়, বাংলাদেশের সংবিধানে ৭০ অনুচ্ছেদের ফলে দলের বিরুদ্ধে সংসদ সদস্যরা ভোট দিতে পারেন না। তারা দলের হাইকমান্ডের কাছে জিম্মি। নিজস্ব কোনো সিদ্ধান্ত দেওয়ার ক্ষমতা নেই। ৭০ অনুচ্ছেদ রাখার ফলে সংসদ সদস্যদের সব সময় দলের অনুগত থাকতে হয়। বিচারপতি অপসারণের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও তারা দলের বাইরে যেতে পারেন না; যদিও বিভিন্ন উন্নত দেশে সংসদ সদস্যদের স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত দেওয়ার ক্ষমতা আছে। পর্যবেক্ষণে বলা হয়, মানুষের ধারণা হলো, বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা সংসদ সদস্যদের হাতে থাকলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হবে। সেক্ষেত্রে বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের আস্থা দুর্বল হয়ে যাবে। মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের বিধানটি তুলে দিয়ে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী পাস হয়। ওই বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর ৯৬ অনুচ্ছেদে পরিবর্তন এনে বিচারকের অপসারণের ক্ষমতা সংসদ সদস্যদের হাতে পুনরায় ফিরিয়ে দেওয়া হয়। যেটি ১৯৭২ সালের সংবিধানেও ছিল। সংবিধানে এই সংশোধনী হওয়ায় মৌল কাঠামোতে পরিবর্তন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা 'ক্ষুণ্ন' করবে; এমন যুক্তিতে ওই সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে একই বছরের ৫ নভেম্বর হাইকোর্টে এই রিট মামলা হয়।